গানের ঝর্নাতলায় - ১

কেউ যখন জিজ্ঞেস করত, আমার মায়েরা ক'বোন ...আমি খুব অক্লেশে জবাব দিতাম ..চার। আসলে মাসিমণি যদিও আমার মায়ের 'মায়ের পেটের বোন' ছিল, বড়মাসি আর সোনামাসিও আমার দিদার বুক জুড়ে বসত করত। তাদের মা চলে গিয়েছিলেন খুব অল্পবয়সে, তাই ভাসুরের মেয়েরাও আমার দিদার কন্যাসমা ছিল। সোনামাসি কিন্নরকন্ঠী হলেও আমার কিন্তু বড়মাসির গান শুনতে বেশি ভালো লাগত। তার কারণ হয়তো এটাই যে সোনামাসি রবি ঠাকুরের গান গাইত না তেমন। বড়মাসি আবার ছিল উল্টো। আর ওই বয়সে একমাত্র ওই রবি ঠাকুরই আমাকে দোলা দিতেন। বড়মাসি হারমোনিয়াম নিয়ে গান শুরু করত আর আমি কোল ঘেঁষে মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম।
খুব আদর পেয়েছি আমি। বাড়িতে আমি ছিলাম সেই প্রজন্মের প্রথম শিশু। বড়মাসি সন্তানহীনা ছিল। খুব চাপা স্বভাবেরও ছিল। এখনও জানি না, শুধু আমি কেন..সম্ভবত আমার মামারবাড়ির কেউই জানত না বা জানে না ...এই সন্তানহীনতার দায় বড়মাসির ছিল, না মেসোর। এ নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা, ডাক্তার বদ্যি কিছুই হয়নি সম্ভবত। বড়মাসির কোনো চাপা দু:খ ছিল কি না ...তাও বুঝতে পারা যেত না। শুধু যখন দুটি চোখ বন্ধ করে গাইত ‘সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে ...’, আমার কেন জানি মনে হত, বড়মাসির ফর্সা গালে ফুটে ওঠা সরু নীল শিরাটা একটু একটু কাঁপছে থিরথির করে।
একবার...শুধু একবার .... ঘরে সবাই গল্প করছে, আমরা দু-তিনজন খুব হুটোপাটি করছি, কে যেন বকছিল আমাদের। বড়মাসি মৃদু গলায় বলল, "ছেলেমানুষ ওরা, থাক না! নাই বা বকলি!" অমনি যে বকছিল, সে মুখঝামটা দিয়ে বলেছিল, "তুই থাম তো দিদি ! ছেলেপুলে তো আর মানুষ করতে হল না তোকে! তুই কী বুঝবি কী হাড়জ্বালানো এই বিচ্ছুগুলো। " বড়মাসি খুব নিচু গলায় বলল, "আমি কিন্তু বুঝতেই চেয়েছিলাম!"
আমি তখন বছর দশেক। এমন অন্যরকম সুরে বলল, যে খট করে লাগল কানে। তাকিয়ে দেখি, বড়মাসির মুখটা কেমন অচেনা।
বড়মাসি চলে গেছে আজ ঊনত্রিশ বছর। তার জীবনে বিকেলের আলো ফুরোনোর আগেই। আচমকা..কোনোরকম আগাম জানান না দিয়ে। সন্ন্যাসরোগে। কেউ ছিলও না বাড়িতে তখন। যখন জানা গেল, তখন আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা বাকি, চেতনা লোপ পেয়েছিল পুরোপুরি। একটা আস্ত মানুষ কেমন "নেই"হয়ে গেল ...কাউকে কোনো ঝামেলায় না ফেলে।
আজকাল মৃত মানুষরা খুব ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ঠেকে তখন। বড়মাসিও আসে। আমার দশ বছর বয়সে মাত্র একদিন দেখা ওই অচেনা মুখ নিয়ে। তবে এখন আর অচেনা লাগে না। চিনে গেছি, বুঝি ...ওই অভিব্যক্তি, অভিমান, ভাঙচুর...সব কিছু।