জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গৌতম বলেছিলেন, “আমি ভুলে গেছিলাম আকাশ কত বড়ো”

বাংলা গানের ইতিহাস যদি লেখা হয়, সেখানে ‘গৌতম চট্টোপাধ্যায়’ নামে একটি বৃহৎ চ্যাপ্টার থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৬৫-১৯৬৮ এই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিওলজি পড়তেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ওঁর ব্যাচমেট সমরেশ চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায় গৌতমের কলেজ জীবন সম্পর্কে । উনি ছিলেন ভীষণ মজার মানুষ, আড্ডা মাতিয়ে রাখতেন । গৌতম চট্টোপাধ্যায় স্প্যানিশ গিটারের পাঠ নিয়েছিলেন বিদ্যুৎবাবুর কাছে। তখন নকশাল আন্দোলনে উত্তাল প্রেসিডেন্সি কলেজ। গৌতম সেইসময় কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুদের একটি ব্যান্ড তৈরি করে ফেলেছেন। পার্কস্ট্রিটের বারে গাইছেন, বাজাচ্ছেন বিটিলস বা সাইমন-গারফাংকেলের গান। সময়ের টানে গৌতমও দেখতে শুরু করলেন দিন বদলের স্বপ্ন! লম্বা চুল, হিপিদের মতন পোশাক উধাও খদ্দরের পাঞ্জাবি, রাবারের চটি। গভীর রাতে বাড়ি ফিরছেন, কখনো বাড়ি ফিরছেন না কয়েক সপ্তাহ । পরিবারের লোকজন কিছুই জানে না। একদিন রাতে গৌতমদের বাড়ির দরজা কেঁপে উঠল সিআরপির লাথিতে। বাড়ি ঘিরে ফেলেছে ওরা। গৌতমের মা-বাবার দিকে রিভলভার তাক করা, গোটা বাড়ি সার্চ করার নামে তছনছ করে ফেলেছে ওরা। অনেক বন্ধুরাই তখন জেলে, কেউ কেউ শহিদ হয়েছেন। কিন্তু, গৌতমের খোঁজ নেই। কয়েক সপ্তাহ পর ভোরবেলায় গৌতম বাড়ি ফিরলেন। সারা গায়ে ঘা, এক মুখ দাড়ি, ছেঁড়া পোশাক, পুকুরের জল খেয়ে ব্লাড ডিসেনট্রি। গৌতম কোথায় ছিল পরিষ্কার করে বলেনি, শুধু বলেছিল সে সুন্দরবনে চলে গেছিল পার্টির কাজ করতে। কিছুদিন পর গৌতমকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেউ বলেছিল ওকে জেলের ভেতরেই হয়তো মেরে ফেলবে, কেউ বলল জেলেই সেফ, বাইরে বেরোলে ফেক এনকাউনটারে শেষ করে দেবে। তখন গৌতমের পরিবার জেলে গৌতমের সঙ্গে দেখা করতে গেলে চারমিনার আর নানান পত্রিকা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। গৌতমকে দমদম জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেইসময় জেলের সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন অনিন্দ্য মুখার্জি। অনিন্দ্য ছিলেন গৌতমের সমসাময়িক, প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্সের ছাত্র। উনি গৌতমের পরিবারের প্রতি ভীষণ আন্তরিক ছিলেন। অনিন্দ্য বলতেন - “গৌতম তখন কলেজে খুব পপুলার ছিল। মেয়েরা ওঁর গিটার শুনত মুগ্ধ হয়ে। আমরা যখন ফিজিক্সের সমীকরণের মাথা খারাপ করছি গৌতম তখন সিনেমা, থিয়েটার, রাজনীতি নিয়ে মেতে আছে। ও ছিল এসবের এক্সপার্ট। আমার ইচ্ছে ছিল পদার্থবিজ্ঞানী হবার, কিন্তু হয়ে গেলাম আইপিএস। ইচ্ছে করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে , কলেজে পড়াই।" অনিন্দ্য গৌতমের পরিবারকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছিল। ওঁর জন্যই জেলের ভেতরে গিটার নিয়ে যাবার অনুমতি মিলেছিল, যাতে গৌতম সেটি বাজাতে পারে। যাদের বিরুদ্ধে সঠিক এভিডেন্স নেই, তাঁদের মুক্তি দেবার অর্ডার আসে। অনিন্দ্য বুঝতে পারেন, ছাড়া পেলেও গৌতম সেফ নয়। তাই ওঁর পরিবারকে বলেন, গৌতমকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে। গৌতমকে অত্যন্ত গোপনে জব্বলপুরের এক রিলেটিভের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টের রিইউনিয়ন ম্যাগাজিন থেকে সংগৃহীত ছবি
যেদিন মুক্তি পেয়েছিলেন গৌতম, বলেছিলেন – “আমি ভুলে গেছিলাম আকাশ কত বড়ো, মুক্ত বাতাসের অনুভূতি কী রকম”। কয়েকবছর চাকরি করার পর গৌতম কলকাতায় ফিরে আসেন ।
৬০-৭০ দশকে আমেরিকায় মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। বব ডিলান, জোন বায়েজ, পিট সিগার, ফিল ওকসরা গাইছেন দিন বদলের গান। বিটিলসরা চিৎকার করে বলছেন মুক্ত ভালোবাসার কথা। ৬০-৭০ দশকে উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু বাংলা গানে সেই দিন বদলের স্বপ্নের কথা অনুপস্থিত! সেইসময় প্রথম বাংলা ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির গান মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেনি। ১৯৯৫ সালে 'আবার বছর কুড়ি পরে' অ্যালবাম প্রকাশের পর বাংলা ব্যান্ডের জয়যাত্রার সূচনা। গৌতম চট্টোপাধ্যায় বহু সঙ্গীত শিল্পীকে উৎসাহিত করেছিলেন সেইসময়। তিনি সবসময় নতুন কিছু সৃষ্টি করতে উৎসাহ দিতেন। বহু মানুষের স্মৃতিচারণায় সেই কথাগুলো উঠে এসেছে। ওঁর বাড়িতে গেলেই জিজ্ঞাসা করতেন, নতুন কোনো গান তৈরি করলে? গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে যে ঘরে আড্ডা বসত, সেই ঘর নিয়ে একটা গান লিখেছেন জয়জিৎ লাহিড়ী—
“ঘরের দেয়ালে পাবলো পিকাসো
বইয়ে ঢাকা চারিধার
হলুদ আলোতে নীল নীল ধোঁয়া সব
ঘোরেফেরে বারবার ।
জুতো-জোড়া আর মান-অভিমান
বাইরে এসো খুলে
অহমিকা সব ফেলে দিয়ে এসো যুক্তির জঙ্গলে...
এখানে মুক্ত তোমার প্রাণ, গাওনা তোমার গান”
এই জয়জিৎ লাহিড়ী শহরের উষ্ণতম দিনে , ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি ইত্যাদি গানের গীতিকার। গানবাজনার দুনিয়ায় বেশিরভাগ লোকই আপনাকে অপমান করবে, আপনার সৃষ্টিকে খেলো বলবে, বলবে – ‘তুমি কিসসু জানো না’। কিন্তু, গৌতম ছিলেন একদমই উল্টো। উনি নতুনদের এগিয়ে দিতেন সামনের দিকে। নব্বই-এর দশকে বাংলা ব্যান্ড বিপ্লবের প্রাণপুরুষ ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। উনি নিজে গিটার, স্যাক্সোফোন ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রে দক্ষ ছিলেন। উনি ছিলেন অত্যন্ত ভালো একজন পারফর্মার। গৌতম লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে... বোকাবাক্সতে বন্দি’। এই বোকাবাক্স তো এখনকার স্মার্টফোন। গৌতম নিজের সময় থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। বাউল সঙ্গীত নিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। মাইনর স্কেলের প্রতি গৌতমের অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল। ওঁর লেখা বেশিরভাগ গানের সুর মাইনর স্কেলে। পৃথিবী, টেলিফোন, ঘরে ফেরার গান, চাঁদ ডুবে যায়, চাই না যা পাই, প্রিয়া ক্যাফে, এই মুহূর্তে, কত কী করার আছে বাকি, নীল সাগরে, দরিয়া ইত্যাদি সব গানই মাইনর স্কেলে সুর করা। সং রাইটিং-এর ক্ষেত্রে গৌতম ছিলেন ভীষণরকম ছকভাঙা। উপরে উল্লিখিত প্রতি গান কিন্তু নিজের মতন স্বতন্ত্র। চেনা ফর্মুলায় কথা বসিয়ে লেখা গান নয় একটাও। গৌতমের বেশিরভাগ গানেই ভীষণ গভীর এক যন্ত্রণার হদিশ মেলে।
“সেইসব স্বপ্নেরা মিছে মিছে বেদনা জাগায়” —
৭০ দশকে মুক্তির স্বপ্ন, বিপ্লবের স্বপ্ন রাস্তায় উপর দলা পাকানো রক্তে, গণহত্যায় বেনাম লাশের ভিড়ে হয়তো হারিয়ে যাচ্ছিল। মহীনের গানেই শুনতে পাই – “মাগো কেঁদো না ফিরে আসবো”। কজন ফিরতে পেরেছিল! যারা ফিরেছিল, তাঁরা অনেকেই স্বপ্নভঙ্গের হতাশা নিয়ে ফিরেছিল। অসীম চট্টোপাধ্যায়কে (কাকা) গৌতম একবার বলেছিলেন — “I could not break the cage of exploitation, but I will break the cage of Bengali music.”
আজ গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন স্যার।