No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    গুপী-বাঘা থেকে বল্লভপুরের রূপকথা : বাংলা ‘হরর কমেডি’র ভূত ও ভবিষ্যৎ

    গুপী-বাঘা থেকে বল্লভপুরের রূপকথা : বাংলা ‘হরর কমেডি’র ভূত ও ভবিষ্যৎ

    Story image
    মাত্রা বোঝার ব্যাপারে সত্যজিৎ পরবর্তী সময়ে নির্মাতারা সর্বদাই গোলমাল করেছেন, যে কারণে সহজেই যে ফর্মুলাতে মজার ছবি নির্মাণ করা যায় ও দর্শকদের হলমুখী করা যায়, তা কিন্তু সচরাচর দেখা যায়নি।

    ভৌতিক বা অতিভৌতিকের ভিতর হাস্যরসের খোঁজ এবং তা নিয়ে বানানো ছবি, সর্বদাই বাঙালির জন্য সহজপাচ্য ও উপভোগ্য। সেভাবে দেখতে গেলে আমাদের উপমহাদেশের পূর্বে ও দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের যে জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিকাঠামো, বিভিদ রকমের কথকতা, পদ বা পালা দিয়েছে, তাতে বহু ক্ষেত্রে প্রেতযোনিকে বর দানকারী ত্রাতা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। ভূতের বর বা ভূতের রাজা প্রদত্য বর সংক্রান্ত একটা চাপা উত্তেজনা বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখার রসদ যুগে যুগে জুগিয়ে এসেছে এবং প্রেতযোনিকে ঘিরে ঘটনায় হাস্যরসের ওপর ভিত্তি করে যে সব ছবি তৈরি হয়েছে, তা সর্বদাই দর্শকের স্নেহভাজন হয়েছে। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’-ও (২০২২) তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এত কী খাতির বাঙালি দর্শকের প্রেতযোনির সঙ্গে? সেটাই একটু বোঝবার চেষ্টা করবো এই লেখায়।

    গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে ভূতেদের নাচ

    এই দিয়ে সেখা‘হরর’ (Horror) ব্যাপারটাকে উড়িয়েনে সেই প্রেতযোনিকে আশার আলো হিসেবে দেখানোর ব্যাপারটা সেই সত্যজিৎ রায়ই প্রথমবার ব্যবহার করলেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ  (১৯৬৯)। বাংলা সাহিত্যের রূপকথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেতযোনি ছাড়া অসম্পূর্ণ এবং বারংবার সেই প্রেতযোনির কীর্তিকলাপের উল্লেখ আমরা পেয়েছি। লালকমল নীলকমল ভেবে দেখুন, সারা গল্পটা রাক্ষস খোক্কশের ভয়ে জর্জরিত, কিন্তু নিষ্পত্তির কাছাকাছি এসে আমরা উল্লেখ পাই জটি বুড়ির, যে কিনা নিদ্বির্ধায় লোহার কলাই চিবিয়ে খেতে পারে। গুপী-বাঘার ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই, বাঁশ বন ভরা এক গাদা ভূত তাদের নৃত্য পরিবেশন করে মনোরঞ্জন করে এবং সব শেষে তাদের রাজা, গুপী-বাঘাকে তাদের জীবনের সেরা পাওনাটা দেয়, তিনটি বর। মনে রাখতে হবে এখানে এই তিনটি বরের উল্লেখ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির লেখা মূল গল্পে থাকলেও সত্যজিতের সিনেমায় তা কিন্তু একটা রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট। কুড়ি বছর পেরিয়ে ভারতবর্ষ তখন যুবক বা যুবতী এবং সেখানে দারিদ্র অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। দেশে বিভিন্ন ডামাডোলের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তখন খাদ্যাভাব। তার পাশাপাশি, আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ক্রমাগত আমাদের ওপর বিভিন্নভাবে আকরমণ করে চলেছে কাশ্মীর লাভের আশায়। সেই সময় গুপী গাইন-বাঘা বাইনের মতো কাজ কিন্তু শুধুমাত্র বক্স অফিসে সারা ফেলবার চেষ্টা নয়, বরং একটি মজার রূপকথার মধ্যে, বৃহত্তর রাজনৈতিক সমস্যা ও তার নিষ্পত্তির রূপকথার গল্প হয়ে ওঠে। এবং তা কিন্তু মূল ফিল্মের ন্যারেটিভে অত্যন্ত অন্তরীন ভাবেই থাকে, কখনোই ন্যারেটিভ ছাপিয়ে মূল হয়ে দাঁড়ায় না। এই মাত্রা বোঝার ব্যাপারে সত্যজিৎ পরবর্তী সময়ে নির্মাতারা সর্বদাই গোলমাল করেছেন, যে কারণে সহজেই যে ফর্মুলাতে মজার ছবি নির্মাণ করা যায় ও দর্শকদের হলমুখী করা যায়, তা কিন্তু সচরাচর দেখা যায়নি।

    পাতালঘর

    ‘হরর’ ব্যাপারটাকে উড়িয়েনে সেই প্রেতযোনিকে আশার আলো হিসেবে দেখানোর ব্যাপারটা সেই সত্যজিতই প্রথমবার ব্যবহার করলেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ  (১৯৬৯)। বাংলা সাহিত্যের রূপকথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেতযোনি ছাড়া অসম্পূর্ণ এবং বারংবার সেই প্রেতযোনির কীর্তিকলাপের উল্লেখ আমরা পেয়েছি।

    এক্ষেত্রে ‘পাতালঘর’ (২০০৩) ছবির উল্লেখ সহজেই চলে এসে। এই ছবিতে সেইভাবে প্রেতযোনির উল্লেখ না থাকলেও ভীতি, হাস্যরস ও রহস্য ছিল নির্মাণের মূল উপাদান এবং সেই কারণেই হয়তো নির্মাতারা ভিনগ্রহের মানুষ ভিককে, মার্কিন পরিচালক রিডলি স্কটের ‘এলিয়ান’ (১৯৭৯) ফিল্মের বীভৎস জন্তুটির মতো দেখতে না করে তাকে অলস, খাদ্য বিলাসী ও বোকা প্রাণী হিসেবে দর্শকের সামনে পেশ করে। ‘পাতালঘর’ বানানোর ক্ষেত্রে নির্মাতারা যত না বেশি মূল গল্পের প্রতি যত্নবান ছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি তাঁরা মন দিয়েছিলেন দৃশ্যপট নির্মাণে। সেই নির্মাণের ক্ষেত্রে সত্যজিতের নান্দনিকতার প্রতি তাঁদের আনুগত্য সাংঘাতিকভাবে চোখে ধরা পরে। অর্থাৎ সেভাবে দেখতে গেলে শুধুমাত্র ভয় ভূত আর রহস্য নয়, সত্যজিতের নান্দনিকতাও একরকমভাবে দর্শক আকর্ষণের ক্ষেত্রে কার্যকরী। যদিও দুর্বল মার্কেটিং-এর ফলে রিলিজের সময় খুব একটা উন্মাদনা তৎকালীন দর্শকের কাছ থেকে দেখা যায়নি ‘পাতালঘর’-এর জন্য।

    বাঙালি দর্শকের ডিজায়ার বুঝতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে বাংলার প্রযোজককুল এবং সেই আকুতি যেন আবার বুঝতে পারলেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। তাই ছবির একদম শুরুতেই সে স্বীকারক্তি আমরা শুরুর ক্রেডিট সিক্যুয়েন্সে দেখতে পাই। শুরুতেই বলা হচ্ছে বহুলরকম গল্প নিয়ে ছবি বানিয়েও মানুষকে অতিমারীর পরে কোনোকিছুই যেন স্বতঃস্ফুর্তভাবে হলের দিকে টানছিল না। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ মুক্তির পরে এইভাবে হইহই করে হল ভরানোর নজির বহুদিন বাংলা ছবির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছিল না (অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’-র ক্ষেত্রেও এই একই ছবি দেখা গিয়েছিল)। এখান থেকে একটা কথা আবার প্রমাণিত হল যে, সিনেমা দেখতে এসে একরম প্যাকেজ ডিজায়ার করে দর্শক। এই ডিজায়ারের গল্প বোধহয় মেমোরি (Memory) বা মনের কোণে লুকিয়ে থাকা পূর্ব উপভোগ্য আনন্দকে আবার উপভোগ করার সঙ্গে সম্পর্কিত। একবার কোনো জিনিস উপভোগ করলে তা বারবার করে অনুভব করতে ইচ্ছে করে। সেই জোড়ালো মেমোরি তৈরি করে গিয়েছেন ভারতীয় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পূর্বসুরি পরিচালকেরা। সেই তালিকা খুব একটা ছোটো নয়। কিন্তু সেই ফর্মুলা হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও কেউ আগবাড়িয়ে “হরর কমেডি”-কে রসদ করে ফিল্ম বানাচ্ছিলেন না। প্রশ্ন জাগে সেটা কি “হরর কমেডি”-কে নিয়ে মৌলিক ভাবনার অতি রাজনৈতিক উদযাপনের ফলে?

    ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ মুক্তির পরে এইভাবে হইহই করে হল ভরানোর নজির বহুদিন বাংলা ছবির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছিল না (অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’-র ক্ষেত্রেও এই একই ছবি দেখা গিয়েছিল)। এখান থেকে একটা কথা আবার প্রমাণিত হল যে, সিনেমা দেখতে এসে একরম প্যাকেজ ডিজায়ার করে দর্শক।

    ভূতের ভবিষ্যৎ

    অনীক দত্তের ‘ভবিষ্যতের ভূত’ (২০১৯) এই ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করতে পারে। প্রথম ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ (২০১২) লৌকিক (এক্ষেত্রে অর্গ্যানিক) সাফল্যের ফলে হয়তো পরিচালক অনীক দত্ত ভেবে বসেছিলেন, বাঙালি দর্শক অতি রাজনৈতিকতা উস্কে দেওয়াকে সাদরে গ্রহণ করবেন, কিন্তু আমাদের রাজ্যের বর্তমান সরকার বাহাদুরকে সরাসরি আক্রমণ করায়, তা দর্শকের ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এবং তার পরেই আসে অতিমারী। কিন্তু আজকের ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে কোনো ছবি দেখা মানুষের পক্ষে কঠিন কাজ নয় (এবং তার সাক্ষ বহন করে পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপের ফিল্ম কেরিয়ার)। তবে পরবর্তীকালেও সেই জোয়ার কিন্তু ‘ভবিষ্যতের ভূত’-এর  জন্য দেখা যায়নি। যে মুনশিয়ানার পরিচয় এবং আশার আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, অনীক দত্তর প্রথম কাজে, সেই আলোই যেন নির্বাণ প্রাপ্ত হল, সেই ফিল্মের দ্বিতীয় কিস্তিতে। অর্থাৎ বাঙালি (মূলত কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত জনতা) দর্শকের ডিজায়ারের গল্প সেইভাবে দেখতে গেলে বলে, সহজভাবে দেখাও, বেশি জ্ঞান কপচিও না।

    এই জ্ঞান দিয়ে ফেলার প্রবণতায়, সেভাবে দেখতে গেলে নির্মাতার ভাবনার প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নও চলে আসে। প্রশ্ন জাগে, যে ছবিটি নির্মিত হল, সেটি কার। বড়ো ঘটা করে নির্মাতার নাম থাকলেও, সেই ছবি কিন্তু আদতে জনগণের এবং তা প্রমাণিত হল ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ দেখতে গিয়ে, হলে জনতার উপচে পড়া জোয়ার দেখে। এই ছবিতে বাংলা সিনেমা জগতের একটিও চেনা মুখ নেই, তা সত্ত্বেও এই জোয়ারের মূলে বোধহয় ভূত, অলৌকিকতা আর হাস্যরসের মিশেল। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’  নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে পড়ে যায় বাঙালির অতি পছন্দের হরর কমেডি ‘চার মূর্তি’ (১৯৭৮)। টেনিদার ভীতিকে রসদ করে অনেক কম খরচে বানানো একটি ছবি। সেখানে তবুও কিছু তারকাদের দেখা গিয়েছিল, যেমন টেনি মুখুজ্জ্যের ভূমিকায় চিন্ময় রায়, শেঠ ছগনলালের ভূমিকায় রবি ঘোষ এবং স্বামী ঘুটঘুটানন্দের ভূমিকায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বল্লভপুরের ক্ষেত্রে সেই তারকা আসনে বসে খোত পরিচালক নিজে এবং তাকে ঘিরেই উত্তেজনা তুঙ্গে। কারণ তাঁর অভিনয়ে গুণমুগ্ধ বাঙালি এবার তাঁর পরিচালনায় ‘হরর কমেডি’ উপভোগ করবে, যা আবার একটি প্রসিদ্ধ বাংলা নাটক থেকে অনুপ্রাণিত এবং সেই নাটক লিখেছেন, বাংলার বিদ্রোহী নাট্য ব্যক্তিত্ব শ্রী বাদল সরকার।

    বল্লভপুরের রূপকথা

    শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে হাতিয়ার করে বক্স অফিসে নতুন বাংলা সিনেমার নজির গড়তে চাইলেও, এই জয় বোধহয় ভূত এবং রূপকথার। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের এই ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রেও তা যথেষ্ট ভাবেই স্পষ্ট। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’  মূলত একটি নাটক নির্ভর সিনেমা। তাই মূল নাটকটি রাজবাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোয় না। কিন্তু ফিল্ম আর নাটকের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফারাক হল ফিল্মে নির্দ্বিধায় সম্পাদনাকে হাতিয়ার করে, অক্লেশে স্পেস জাম্প করতে পারে। নির্মাতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য বোধহয় ঠিক করেছিলেন, তাঁর প্রথম বড়োপর্দার জন্য কাজে তিনি শৈল্পিক মুনশিয়ানাকে ‘ইভেন্ট’ তৈরির কাজে লাগাবেন, ন্যারেটিভ নির্মাণের কাজে নয়। কারণ বর্তমান কালে, ফিল্মের মৌলিকতার চেয়েও বোধহয় তাকে ঘিরে উদযাপন ও উন্মাদনাই আদতে দর্শককে হলমুখী করার ক্ষেত্রে উপযোগী হয়। সেই কাজ পরিচালক অনির্বাণ ভটাচার্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছেন তা বলাই বাহুল্য। তাই বাদল সরকারের লেখা মূল নাটকটির পরিকাঠামোকে খুব বেশিরকম পরিবর্তন না করে সহজ ভাবে একটা মজার প্রেমের গল্পই বলতে চেয়েছেন পরিচালক। এবং সেই গল্পের মূলে রয়েছে একটি ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি, যে বাড়ির একাকী অবিবাহিত যুবক রাজা ভূপতি রায়, একাকী চাকর মনোহর এবং রাজার পাওনাদারেরা। সেই বাড়ির আসল মালিক পঞ্চত্বপ্রাপ্ত রাজা রঘুপতি ভুঁইয়ার আত্মা। তারা সাবাই বসে আছে নিষ্পত্তির খোঁজে। বর্তমানে বাংলা ছবির অর্থনৈতিক অবস্থানকে মাথায় রেখেই এই ফিল্মের নির্মাতারা খুব বেশিরকম ন্যারেটিভের টেকনিকগত দিকে মাথা না ঘামিয়ে অনেক বেশি মনোনিবেশ করেছেন ছবির দৃশ্যপট নির্মাণে, আলোকচিত্রে ও সংগীতে। এই কার্যক্রমে, ফিল্মের ন্যারেটিভ খানিকটা বিপর্যস্ত হলেও দর্শকের উন্মাদনাকে তা কোনোভাবেই দমাতে পারেনি। এখানেই আবার জয় হয়েছে বাংলা হরর কমেডির।

    ___

    *মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @