২১ জুলাই ছিল গণতন্ত্রের দাবিতে পরিবর্তনের প্রথম মাইলস্টোন

২১ জুলাই বৃষ্টি হয়। অন্তত যতগুলো ২১ জুলাইয়ের কথা আমি মনে করতে পারছি। যদিও ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই বৃষ্টির দিন ছিল না। সেদিনটা খুব গরম ছিল। ওই দিন দুপুরের পর কলকাতার রাস্তায় ১৩ জন যুবক পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে এই দিনটিকে বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৮৪ সালে। ওই বছর মমতা বন্দ্যপাধ্যায় সাংসদ হলেন। সিপিএম নেতৃত্বের নজর এড়াল না, তাদের মতে ফাঁকতালে জিতে যাওয়া টিনের চালের বাড়িতে থাকা একটা মেয়ে বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে গরিব মানুষের প্রতিবাদকে ভাষা দিতে। নির্যাতিতের পিঠে হাত রাখতে।
মমতা তখন কংগ্রেসে। দলের কনিষ্ঠতম নেত্রী। প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল এই ঝড়ের গতি। মমতা যতই আন্দোলনমুখী হচ্ছিলেন, কংগ্রেস নেতাদের অস্বস্তি ততই বাড়ছিল। কংগ্রসের মধ্যে যে একটা নতুন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে, পাকা মাথার বামপন্থীদের তা চোখ এড়াল না। ষড়যন্ত্রেরর জন্মও সেই সময়ই। ১৯৯০ সালে যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হলেন মমতা। সে বছরই ১৬ অগস্ট বামফ্রন্টের সার্বিক ব্যর্থতা, মূল্যবৃদ্ধি, কংগ্রেস কর্মীদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে রাজ্য যুব কংগ্রেস কলকাতায় হরতালের ডাক দেয়। ওই দিন হরতাল চলাকালীন হাজরার মোড়ে, পুলিশের মতো হেলমেট পরে 'পুলিশের' লাঠি দিয়ে পুলিশের সামনেই সিপিএম মমতার উপর আক্রমণ চালায়। পিছন থেকে লাঠির আঘাত করা হয় সরাসরি মাথায়। আক্রমণ চালানো হয়েছিল খুন করার জন্যই। এক পুলিশ অফিসার রুখে দাঁড়ানোয় অপারেশন ব্যর্থ হয়। এসএসকেএমে যে ডাক্তাররা তাঁকে প্রথমে দেখেছিলেন তাঁদের সঙ্গে আমি পরে কথা বলেছিলাম। তাঁরা বলেছিলেন, একটু এদিক ওদিক হলে ওই দিন মমতার মৃত্যুও হতে পারত। পুলিশ বহুক্ষণ আক্রমণকারীদের পরিচয় গোপন রেখেছিল। বিকেলে মহাকরণে আমরা জ্যোতি বসুকে এই নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'বন্ধ্ বিরোধীরা ওঁকে মেরেছে'। সরাসরি নিজের পার্টির নাম না বললেও সবটাই বুঝিয়ে দিলেন।
মমতা সুস্থ হয়ে ফিরলেন। কিন্তু তত দিনে তিনি বুঝতে পেরেছেন, এভাবে হবে না, দলটাকে নেতৃত্ব দিতে হবে সামনে দাঁড়িয়ে। দলের সভাপতি পদের জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। বিপরীতে দাপুটে সোমেন মিত্র। ১৯৯২ সালের ৮ এপ্রিল মহারাষ্ট্র নিবাস হলে ভোট হল। মমতা হারলেন। কিন্তু তিনি যে লড়াইয়ে আছেন, সেই বার্তা গেল দলের নিচুতলা পর্যন্ত। এল ১৯৯২, ৮জুন। বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল বুথ দখল আর জাল ভোট পড়া। কংগ্রেস নেতাদের কোনও দেখা নেই। মমতা রাস্তায় নামলেন। এজেন্ট তুলে নিয়ে ঘোষণা করলেন তিনি প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। শুরু হল প্রতিবাদ। গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে মমতা যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, পুলিশ গুলি চালাল গড়িয়াহাট মোড়ে। এক পথচারীর মৃত্যু হল। রবীন দেব উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে বিধানসভায় ঢুকতেই তাঁকে 'রিগিং দেব' সম্বোধন শুনতে হল। মমতা বুঝলেন, নির্বাচন কমিশন কঠোর না হলে, সচিত্র পরিচয়পত্র চালু না হলে, স্বচ্ছ নির্বাচন না হলে এই রিগিং আটকানো যাবে না। মমতা আওয়াজ তুললেন 'নো কার্ড নো ভোট'। এই দাবিতে রাজ্য জুড়ে আন্দোলনের ডাক দিলেন। এই দাবিতে ১৯৯২ সালের ২৫ অগস্ট মমতা ব্রিগেডে জমায়েত ডাকলেন। বিপুল জনসমাবেশ করে মমতা প্রমাণ করলেন, তিনিই এই রাজ্যের এক মাত্র বিরোধী শক্তি। সেদিনের সেই ব্রিগেড উপচে পড়া ভিড়ে মমতা বাজালেন সিপিএমের 'মৃত্যুঘণ্টা'।
এই ছিল ১৯৯৩-এর ২১ জুলাইয়ের পরিপ্রেক্ষিত। সেদিনের ২১ জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। সেই মহাকরণ অভিযানের মূল দাবি ছিল, নো কার্ড নো ভোট'। সেদিন চার পাঁচ জায়গায় সমাবেশ হয়েছিল। গুলি চলল, মেয়ো রোড আর এসপ্লানেড ইস্টে।১৩ জন যুবকের মৃত্যু হয়েছিল। প্রায় সবারই গুলি লেগেছিল কোমড়ের উপরে।গুলি চালানো ছাড়া কি কোনও পথ ছিল না সেদিন? টিবোর্ডের সামনের জমায়েত সামলানোর দায়িত্ব ছিল তখনকার ডিসি ট্র্যাফিক চয়ন মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর ওখানে বৃষ্টির মতো ইট পড়েছিল। চয়নবাবু পরে আমাকে বলেছিলেন, তাঁর আত্মজীবনীতেও লিখেছেন, উচ্ছেদ হওয়া হকারদের একটা দল নাগাড়ে ইট ছুড়ে যাচ্ছিল। তাদের সামলাতে লাঠি, টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করতে হয়েছিল। কিন্তু গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। কিন্তু গুলি চলল মেয়ো রোড সহ অন্য জমায়েত কেন্দ্রগুলিতে। ১৩টি প্রাণ লুটিয়ে পড়েছিল। আক্রান্ত হয়েছিলেন মমতাও। অনেকেই মনে করেন, এই হত্যকাণ্ড ঘটিয়ে মমতাকে একটা চূড়ান্ত শিক্ষা দিতে চেয়েছিল সিপিএম। ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২১জুলাই নিয়ে তদন্ত কমিশন গড়েছিলেন। তার রিপোর্ট জমা পড়েছে। আশা করা যায় শীঘ্রই সে রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ হবে। প্রকাশিত হবে প্রকৃত সত্য।