No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    হিন্দু-মুসলমানের ভালোবাসায় পবিত্র ফুরফুরা শরিফ

    হিন্দু-মুসলমানের ভালোবাসায় পবিত্র ফুরফুরা শরিফ

    Story image

    হুগলি জেলার ছোট্ট এক গ্রাম। মুসলিমদের কাছে পবিত্র জায়গা হলেও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ পাড়ি দেন সেখানে। ধর্মীয় শিক্ষার পীঠস্থান হিসেবেও বিখ্যাত। ফরায়েজি আন্দোলনের প্রবক্তা হাজি শরিয়তুল্লাহ উচ্চশিক্ষার জন্য মক্কায় যাওয়ার আগে আরবি, ফার্সি ভাষার পাঠ নিয়েছিলেন এখানে। সম্প্রতি ভোটের আবহে বারবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসছে গ্রামটির নাম – ফুরফুরা শরিফ।

    এমন নাম কীভাবে হল, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কেউ বলেন ফার্সি শব্দ ‘ফুরফুরা’ থেকে জায়গায় নাম এসেছে, যার অর্থ ‘শান্ত হাওয়া’। কারও মতে ‘ফরাহ’ (জাঁকজমক) আবার অন্য এক মতে ‘ফরফর’ (দ্রুত ছোটা) থেকে নামকরণ হতে পারে। এক সময় ফুরফুরা শরিফ এবং আশেপাশের গ্রামগুলির নাম ছিল বলিয়া-বাসন্তী। শাসন করতেন বাগদি রাজারা। পরে সুলতানি প্রশাসনের অধীনে চলে যায় গোটা অঞ্চল।  ১৩৭৫ সালে মুকলিশ খান একটি মসজিদ গড়ে তোলেন ফুরফুরা শরিফে। দেশ-বিদেশে এই গ্রাম বিখ্যাত হয়ে ওঠে মহম্মদ আবু বকর সিদ্দিকি এবং তাঁর ৫ ছেলের আমলে।

    ফুরফুরা শরিফ গ্রামে আব্দুল মুক্তাদির সিদ্দিকির ঘরে ১৮৪৫ সালে জন্মগ্রহন করেন মহম্মদ আবু বকর সিদ্দিকি। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকরের বংশধর তাঁরা। স্থানীয় মানুষেরা এই পরিবারকে খুব সম্মান করেন। মহম্মদ আবু বকর সিদ্দিকি ছিলেন পড়াশোনায় খুব মেধাবী। হুগলি সদর শহরের মুহসিনিয়া মাদ্রাসা থেকে জামাতে উলা ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কলকাতায় হাদিস, তফসির, ফিকাহ শাস্ত্র চর্চা করে ১৮৯২ সালে চলে যান আরবে। চল্লিশটি হাদিস গ্রন্থের সনদ লাভ করেন মদিনায়। ইসলামের সেরা সেরা পণ্ডিতের থেকে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। দেশে ফিরে আসার পর পির হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। মোজাদ্দেদ জামান উপাধিতে সমাদৃত ছিলেন। সবার কাছে পরিচিত হন দাদা হুজুর পির কেবলা নামে। 

    তখন মুঘল কিংবা নবাবি আমলের গৌরব পুরোপুরি অস্তাচলে। ব্রিটিশদের শোষণে ভেঙে পড়েছে গ্রামীণ সমাজ এবং অর্থনীতি। মুসলমান সমাজের বড়ো অংশই বুঝতে পারছিলেন না, এগোতে হবে কোন পথে। দাদা হুজুর তাঁদের দেখালেন নতুন দিশা। আরবি, ফার্সি, উর্দুর বদলে ইসলামি শিক্ষাদানের ভাষা হিসেবে বেছে নিলেন বাংলাকে। তাঁর উৎসাহ এবং সহায়তায় ‘মুসলিম হিতৈষী’, ‘সোলতান’, ‘মোসলেম দর্পণ’, ‘শিখা সওগাত’-এর মতো বাংলা পত্রপত্রিকা চলত।  

    এরই সঙ্গে দাদা হুজুর ছিলেন সমাজ সংস্কারক এবং রাজনীতিক। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা, বিনামূল্যের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। প্রচুর মাদ্রাসা, ছাত্রদের জন্য বোর্ডিং, মেয়ের জন্য স্কুলও গড়ে তোলেন। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ না করে নিঃস্বার্থভাবে চালিয়ে যেতেন সেবা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। তবে বিদেশি জিনিস বয়কট নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের নীতি পছন্দ ছিল না তাঁর। এই নিয়ে কলকাতায় মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ফজলুক হক, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো নেতারা যেতেন তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে। মুসলিম লিগকে খুব একটা পছন্দ করতেন না দাদা হুজুর। একই সঙ্গে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন আজীবন।

    দাদা হুজুর আবু বকর সিদ্দিকি প্রয়াত হন ১৯৩৯ সালে। বাংলা, বিহার, অসমের নানা জায়গায় ছিলেন তাঁর ভক্ত-শিষ্যরা। কেবল মুসলিম নয়, বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর অনুগামী হয়ে ওঠেন। তাঁর ৫ ছেলেও নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন।

    দাদা হুজুরের মাজারে জমায়েত হন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রত্যেক বছর ফাল্গুন মাসে পিরের মেলা উপলক্ষ্যেও প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। পিরের বংশধরেরা আজও মানুষের সেবায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। আপনিও ঘুরে আসতে পারেন ফুরফুরা শরিফ। গ্রামীণ বাংলা অপরূপ মায়া নিয়ে ধরা দেবে আপনার চোখে। ট্রেনে যেতে চাইলে হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইন ধরে নামতে হবে বলরামবাটী স্টেশনে। কিংবা কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে অহল্যাবাই হোলকার রোড হয়ে ডানকুনি পেরিয়ে ফুরফুরা শরিফ পৌঁছে যেতে পারেন।

    তথ্যঋণ –সৌমিত্র দস্তিদার, জাফরুল হক। 
    ছবিঋণ – ফুরফুরা শরিফের ফেসবুক পেজ। 

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @