পঞ্চাশ বছরের উপর ঘড়ির সাথেই ঘর করছেন কলকাতার ঘড়িবাবু

কলকাতা শহরের আনাচে কানাচে অনেক ঘড়ি। গীর্জার মুখে ঘড়ি, ডাকঘরে ঘড়ি, বাজারের টং-এ ঘড়ি, রাস্তার মাঝখানে ঘড়ি, ইস্টিশনের মাথায়ও ঘড়ি। কিন্তু এখন সে সব ঘড়ির অনেকেরই ভেতরের চাকা, স্ক্রু, পেন্ডুলামগুলো একটু জীর্ণতা পেয়েছে। ঢিলে ঢালা হয়েছে। দেখতে দেখতে শহরে অনেক ঘড়িও দেহ রেখেছে। দেহ রেখেছে নিদেন পক্ষের ‘সেথ থমাস’ বা ইউ.এস.নেভি-র ঘরোয়া দেওয়াল ঘড়িগুলোও। আর যাঁদের জন্যে বেঁচে বর্তে আছে এই বনেদি ঘড়ির তালুক তাঁরাই হলেন অগতির গতি ঘড়ি বাবু।

বর্তমানে কলকাতা শহরের এক নামজাদা ঘড়িবাবু হলেন কলেজ স্ট্রিটের বাসিন্দা স্বপন দত্ত। নয় নয় করেও পঞ্চাশ বছরের ওপর ঘড়ির সাথেই ঘর করছেন কলকাতার অন্যতম প্রধান এই ঘড়ি বাবু। বাবা পতিতপাবন দত্ত নিজেও ছিলেন নামজাদা ঘড়ি বিশারদ। বর্তমানে স্বপন বাবুর হাতে কলকাতার কত শত ঘড়ি যে শুধু পারিবারিক ভাবেই দায়িত্বে রয়েছে তার তালিকা করতে গেলে একটা মহাভারত হয়ে যাবে। তবে তথ্যের খাতির নিউ মার্কেটের দুরন্ত ওয়েস্ট মিনিস্টার ক্লক, মানিকতলা বাজারের জার্মান ক্লক, মেট্টোপলিটান বিল্ডিং এর নন্ স্ট্রাইকিং ক্লক, ধর্মতলা চার্চের ডিং-ডং কোয়ার্টার চাইমিং ক্লক, জোড়া গীর্জার ডিং-ডং-আওয়ারলি চাইমিং ক্লক এসব এখন স্বপন বাবুর তত্ত্বাবধানে কলকাতাকে টাইম দেখিয়ে চলেছে। আরেকটি ঘড়ি মানে রেসকোর্সের রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব (R.C.T.C) এর ঘড়িটির দেখ ভালের দায়িত্ব স্বপন বাবুরই। চলমান ঘড়ি গুলির শয়ে শয়ে যন্ত্রপাতির কোনটার আয়ু কতটা তার তালিকা ও পর্যবেক্ষণ নথি রাখেন স্বপন দত্ত। সেই অনুসারে ওয়ার্কশপে চলে সেই ক্ষয়ে যেতে থাকা যন্ত্রকে প্রাণ দেওয়ার আগাম প্রস্তুতি। মাঝে মধ্যেই রিপেয়ারিং টিম নিয়ে দৌঁড়োতে হয় নেপাল কিম্বা আগরতলা। সেখানের রাজমহিমা যুক্ত ঘড়ি গুলিও স্বপন দত্ত মশাইয়ের হাতেই প্রাণ পেয়েছে। ছোটবেলায় কলকাতার নামজাদা ঘড়ি বিশারদ, বাবা পতিতপাবন দত্ত’র থেকেই স্বপন বাবুর ঘড়ি, চেনার হাতে ঘড়ি।

ঘড়ি লোকে চেনে দু’ভাবে। এক হল নির্মাতার নামে আর দু’ই হল তার চাল-চলনের ঢং-য়ে। যেমন জেমস ম্যাকেড, হ্যামিলটন, কুক্ অ্যান্ড কেলভি, সেথ টমাস, রায় কাজ়িন, জ়ে.ডব্লিউ বেন্সন্ এই নির্মাতাদের নামেই ঘড়ির পরিচয় তৈরি হয়। আর চরিত্রে কেউ চাইমিং, কেউ ওয়েস্ট মিনিস্টার, কেউ স্ট্রাইকিং আবার কেউ গ্র্যান্ড ফাদার। আস্তে আস্তে এই লাইনে তৈরি করে নিয়েছেন পুত্র সত্যজিৎকেও। সে এখন তরুণ প্রজন্মের দুরন্ত ঘড়িবাবু। বাবার মত সেও ঘড়ির চরিত্র চিনতে সিদ্ধহস্ত। সত্যজিৎ নিজেও ঘড়ির ইতিহাস নিয়ে ব্যাক্তিগত ভাবে নিরলস পড়াশুন করে। ওয়ার্কশপে সহকর্মী স্থানীয় কারিগরদের সঙ্গে দিন রাত কাজ করে সে। সত্যজিৎ জানায় হাতে কলমে কাজ করলেই বোঝা যায় ঘড়ির চলন চরিত্র। স্বপন বাবুর মতে ঘড়ি চলার চরিত্রটি এই কাজে সবার আগে চিনতে ও বুঝতে হয়। ওই চলার চরিত্রটির আড়ালেই লুকিয়ে আছে ঘড়িটির আসল ঐতিহ্যের তকমা। কী রকম? প্রশ্ন রাখতে জানালেন “যেমন ধরুন কলকাতার নিউ মার্কেটের ঘড়ি। শহরের একমাত্র সচল ওয়েস্ট মিনিস্টার ক্লক। পনেরো মিনিট অন্তর মন ভেজানো চাইমিং বেজে ওঠে এতে। পনেরো মিনিটে চারবার, তিরিশ মিনিটে আটবার, পঁয়তাল্লিশ মিনিটে বারোবার এবং টাইম পয়েন্ট কাটা ছোঁয়ার সাথে সাথে ষোলবার চাইমিং হওয়ার পরই বেজে উঠবে নির্দিষ্ট টাইমের ঘণ্টা। আবার মানিকতলা বাজারের ঘড়ির কাটা দেখলে মনে হবে ঘড়ি অচল। কিন্তু ১ মিনিট অন্তর সেই কাটার লাফিয়ে লাফিয়ে সরার কায়দাটাই অনবদ্য।”

স্বপন বাবুর থেকেই জানা গেল ঘড়ির ডায়ালের গায়ে নম্বর লেখাটাও একটা ঐতিহ্য। যেমন মানিকতলার টাওয়ার ক্লকে ১ থেকে ১২ পর্যন্ত নম্বর বাংলায় লেখা আছে। আধ ঘণ্টা অন্তর একটা বেল আর বাকিটা সময় ধরে সেই কটা বেল পড়ে। এ রকম বাংলা নম্বর কলকাতার আর টাওয়ার ক্লকে দেখা যায় না। আবার ডায়ালের গায়ে নম্বর লেখার সিস্টেম এ দিক সে দিক হলে ঐতিহ্য নষ্ট হয়। জানালেন ডায়ালের গায়ে ১ থেকে ৪ পর্যন্ত রোমান I এর চারটে দাড়ি দিয়ে লিখতে হবে। চারের জন্য রোমান ‘IV’ লেখা যাবে না। সেটা দস্তুর নয়। ছয় থেকে আট রোমান ‘V’ কে নির্ভর করে লিখতে হবে। আর নয় থেকে বারো রোমান ‘X’ কে নির্ভর করে লিখতে হবে। হাসতে হাসতে বলছিলেন “প্রমাণ দিতে হয়েছে মশাই। নেপালের দরবার মার্গের দগ্ধ ঘড়ি সারিয়ে ডায়ালে লিখলাম চারের জায়গায় রোমান IV-র বদলে চারটে দাড়ি মানে ‘IIII’। হৈচৈ পড়ে গেল। কাগজে লেখা বেড়িয়ে গেল চার ‘IV’ এভাবে না লিখে আমি ভূল করেছি। ডেকে পাঠানো হল আমাকে। বাঁচিয়ে দিল ওই ঘড়িটার পেটের ভেতর যে ছোট্ট প্রাচীন ঘড়িটা টিক্ টিক্ করছে সেটাই। ওটা খুলে দেখালাম সেখানেও চারের জায়গায় রয়েছে ‘IIII’। চারের জায়গায় রোমান ‘IV’ নৈব নৈব চ।” হৈ হৈ করে সে খবরও প্রকাশ হল কাগজে। আমার এখন মনে হয় এ হল বাঙালির নেপাল জয়। ভাবুন তো মশাই সত্যজিৎ রায় থাকলে কি বলতেন না- ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে’!