‘সীমান্ত গান্ধী’-র ছেলে ভর্তি হলেন কলাভবনে, আব্দুল গফফারকে বুকে টেনে নিলেন রবীন্দ্রনাথ

বোলপুর স্টেশনে ছোটখাটো জটলা। প্ল্যাটফর্মে রবীন্দ্রনাথ। সবাই ভাবছে, কবি হয়তো যাচ্ছেন কোথাও। কিন্তু কলকাতাগামী গাড়ি তো একটু আগেই ছেড়ে গিয়েছে। কবিকে শুধোতেই মিষ্টি হেসে বলেন, না তিনি কোথাও যাচ্ছেন না। তাহলে? অপেক্ষা করছেন অতিথির। কে এই ‘অতিথি’, যাঁর জন্য ৭৩ বছরের বৃদ্ধ সাতসকালে প্ল্যাটফর্মে ঠায় দাঁড়িয়ে? কৌতূহলের পারদ ফেটে পড়ছে জনতার।
এমন সময় বর্ধমানের দিক থেকে একটা ট্রেন এসে দাঁড়াল। তৃতীয় শ্রেণীর কামরা থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে পা রাখলেন ৪৪ বছরের যুবক। দীর্ঘদেহী, প্রশান্ত একজন মানুষ। গুরুদেব তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। যুবকের পরিচয় জানতে পেরে চমকে ওঠে সবাই। খান আব্দুল গফ্ফার খান। ওরফে বাচা খান। আপামর বঙ্গবাসী যাঁকে চেনে ‘সীমান্ত গান্ধী’ নামে।
তখন তিরিশের দশক। গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত বাচা খান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ। প্রায় একলাখ পাশতুনদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘খুদা-ই-খিদমতগার’। মহাত্মার সত্যাগ্রহ এবং হজরত (সাঃ)-র ‘রহমত’ (ক্ষমা) হাতিয়ার হয়ে উঠছে ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আফগান মানুষকে বাচা খান এক নতুন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। যেখানে ধর্মের নামে হানাহানি নেই। দারিদ্র নেই। শান্তি আছে। সেই ‘শান্তিনিকেতনের’ কথাই তো তিনি শুনেছিলেন গান্ধীজির কাছে। বোলপুরের আশ্রমে তাই পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিলেন নিজের জ্যেষ্ঠপুত্র আব্দুল গনিকে। বাবার মতই স্বভাব পেয়েছিল ছেলে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে সে। তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন নন্দলাল বসু। কলাভবনের আনাচে-কানাচে এখনো গনির ভাস্কর্য দেখা যায়।
রানী চন্দের লেখাতেও মিলবে, ‘গনি’-র কথা।
“...পেশোয়ারি ছেলে, গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। সে বসে বসে ‘ওয়াশ’ ‘টেম্পেরা’র ছবি করবে কী? দুদিনে অধৈর্য হয়ে উঠল। গনি তুলি-কাগজ ছেড়ে মোটা দেখে বড়ো বড়ো কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে বসে গেল দুহাতে দুই হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে। দমাদ্দম সে বাটালির মাথায় হাতুড়ি পিটত, বড়ো বড়ো কাঠের চিলতে কেটে ফেলত, আর হাসত। হাসিমুখ ছিল গনির। নন্দদা (আচার্য নন্দলাল বসু) বললেন, গনি এটাই করুক, কাঠ কাটুক, পাথর ভাঙুক। আমাদের ছেলেরা এ-কাজে এগোতে চায় না। এভাবে কাঠ কেটে গনি অনেক কিছু করেছিল। ‘ফিনিশিং’য়ের দিকে ততো মন ছিল না, গড়নটি ভাবটি এসে গেলেই সে খুশি হয়ে সেটা ছেড়ে আরেকটা কাঠ ধরত। নন্দদা খুব সন্তুষ্ট ছিলেন তার কাজে।”
১৯৩৮ সালে হাজারিবাগ জেল থেকে মুক্তি পেয়েই বোলপুর এলেন খান সাহেব। ছিলেন মাত্র একদিন। তাঁর জন্য বাংলা হরফে লেখা উর্দু ভাষণ পাঠ করেছিলেন কবি, “থোরেসে অরসেকে লিয়ে আপ হমারে লিয়ে ইঁহা তশরিফ লায়ে হৈ...” বাচা খানও আজীবন ভোলেননি শান্তিনিকেতনকে। রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর আদর্শর সঙ্গে মিশে যায় গুরুদেবের বিশ্বমানবতার ডাক। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর পেয়ে পেশোয়ার থেকে কবিপুত্রকে লিখছেন, “... In him India has truly lost the greatest philosopher, and a nationalist.”
আব্দুল গাফফার খান আর একবারই এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। বয়স প্রায় তখন আশির কাছাকাছি। ততদিনে তাঁর বুকের উপর দিয়ে ভাগ হয়ে গিয়েছে দেশ। খুন হয়েছেন প্রাণের চেয়েও প্রিয় মহাত্মা। পাকিস্তানে জিন্না এবং ভুট্টোর আমলেও একাধিকবার তাঁকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। রাষ্ট্রের চোখে তখন তিনি ‘বিশ্বাসঘাতক’। ১৯৬৪ সালে আফগানিস্তানের জালালাবাদ বলে ছোট্ট একটা গ্রামে স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন। লড়তে লড়তে ক্লান্ত মানুষটি এখানেই কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলি।
ভাঙা মন নিয়েই খানসাহেব এসেছিলেন শান্তিনিকেতন। ঘুরছিলেন ভুবনডাঙার সাঁওতাল পল্লীতে। ঘরে ঘরে জিজ্ঞেস করছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে কেমন আছেন আদিবাসীরা? দোভাষীর মুখ থেকে উত্তর শুনে তিনি বাক্যহারা। এমন স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলেন?
বিচিত্রায় একটি কাঠের মানবমূর্তির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন বৃদ্ধ। চোখ ভরে আসে জলে। এ তো তাঁর পুত্রের কীর্তি... যে ছেলেকে আপন করে নিয়েছিল এই শিক্ষাঙ্গন, এই মাটি। বুকে টেনে নিয়েছিল।
সীমান্ত না মানতে পারা ‘সীমান্ত গান্ধী’, আজকের ভূখণ্ডকে দেখলে কী ভাবতেন কে জানে! দেশভাগের সময় থেকেই ভারত-পাকিস্তান দুটি দেশে জমা হয়েছে উজাড় করা ঘৃণা আর বিদ্বেষ। ধর্মের বেড়াজালে মুছে যাচ্ছে গুরুদেব-মহাত্মার সম্প্রীতির আদর্শ। রাষ্ট্রীয় সীমানার ভিতরেও গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য কাঁটাতার। রবীন্দ্রনাথ চাননি তাঁর বিশ্বভারতীতে এত সীমারেখা থাকুক, বাচা খানও কি চেয়েছিলেন? সেই চাওয়া-না-চাওয়ায় অবশ্য ইতিহাস বদলাবে না আর। দগদগে ক্ষতর ইতিহাস যে এত সহজে বদলানো যায় না, আজ জীবিত থাকলে তা অবশ্যই বুঝতেন রবীন্দ্রনাথ এবং বাচা খান।
ঋণ: শিবানন্দ পাল, ‘সব হতে আপন’, রানী চন্দ