No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন, স্বাধীন ভারতে আজও ব্রাত্য বটুকেশ্বর দত্ত

    ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন, স্বাধীন ভারতে আজও ব্রাত্য বটুকেশ্বর দত্ত

    Story image

    ন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মানুষটি বছর কয়েক আগে হঠাৎই খবরের শিরোনামে উঠে আসেন। কানাঘুষো শোনা যায়, জনপ্রিয় বর্ধমান রেলস্টেশনের নাম বদল করে নাকি তাঁর নামে রাখা হবে। বিভিন্ন মহলে শুরু হয় জল্পনা। যদিও অচিরেই মিলিয়ে যায় তা। ঠিক যেভাবে এতবছর ধরে আমাদের স্মৃতি থেকে বিলীন হয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বটুকেশ্বর দত্ত (BatukeshwarDutta)। ভগৎ সিংয়ের (Bhagat Singh) সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন তিনি। অথচ চিরকালই থেকে গিয়েছেন ব্রাত্য। দেশ তো দূর, বাঙালি মহলেও যথাযথ স্বীকৃতি জোটেনি এই বঙ্গ সন্তানের।

    ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর বর্ধমানের (Bardhaman) খণ্ডঘোষ থানার ওয়াড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বটুকেশ্বর দত্ত। ছোটোবেলার পড়াশুনা এবং শৈশব, বাংলায় কাটানোর পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান কানপুরে। অন্যদিকে এই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আগুনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। দিকে দিকে পথে নামতে শুরু করেছে মানুষ। কেউ বেছে নিচ্ছে কংগ্রেসের অহিংস নীতি, কেউ আবার চরমপন্থী আদর্শ। অনুনয়-বিনয় নয়, ব্রিটিশকে তাড়াতে গেলে বিপ্লবী আন্দোলনই হোক একমাত্র পথ— এমন দাবিই তখন উঠে আসতে থাকে ভারতের কোণায় কোণায়। এরকম সময় কানপুরেই ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে আলাপ হয় বটুকেশ্বর দত্তের। তারপর ভগৎ সিং এবং অজয় ঘোষের সঙ্গে তিনি সদস্যপদ গ্রহণ করেন হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের। জানা যায়, বোমা বাঁধায় দক্ষ যতীন্দ্রনাথ দাসকেও (Jatindranath Das) সংগঠনে এনেছিলেন বটুকেশ্বর দত্তই।

    ১৯২৮ সাল। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন লালা লাজপত রায়। এই মিছিলেই পুলিশের লাঠির ঘায়ে গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। পাঞ্জাবের এমন এক নেতার মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বররা পুলিশ সুপার জেমস স্কট-কে মারার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই জায়গায় মারা যান সহকারী সুপার জন স্যান্ডার্স। শুরু হয় পুলিশি ধরপাকড়। বটুকেশ্বর দত্ত পালিয়ে যান নিজের জন্মভিটে, বর্ধমানে। প্রতিবেশীর বাড়ির নিচে এক গোপন সুড়ঙ্গে আত্মগোপন করেন। শোনা যায়, ভগৎ সিংও তাঁর সঙ্গে এখানে এসেছিলেন। এখানে বসেই দুই বন্ধু চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন।

    এর ঠিক এক বছর পর, ৮ এপ্রিল ১৯২৯ সাল। তৎকালীন ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের হলে হঠাৎ জোড়া বিস্ফোরণ। বিকট আওয়াজে কেঁপে ওঠে গোটা ঘর। ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল চারদিক, কয়েকজন আহতও হলেন। ঠিক এরকম সময় সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে গর্জে উঠলেন দুই অকুতোভয় যুবক, সোচ্চার ধ্বনিতে স্লোগান তুললেন ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’, ‘নিপাত যাক সাম্রাজ্যবাদ’। ক্রমশ ছদ্মবেশ ভেদ করে স্পষ্ট হল তাঁদের মুখ। ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত। পালানোর বিন্দুমাত্রও চেষ্টা করলেন না দুজনে। বরং ক্রমশ আরও গর্জে উঠলো তাঁদের গলা। অবশেষে সশস্ত্র পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন দুজনেই।

    আন্দামানের সেলুলার জেলের বিভীষিকাময় অধ্যায় নেমে এসেছিল তাঁর জীবনে। অকথ্য অত্যাচারের শিকার হতে হয় তাঁকে, তখনই থেকেই শরীরে বাসা বাঁধে টিবি রোগ। এরপর সাময়িক মুক্তিতে দেশে ফিরে আসলেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আবার গ্রেফতার হন তিনি।

    এরপরের ঘটনা আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি হয়। তাঁর জীবন নিয়ে অবশ্য আস্ত একটা সিনেমাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অপরজন? কী হয়েছিল তাঁর? কেনোই বা সময়ের পাতা থেকে বঞ্চিত হতে হল তাঁকে? এসব প্রশ্নের জবাব আজও আমাদের কাছে দুরূহ।

    না, ভগৎ সিংয়ের মতো মৃত্যুদণ্ড তাঁর হয়নি। যা হয়েছিল তা আরও যন্ত্রণার। আন্দামানের সেলুলার জেলের (Andaman Cellular Jail) বিভীষিকাময় অধ্যায় নেমে এসেছিল তাঁর জীবনে। অকথ্য অত্যাচারের শিকার হতে হয় তাঁকে, তখনই থেকেই শরীরে বাসা বাঁধে টিবি রোগ। এরপর সাময়িক মুক্তিতে দেশে ফিরে আসলেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আবারও গ্রেফতার হন।

    তারপর সময় আরও খানিকটা এগিয়ে যায়। চোখের সামনে স্বাধীন হয় দেশ। এতদিনের লড়াই-এর অবসান। স্বপ্নপূরণ! কিন্তু স্বপ্নের সেই কারিগরের কী হল তারপর? জানা যায়, স্বাধীন সরকার তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর কার্ড দিয়েছিল, তবে তো হিসেব মতো তাঁর সমস্ত সম্মানই পাওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবিক ঘটেছিল সম্পূর্ণ আলাদা।

    জীবনের শেষটা আবার সেই রাজধানী, দিল্লিতে। যেখানে একদিন এসেছিলেন বিপ্লবীর বেশে। শেষ বয়সে সেখানেই আবার এসে পৌঁছলেন এক অসহায় অসুস্থ দারিদ্রের বেশে। বয়স তখনও ষাট পেরোয়নি; কিন্তু শরীরের অবস্থা সেই কথা জানান দিচ্ছে না মোটেই। কোনোক্রমে শ্বাসটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করলেও শরীর ছেড়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। অবশেষে একেবারেই ছেড়ে দিলো। ১৯৬৫ সালে ২০ জুলাই, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে, লোকচক্ষুর আড়ালে মৃত্যু হল বটুকেশ্বর দত্তের। তাঁর শেষ ইচ্ছা মেনে বন্ধু ভগৎ সিং এবং রাজগুরুর মতো তাঁর শেষ কাজ করা হল পাঞ্জাবের হুসেইনিওয়ালায়।

    আন্দামানের সেলুলার জেলের বন্দিদের তালিকায় এখনও জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। স্বাধীনতার ৭৫ বছর গড়িয়ে গিয়েছে, বাঙালি মনে রেখেছে ভগৎ সিং-কে, অথচ বঙ্গসন্তান বটুকেশ্বর দত্তের স্বীকৃতির ভাঁড়ার পূর্ণ হল কই! বর্ধমানের মাটিতে আর ফেরা হয়নি তাঁর, তবু ওয়াড়ি গ্রাম আজ বটুকেশ্বর দত্তকে মনে রেখে দিয়েছে। শুধু হারিয়ে গিয়েছেন বৃহত্তর বাঙালি জাতির স্মৃতি থেকে।

    তথ্যসূত্র - 
    ১)  ইটিভি ভারত
    ২) কলকাতা ২৪X৭ 
    ৩) আনন্দবাজার পত্রিকা
     ৪) গেট বেঙ্গল

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @