No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    এমন ঘনঘোর বরিষায়

    এমন ঘনঘোর বরিষায়

    Story image

    (১)
    ছাদ থেকে নেমে এসেছ ঘরে। সিঁড়ি পেরিয়ে, ভেজা পায়ের ছাপ এখন মেঝেয়। এগিয়ে গেছ জানলার দিকে। খেয়াল করোনি, মেঝেতে পায়ের ছাপ হঠাৎ করে শুকোয় না কখনও। ধার থেকে কমতে কমতে শেষ অবধি মধ্যিখানে এসে মেশে। পিছনে ফিরলে তুমি। চমকে উঠলে ছাপ দেখে। ছোট হয়ে এসেছে খানিক, তবে বোঝা যাচ্ছে বেশ। এবং পায়ের এই ধাঁচ তোমার নয়। কার হতে পারে? হেসে উঠলে। ফিরে গেলে জানলায়। তোমার ভাবনা তখন ছুটে যাচ্ছে নরম ওই ছাপে। চেয়েছিলে, গিন্নি হোক পা। ঘরময় ছুটোছুটি করে বেড়াক নানান কাজে। খেতে বসলে, তোমারই পিঁড়ির পাশে ফুটে থাকুক মায়ের মতো।

    মেঘ ডাকছে। সাড়া পাবে না জেনেও ডেকে উঠেছে মেঘ। হাত বাড়ালে জানলা দিয়ে। কার্নিশ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে জল। কীভাবে উৎস থেকে সরতে সরতে একটা ফোঁটা ঠিক তোমার হাতেই মৃত্যু পেল, সে-কথা বলা যায় না কাউকেই। অথবা, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়...’। ক্যালেন্ডারে চোখ গেল তোমার। বস্ত্রালয়ের মোটা হরফ পেরিয়ে, আজকের তারিখে এসে থামলে। পয়লা আষাঢ়। ‘আষাঢ়’ শব্দটার মধ্যে কেমন একটা গম্ভীর ভাব। বাসববাবুর গলা। স্কুলজীবন। এমন কত আষাঢ় পার করেছ না-জেনেই। স্কেলের মার, ছিঁড়ে ফেলা চিরকুট, বোবা নৌকা – আষাঢ় তোমাকে দিয়েছে কম না। নিয়েছে কী, সে-হিসেব পেতে পেতে যৌবন। আর আজকের এই জানলা, যার সামনে দাঁড়িয়ে গানের প্রথম লাইনের পর এগোতে পারলে না মোটেই।

    (২)
    ‘দুজনে মুখোমুখি      গভীর দুখে দুখি
        আকাশে জল ঝরে অনিবার –
        জগতে কেহ যেন নাহি আর।’

    বহুদিন আগে বলেছিল কেউ, এমনই ধারণা তোমার। হয়তো বলেইনি, ভেবে নিয়েছ মনে-মনে। এই ভেবে নিতে গিয়ে, চোখের সামনে দিয়ে অনেক বর্ষা চলে গেছে শরতে। শরৎ, হেমন্তে। তারপর শীত। কুঁকড়ে গেছ তুমি। আজ, ‘দুজনে মুখোমুখি’ শুনে একই ভুল করছ আবার। হাত রাখছ তার গালে। যেন কতদিন পর এই স্পর্শটুকুর জন্যেই দাগ মেলায়নি এখনও হাতের।

    মুখোমুখি কি সত্যিই হওয়া যায়? হবে কোনওদিন? পথ কিন্তু বলছে, হ্যাঁ। বৃষ্টির পরে পথের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে কৃষ্ণচূড়া পলাশ; ওরাও বলছে – আমরা যদি পারি, তুমি পারবে না কেন! মফঃস্বলের রাস্তায় বৃষ্টিশেষের মায়া। দূরের ওই হলুদ আলো ছাড়া সত্যিই কেউ নেই জগতে। বেরিয়ে পড়েছ তুমি। বুঝে নিতে চাইছ, যদি চলেই আসে কোনওদিন, মানিয়ে নিতে পারবে কিনা। বলেছিল, ‘কোনও কিছুই উপযুক্ত নয় মশাই... করে নিতে হয়।’ অজস্র ভেবে নেওয়ার বিপরীতে এই বাস্তবটুকু আঁকড়ে ধরতে চাইছ প্রাণপণে। বিয়ের জল লেগেছে প্রত্যেক গাছে। ভারী হয়ে উঠছে তারা। তাজা হয়ে উঠছে। ওদের দিকে তাকাতে পারছ না তুমি। কেন, নিজেকে সে-প্রশ্ন করার আগেই জমে-থাকা জল ঢেলে দিল মাটিতে। কাঁদছে। বিয়ের পরও তাহলে কাঁদে কেউ!

    তুমি মাটি হতে পারলে না। অথবা এতটাই মাটির, মনেও রাখেনি। আষাঢ় তোমাকে সেইসব অবহেলার কাছে নিয়ে গেল। ক্ষমা করতে পারবে বুঝি আর?

    (৩)
    ‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অতলস্পর্শ বিরহ। আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে আপনার মানসসরোবরের অগম তীরে বাস করিতেছে; সেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেখানে সশরীরে উপনীত হইবার কোনো পথ নাই।’

    ফিরে এসেছ অনেকক্ষণ। একা হওয়ার মুহূর্তে ঠাঁই নিয়েছ রবীন্দ্রনাথে। অথচ কিছুতেই তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারছ না তুমি। কল্পনা নয়, সশরীরেই উপস্থিত হবে একদিন। সারা শহর কাঁপিয়ে, চিৎকার করে জানান দেবে অস্তিত্ব। ‘অতলস্পর্শ বিরহে’র থেকে ফিরিয়ে নিয়েছ চোখ। চাইছ এড়িয়ে যেতে। তোমার কোনও মেঘ নেই। পাঠানোর মতো খবরও নেই তেমন। শুধু পারো – ‘যে কথা এ জীবনে   রহিয়া গেল মনে / সে কথা আজি যেন বলা যায়’। এত সামান্য সম্বল নিয়ে বিরহ সাজে না তোমার। কথা বাঁধতে গিয়ে ছড়িয়ে ফেলার স্বভাব যতদিন না মিটবে, আশ্রয় দেবে না কেউই।

    উঠে গেলে জানলার কাছে। মাঝরাত্তিরে ঈশ্বরের দীর্ঘশ্বাস পাক খায় মফঃস্বলে। তুমি দেখছ, এই মুহূর্তে তিনিও একটি জোনাকির তুলনায় ম্লান। জোনাকি, না নথ? তোমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমচোখে দূরের আলোছায়ায় ফুটিয়ে তুলছ আবছা কারও মুখ। না, মুখ নয়, একটা নথ-কে কেন্দ্র করে আলোকবৃত্ত। ঝাঁপ দিচ্ছ সেই স্নিগ্ধতায়। ঘুম পাচ্ছে... ঘুম...

    স্বপ্ন দেখতে পারো না বলে কোনও পাশ ফেরা-তেই ব্যাঘাত ঘটবে না আর, তুমি জানো।

    (ছবি - সুপ্রিয় মিত্র)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @