কিংবদন্তিতে ঘেরা আসানসোলের ঘাগরবুড়ির মেলা


মেলা নামটিই নির্দেশ করে অসংখ্য মানুষের মিলনমেলা, যা সাধারণত কোনো উৎসবের রঙে রাঙানো হয়। আর এই উৎসবের আয়োজনের পেছনে কোনও না কোনও কারণ বা উদ্দেশ্য থাকে, যার সিংহভাগই হয় ধর্মীয় - যেমন গাজনের মেলা, বুড়ি মায়ের মেলা, পীরের মেলা ইত্যাদি। আজকাল অবশ্যি প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ মেলাগুলির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি মদতপূর্ণ মেলার সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। সে যে কারণেই মেলা অনুষ্ঠিত হোক, প্রতিটি মেলাই কিন্তু প্রকারান্তরে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে। মেলায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রকমের লোকসংস্কৃতি উৎসব এবং গ্রামীণ শিল্পীদের তাতে যোগদান, মেলাকে অন্য মাত্রা এনে দেয়। স্থানীয় লোকজন ও শিল্পীদের যোগদান স্থানীয় জনপদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে চলে।
ছোটবেলায় পৌষমেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চে কত রকমেরই না অনুষ্ঠান শুনেছি - কবিগান, আলকাপ, লেটো গান, গম্ভীরা, সাঁওতাল নাচ এবং গ্রামীন শিল্পীদের দ্বারা অনুষ্ঠিত যাত্রাপালা ইত্যাদি। এ ছাড়া বাউলের গানের জন্য জয়দেবের মেলা, টুসুর জন্য বাঁকুড়ার মেলা, ভাওয়াইয়া গানের জন্য উত্তরবঙ্গের মেলা ইত্যাদি তো নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী বা ব্র্যান্ড বলা যায়।
অর্থাৎ আমরা বলতে পারি বাংলায় লোকসংস্কৃতির চর্চা আবহমান কাল ধরে তো ছিলই, কিন্তু তা প্রকাশের অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল এই গ্রামীণ মেলাগুলি। কেবল তাই নয়, স্থানীয় হস্তশিল্প এবং শিল্পীরাও বেঁচে থাকতেন এই মেলাগুলির বিকিকিনির মাধ্যমে। অর্থাৎ হস্তজাত শিল্পসামগ্রীকেও এই মেলাগুলিই এক সময় অবলুপ্ত হবার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখত।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে - বাংলার প্রাচীন মেলাগুলির বেশির ভাগই অনুষ্ঠিত হয় শীতকালে। কিন্তু কেন? আসলে বাংলার চিরকালীন কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতিকে ঘিরেই আবর্তিত হত, বাঙালির হাসি-আনন্দ মায় তার কৃষ্টি ও সভ্যতাও। চাষ-আবাদই ছিল বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড। সারা বছর ধরে কৃষকরা ব্যস্ত দু মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য, শস্য বপন, উৎপাদন এবং উৎপাদিত শস্য ঘরে তুলতে তুলতেই তো অগ্রহায়ণ মাস কাবার হয়ে যায়। এই ফসল গোলায় তুলে, উদ্বৃত্ত ফসল বেচে দুটো পয়সা তার ঘরে আসে এই শীতকালেই। তখনই ক্ষণকালের জন্য গ্রামীন অর্থনীতি চাঙ্গা হত, এবং এরই অনুষঙ্গে হত বিভিন্ন গ্রামীণ মেলা।
এরকমই একটি ক্ষণস্থায়ী(মাত্র একদিনের) শীতকালীন মেলা, আসানসোলের কাছে - ঘাগরবুড়ির চণ্ডী মেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর ১লা মাঘ।
ঘাগরবুড়ির চণ্ডীমন্দির যে শুধু অতি প্রাচীন তাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অলৌকিক উপাখ্যান এবং কিংবদন্তি।
এই নিয়ে কথা হচ্ছিল ঘাগরবুড়ি চণ্ডীমাতার সেবাইত, এই মন্দিরের স্বর্গীয় বড় ঠাকুরের পৌত্র সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর সঙ্গে। উনার মুখেই শোনা যাক সেই গা ছমছমে উপাখ্যান।
সে আজ প্রায় ৫০০ বছর আগেকার কথা। আজকের আসানসোল মহানগর তখন ধূ ধূ করা মাঠ এবং আসান গাছের জঙ্গল( আসান হচ্ছে এক ধরনের বৃহৎ উদ্ভিদ, যার ছাল ফুটো করলে বেরোয় প্রচুর সুমিষ্ট পেয় জল আর সল হচ্ছে রাঢ় বাংলার ডাঙ্গাল জমি। তবে দুঃখের বিষয়, এখন আর আসানসোলে আসান গাছ দেখা যায় না, যদিও তামিলনাড়ু ও দক্ষিণ ভারতে পাওয়া যায়।)

জনমানবহীন প্রান্তরে এক-আধটি বাড়ি, দু-তিনটি বাড়ি নিয়ে একেকটি ক্ষুদ্র গ্রাম। এই ছন্নছাড়া গ্রামগুলোতে যজমানি করতেন এক গরীব ব্রাহ্মণ - কাঙালীচরণ চক্রবর্তী। প্রতিদিন তখনকার নুনিয়া নদী(আজকের শীর্ণকায়, খাল সদৃশ, নুনিয়া নয়) পেরিয়ে ওধারের গ্রামগুলিতে যেতেন পুজো অর্চনা করতে, আবার পদব্রজে নদী পেরিয়ে ফিরে আসতেন নিজ বাটিতে। এইভাবেই বহুকষ্টে দিন গুজরান করতেন। কিন্তু তবুও তো সংসার চলে না। এরকমই এক শীতের দিনে - দিনটি ছিল ১লা মাঘ, যজমানের ঘরে পুজো করে সেদিন কিছুই পাওয়া যায়নি। নুনিয়া নদী পেরিয়ে এসে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত কাঙালীচরণ এক গাছতলার শীতল ছায়ার নীচে শুয়ে পড়লেন। কাতর ভাবে ডাকতে লাগলেন মা চণ্ডীকে।
আরও পড়ুন
চন্দ্রাবতী - বাংলার প্রথম মহিলা কবি
কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ কীসের আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। এই জনহীন প্রান্তরে কে যেন লাঠি ঠুক ঠুক করে আসছে না? বুঝতেই পারেননি যে এত বেলা হয়ে গেছে। যখন জেগে ছিলেন তখন সূর্যদেব মাথার ওপরে ছিলেন, আর এখন প্রায় অস্তাচলে।
কিন্তু বাঁশের লাঠির ঠুক ঠুক ছাড়া তো আর কোনো শব্দও শোনা যাচ্ছে না। নুনিয়া নদীর গর্জনও থেমে গেল কী করে, আশ্চর্য!
একি! দিনের আলো তো এখনও আছে, অথচ কিছুটা জায়গা একদম অন্ধকার কেন? তবুও তো সেই অন্ধকারের মধ্যে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে - এক ঘাগরা পরিহিত বুড়ি ঠুক ঠুক করতে করতে বাঁশের লাঠি নিয়ে উনার দিকেই তো এগিয়ে আসছেন। সেই বুড়ি কিছু না বলে কাঙালীচরণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঙালীচরণের চোখ যেন ঝলসে গেল, সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ ঝলক বয়ে গেল। ব্যস, আর কিছু মনে নেই। ঘুমের অতলে ডুবে গেলেন। ঘুমের মধ্যেই দেখলেন সেই বুড়িকে আবার। পরিষ্কার শুনতে পেলেন – ‘তোর আর উঞ্চবৃত্তির দরকার নেই, তোর কোলেই দেখবি তিনটি ছোট পাথরের ঢিবি রেখে এসেছি। মাঝখানে আমি - মা ঘাগরবুড়ি, আমার বাঁয়ে মা অন্নপূর্ণা, ডাইনে পঞ্চানন মহাদেব। এইখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা কর, আর কোথাও যেতে হবে না।’
মা ঘাগরবুড়ির আদেশে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৬২০ সালে।এই পাথরের ঢিবিগুলিকেই ফুল এবং রুপোর গয়নায় সাজানো হয়।
আর সেই ১৬২০ সালের ১লা মাঘকে স্মরণ করে প্রতি বছর মন্দিরের সামনের মাঠে বসে ঘাগরবুড়ি চণ্ডীমাতার মেলা।

এই মেলার একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, আসানসোলের মতন বৃহৎ শহরের এত নিকটে হয়েও, এই মেলা তার গ্রামীণ চরিত্রকে এখনও ধরে রেখেছে। অন্য যে কোনও গ্রামীণ মেলার সঙ্গে এই মেলার কিছু মাত্র তফাৎ চোখে পড়বে না। কিন্তু আছে, এই মেলার একটি বিশেষ চরিত্র আছে। এখানে আগত গ্রাম এবং শহরের লোকজনদের মধ্যে অন্তত ৫০% ঝাড়খন্ড, বিহার, ওড়িশার। আসলে কয়লা এবং শিল্পাঞ্চল হবার কারণে আসানসোলের জনবিন্যাস এরকমই, ক্ষুদ্র ভারতবর্ষ বলা যায়। তাই স্বচ্ছন্দে ঘাগরবুড়ির মেলাকে ভারতের সর্বজনীন মেলা হিসাবে গণ্য করাই যেতে পারে