ঘরে ঘরে দুর্গা : বাংলার হস্তশিল্পে নারীশক্তির নানা রূপ

টেরাকোটার একচালার দুর্গা
অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন দুর্গা। তিনি অসুরবিনাশিনী। পুরাকাল থেকে এখনও পর্যন্ত নারীশক্তির প্রতীক। সেই দুর্গা কখনও বীরাঙ্গনা, কখনও বা স্নেহময়ী। দুর্গার বিভিন্ন রূপই আজকের নারীর মধ্যে প্রকট। আমাদের ঘরে ঘরে দুর্গা। আজকের দুর্গারা নিজেদের প্রমাণ করে চলেছে অক্লান্তভাবে। সমাজে নিজেদের জায়গা করে নিতে তারা মরিয়া। নানা সময় বিভিন্ন রূপে আজকের দুর্গারা নিজেদের দক্ষতার, কর্মক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে চলেছে নিরন্তর।
পুরাণে বর্ণিত দেবী দুর্গার শক্তিরূপের কথা আজও মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে। সমাজে সমগ্রভাবে নারীর উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রেও তাঁর শক্তিদায়িনী রূপই বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। বহু বছর ধরে দুর্গা প্রাণ পাচ্ছে বাংলার হস্তশিল্পীদের কল্পনা ও কারিগরী দক্ষতায়। মাটি, গালা, ডোকরা – বাংলা জুড়ে তৈরি হয় নানা ধরনের দুর্গা পুতুল।
আমাদের ঘরে ঘরে দুর্গা। আজকের দুর্গারা নিজেদের প্রমাণ করে চলেছে অক্লান্তভাবে। সমাজে নিজেদের জায়গা করে নিতে তারা মরিয়া। নানা সময় বিভিন্ন রূপে আজকের দুর্গারা নিজেদের দক্ষতার, কর্মক্ষমতার প্রমাণ দিয়েই চলেছে নিরন্তর।
কৃষ্ণনগরের দুর্গা
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলশিল্প প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বছরের পুরোনো। এখানকার শিল্পীদের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয় না। বংশানুক্রমে তাঁরা আশ্চর্য দক্ষতা এবং সৃজনশক্তির পরিচয় দিয়ে আসছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “সেখানে ক্লাসরুম টেবিল চেয়ার লাইব্রেরি লেকচার হল কিছুই নেই, অথচ দেখা যায় সেখান থেকে পাকা পাকা কারিগর বেরিয়ে আসছে – পুরুষানুক্রমে আজ পর্যন্ত”।
এখানকার মৃৎশিল্পীরা প্রথমে দেবদেবীর মূর্তি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে অন্যন্য পুতুল তৈরির কৌশল রপ্ত করেছিলেন। এছাড়াও ‘নদীয়া কাহিনী’-র রচয়িতা কুমুদনাথ মল্লিক জানিয়েছেন, প্রথমে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা ছিলেন কুমোর। তাঁরা দেবদেবীর প্রতিমা বানাতেন। খ্রিস্টান মিশনারি এবং ইংরেজ শিল্পরসিকদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই মাটির পুতুল বানানো শুরু করেন তাঁরা। কারুকাজ, প্রাকৃতিক রঙ, বানানোর পদ্ধতি এবং ইতিহাসের জন্য কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত। এখানকার মৃৎশিল্পীদের হাতে গড়া অন্যান্য পুতুলের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী গণেশ জননীর কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। উমার কোলে থাকে শিশু গণেশ – এই পুতুল দেবী দুর্গার মাতৃরূপের প্রতিনিধিত্ব করে। শুধু তাই নয়, এই মূর্তি কৃষ্ণনগরের সাবেকি মৃৎশিল্পের ধারক। এছাড়া, কৃষ্ণনগরের দুর্গা হিসেবে মহিষাসুরমর্দিনী রূপী দুর্গামূর্তিও (ছোটো-বড়ো দু’আকারের) যথেষ্ট জনপ্রিয়।
মজিলপুরের দুর্গা পুতুল
প্রায় দু’শতাব্দী আগের কথা। যশোহরের দত্ত জমিদারেরা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরের মজিলপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে এসেছিলেন কালীচরণ পেয়াদা। এই কালীচরণ পেশায় ছিলেন জমিদারের পেয়াদা, কিন্তু তাঁর আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল। মাটির পুতুল আর দেবদেবীর নয়নাভিরাম সব মূর্তি তিনি বানাতেন। তাঁর বানানো টেপা পুতুল সবাইকে মুগ্ধ করে দিত। কালীচরণের দুই ছেলে। এঁদের মধ্যে জানকীনাথ দাস ছিলেন পুতুল বানানোয় কালীচরণের উত্তরসূরী। অনেকে বলেন, জানকীনাথের ছেলে হরিনাথই পুতুলের আলাদা ঘরানা তৈরি করেন, যা পরে মজিলপুরের পুতুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। তাঁর বংশধর মন্মথনাথের বানানো পুতুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে।
মন্মথনাথের নাতি শম্ভুনাথ দাস এখন মজিলপুরের পুতুল তৈরির ঐতিহ্যকে পরম যত্নে লালন-পালন করছেন। মজিলপুরে একমাত্র তাঁদের ঘরেই এই ধরনের পুতুল বানানোর কাজ হয়। কারিগর বলতে একমাত্র তিনি বা তাঁদের পরিবারের লোকজন। এখন মজিলপুরে দেখা যায় এক-খোল এবং দু-খোল ছাঁচের পুতুল। এক-খোলের থেকে দু-খোল ব্যবহার করলে তাড়াতাড়ি বেশি সংখ্যায় পুতুল বানানো যায়। তবে হাতে বানানো পুতুলও আছে। মজিলপুরের হাতে বানানো পুতুলগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মানিকপির, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর, পঞ্চানন ইত্যাদি। তাঁদের নবতম সংযোজন দুর্গা পুতুল। আগে কৃষ্ণনগরের মতো মজিলপুরেও গণেশ জননী বানানো হতো শুধু। বছর দুয়েক হলো দুর্গা পুতুল বানাচ্ছেন তাঁরা। শম্ভুনাথ এই পুতুল তুলে দিয়েছেন কলকাতার হস্তশিল্প বিপণি ‘দ্য বেঙ্গল স্টোর’-এ। (শম্ভুনাথ দাসের গড়া অন্যান্য পুতুলগুলিও এখান থেকে সংগ্রহ করা যায়।)
বহু বছর ধরে দুর্গা প্রাণ পাচ্ছে বাংলার হস্তশিল্পীদের কল্পনা ও কারিগরী দক্ষতায়। মাটি, গালা, ডোকরা – বাংলা জুড়ে তৈরি হয় নানা ধরনের দুর্গা পুতুল।
টেরাকোটার একচালার দুর্গা
প্রতিমাশিল্প তথা মৃৎশিল্পে প্রতিমার চালি বা চালচিত্রের ব্যবহার শিল্পরীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রাচীন বঙ্গদেশে দুর্গাপ্রতিমায় ধ্রুপদী চালা ও চালচিত্র ব্যবহার করা হত। এই চালচিত্রের মধ্যেই দেবী দুর্গা আর কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী। আদি প্রতিমা একচালাই হতো। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বহু সাবেকি বাড়িতে এখনও সেটাই চলছে। বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার দুর্গায় ধরা পড়েছে প্রাচীন এই রীতি। স্থাপত্য থেকে ভাস্কর্য : বাংলার টেরাকোটা চর্চা আজ বিশ্বজনীন। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া, সোনামুখি, রাজগ্রাম, হামিরপুর প্রভৃতি ছোটো গ্রামগুলি ও বিষ্ণুপুর ছাড়াও উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ টেরাকোটা স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত। বাঁকুড়া পাঁচমুড়ার শিল্পীদের হাতে ধারাবাহিক ভাবে প্রাণ পাচ্ছে টেরাকোটার একচালার দুর্গা।
ডোকরার একচালার দুর্গা
ডোকরা হলো হারানো মোম ঢালাই পদ্ধতিতে এক শিল্পকর্ম যা প্রায় ৩৫০০ বছরের পুরোনো বলেই মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। মহেঞ্জোদারোতে ডোকরা শিল্পের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন এই ধাতুজ শিল্প এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি ডোকরা শিল্পের নিদর্শন মেলে। বাঁকুড়ার বিকনায় এবং পূর্ব বর্ধমানের গুসকরা এই ডোকরা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। ডোকরা খুবই শ্রমসাধ্য একটি শিল্পকর্ম। এর কারিগরি দক্ষতা, শৈল্পিক সূক্ষতা, ধাতব রঙের উজ্জ্বল্য শিল্পকর্মগুলিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এভাবেই ডোকরার একচালার দুর্গামূর্তিও যেন অতিপ্রাকৃত হয়ে ওঠে। শৈল্পিক দিক থেকে আর আধ্যাত্বিকভাবেও। একচালার দুর্গা ছাড়াও নানা রূপে ডোকরার দুর্গা গড়ে থাকেন শিল্পীরা।
ঘরে দুর্গা আসার আগে নারীশক্তি উদযাপন করতে শুরু হয়েছে ‘দ্য বেঙ্গল স্টোর’-এর ক্যাম্পেন ‘ঘরে ঘরে দুর্গা’। বাংলার হস্তশিল্পের নমুনা, নানা রূপের দুর্গামূর্তিগুলি এক ছাদের তলায় নিয়ে এসেছে কলকাতার এই বিপণি। ঠিকানা- ১২৭, যোধপুর পার্ক, কলকাতা।