No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বিশ্বভারতী হবে বিশ্বের প্রথম হেরিটেজ বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমান শিক্ষা-গবেষণার মান কেমন?

    বিশ্বভারতী হবে বিশ্বের প্রথম হেরিটেজ বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমান শিক্ষা-গবেষণার মান কেমন?

    Story image

    সিংহ সদন

    বির প্রয়াণের এক বছর আগে, ১৯৪০ সালে শেষ যে বার গান্ধীজি শান্তিনিকেতনে আসেন, বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হয়। গান্ধীজির বিদায় নেওয়ার দিন (১৯ ফেব্রুয়ারি) কবি এক চিঠিতে অনুরোধ জানান, তাঁর অবর্তমানে গান্ধীজি যেন বিশ্বভারতীর প্রতি দৃষ্টি রাখেন; পত্রোত্তরে যথাসাধ্য সাহায্য করার আশ্বাস দেন গান্ধীজি। কবির চিঠিটি তিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে দেখান এবং স্বাধীন ভারতে মৌলানা আজাদ যখন শিক্ষামন্ত্রী, তাঁকে আবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই সূত্রে ও কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের আন্তরিক আগ্রহে ১৯৫১ সালে ভারতের প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেল বিশ্বভারতী; আচার্য হলেন জওহরলাল নেহরু, উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আচার্য হওয়ায় আর্থিক সমস্যার সমাধানও অনেক সহজ হয়ে এল।

    শান্তিনিকেতনে গান্ধীজি এবং রবীন্দ্রনাথ

    ১১ অক্টোবর ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ লস এঞ্জেলেস থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে, ওইখানে সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। স্বাজাতিক সঙ্কীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে, “ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে। ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত করে তুলব এই আমার মনে আছে— সর্বমানবের প্রথম জয়ধ্বজা ঐখানে রোপণ হবে।”

    বিশ্ব মানবতার সঙ্গে শিক্ষাকে একীভূত করার লক্ষ্যে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা। তাঁর ভাবনায় ছিল, “পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”

    এখন প্রশ্ন হল হাজার অরাজকতার মধ্যে ইউনেস্কোর হেরিটেজ মুকুট পরতে চলেছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বিশ্বভারতী। পারবে বিশ্বজনীন রূপ পেতে? বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের কথাতে তা পরিষ্কার। তিনি বঙ্গদর্শন.কম-কে বলেন, “এসব স্বীকৃতি বাইরের জিনিস। বিশ্বভারতীর শিক্ষা আর গবেষণার মান আরও উন্নত না হলে কিছু হবে না।‘’

    শান্তিনিকেতন গৃহ

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শীঘ্রই ইউনেস্কো-এর তরফে ‘হেরিটেজ’ স্বীকৃতি পেতে চলেছে। বিশ্বভারতী হবে বিশ্বের প্রথম হেরিটেজ বিশ্ববিদ্যালয়। আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়া বাকি সব কিছুই করা হয়েছে। ওই বৈঠক সম্ভবত এপ্রিল বা মে মাসে হবে। সাধারণত একটি স্মৃতিস্তম্ভকে হেরিটেজ ট্যাগ দেওয়া হয়। বিশ্বে এই প্রথমবারের মতো, একটি জীবন্ত বিশ্ববিদ্যালয় যা পুরোদমে কাজ করছে, তাকে ইউনেস্কো থেকে হেরিটেজ স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। ১৯২১ সালে ১১৩০ একর জমিতে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯২২ সালের মে মাসে বিশ্বভারতী সোসাইটি একটি সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত না হওয়া পর্যন্ত এটি নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামেই ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কিছু সম্পত্তি, জমি এবং একটি বাংলো সেই সময়ে বিশ্বভারতী সোসাইটিকে দান করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এটি একটি কলেজ ছিল এবং ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিতীয় উপাচার্য ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ঠাকুরদা।

    শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, “এসব স্বীকৃতি বাইরের জিনিস। বিশ্বভারতীর শিক্ষা আর গবেষণার মান আরও উন্নত না হলে কিছু হবে না।

    দেশবিদেশ থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী একসময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রাক্তনীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়, জয়পুরের রানি তথা কোচবিহারের রাজকন্যা গায়েত্রীদেবী, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ। আর এক কৃতি প্রাক্তনী সংগীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ী। তাঁর গলাতেও উদ্বেগ। সাহানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “স্বীকৃতি যথার্থ, এবং আমরা যাঁরা ওখানে পড়েছি, তাঁদের কাছে খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেগাসি কি যথার্থই বহন করছে বিশ্বভারতী, বিশেষত এই সময়ে? আমাদের অনেকের কাছে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজাটাই নৈতিক দায়িত্ব। বিশ্বজনীন রূপ পেতে হলে শুধুমাত্র ইউনেস্কোর ছাপ্পা থাকলেই হয় না। যথার্থ বিশ্বজনীন হতে হয়।”

    রামকিংকর বেইজ নির্মিত সাঁওতাল পরিবার

    ঘণ্টাতলা

    শুধু বিশ্বভারতীর একজন কৃতি প্রাক্তনী এই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা নয়, খোদ উপাচার্যর ভিডিও ঘিরে কিছুদিন আগে বিতর্ক ছড়ায়। ফের বিতর্কে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুত্‍ চক্রবর্তী। কিছুদিন আগে একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। ওই ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, “বিশ্বভারতী আজ পশ্চিমবঙ্গ ভারতী বা বোলপুর ভারতী হয়ে গেছে। এটা হতে দেওয়া হবে না।” এই ভিডিও-র সত্যতা যাচাই না করে একটা কথা বলাই যায় যে বিশ্বভারতী তার গরিমা হারিয়েছে। একটা কথা মাঝে মধ্যে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, যার নাই কোনও গতি, সে ঠাঁই নেয় বিশ্বভারতী। অর্থাৎ পড়ুয়াদের মধ্যে যাদবপুর বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যে আকাঙ্খা তা বিশ্বভারতীতে পড়ার ক্ষেত্রে একেবারে নেই বললেই চলে। কেন?

    সাহানা বাজপেয়ী জানান, “স্বীকৃতি যথার্থ, এবং আমরা যাঁরা ওখানে পড়েছি, তাঁদের কাছে খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেগাসি কি যথার্থই বহন করছে বিশ্বভারতী, বিশেষত এই সময়ে?

    পড়াশোনার মান নেমে যাওয়াই নয়, শোনা যায় ল্যাব থেকে জিনিসপত্র চুরি গেছে। রবি ঠাকুরের নোবেল চুরি লজ্জার হলে বিশ্বভারতীর এই হাল কম লজ্জা বহন করে না। কিছুদিন আগের ঘটনা। হয়তো পরের পর এমন ঘটনায় লজ্জায় মুখ লুকাবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতীরা। ছাত্র আন্দোলনে হুলস্থূল হয় কবিগুরুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। টানা অবস্থান মঞ্চ, মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ, উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে ব্যাঘাত। এভাবেই দিন কেটেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। আন্তর্জাতিক সম্মানে সমৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এই ধরনের ছাত্র আন্দোলন, কী বলছেন উপাচার্য?

    কালোবাড়ি

    উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বাড়ির কিছুটা দূরেই সভামঞ্চ করে অবস্থান করে আসছিলেন আন্দোলনকারীরা। কেন আন্দোলন? অবস্থান-আন্দোলনের এক নেত্রী বলেন, “আমাদের একাধিক দাবি আছে, দ্রুত রেজাল্ট প্রকাশ করা, স্কলারশিপ, হস্টেলের খালি সিটগুলো ফিলাপ করা, বিশ্বভারতীতে যে অরাজকতা চলছে তা বন্ধ করা। এখানে দেখছি উপাচার্যের বিরোধিতার স্বর যাঁদের, তাঁদের বেছে বেছে চিহ্নিত করে শিক্ষক, কর্মী বা ছাত্র হোক; সকলকেই হেনস্থা করা হচ্ছে। যত দিন পর্যন্ত আমি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না ততদিন আমার কোনও সমস্যা ছিল না। আমাকে একবার শোকজ, একবার হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টকে দিয়ে সিবিআইয়ের নামে ভয় দেখিয়ে চিঠি, পরবর্তীতে রিসার্চে যখন প্রি-সাবমিশন আবেদন করি, সেটাকে নানা বানান ভুল দেখিয়ে দেরি করা হচ্ছে।”

    আর এক অরাজকতার নাম পাঁচিল ভাঙা। এমন অরাজকতা বিশ্বভারতীর ইতিহাসে কখনও হয়নি। ২০২০ সালের ঘটনা। এমন তাণ্ডবের সাক্ষী কখনও থাকেনি রবীন্দ্রনাথের সাধের শান্তিনিকেতন। পরিবেশ আদালতের নির্দেশের পর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে ঐতিহ্যবাহী পৌষ মেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘেরার কাজ শুরু হয়। তারই প্রতিবাদে কয়েক হাজার মানুষ ক্যাম্পাসে ঢুকে ভেঙে দিয়েছেন বিশ্বভারতীর গেট। অস্থায়ী ক্যাম্প অফিস ভেঙে চুরমার করার পাশাপাশি লুট করা হয় নির্মাণসামগ্রী। এমনকি, জেসিবি মেশিন নিয়ে এসে বহিরাগত হামলাকারীরা ভাঙচুর করলেন রবীন্দ্র প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি।

    একটা পাঁচিল ভাঙার ঘটনা, আন্দোলন, আগের মতো গৌরবময় ফ্যাকাল্টি না থাকা- এসবকে কেন্দ্র করে যেভাবে কলুষিত হয়েছে বিশ্বভারতীর মুখ, তা আদতেই কতটা উজ্জ্বল হবে ইউনেস্কোর দেওয়া স্বীকৃতিতে? প্রশ্ন উঠছে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে।

    ____

    প্রচ্ছদের ছবি: সুমন সাধু, অন্যান্য ছবি: ইন্টারনেট

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @