No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় জন ছাত্র আবিষ্কার করেছিল সাহিত্যে ‘গণিত’ এবং গণিতে ‘সাহিত্য’

    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় জন ছাত্র আবিষ্কার করেছিল সাহিত্যে ‘গণিত’ এবং গণিতে ‘সাহিত্য’

    Story image

    চল্লিশ বছর কেটে গেছে ‘ছয়’ পত্রিকার। জানুয়ারি, ১৯৮০-তে প্রথম প্রকাশিত হয় এই পত্রিকা। মাত্র সাতটি সংখ্যা বেরিয়ে তিন বছর পরই বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি (মে, ১৯৮৩)। লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণবায়ু স্বভাবতই ক্ষীণ। কিন্তু এই ক্ষীণতার কারণ সাধারণত অর্থনৈতিক অথবা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কিন্তু চল্লিশ বছর পরও তাঁরা মনে করেন, এসব নয়, আসলে সকলের কর্মসূত্রে দূরে চলে যাওয়াই এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ। কী স্বাভাবিক একটা উত্তর। বলেন, তাঁদের কখনও কোনো অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়নি পত্রিকা করতে গিয়ে। কেননা সকলেই কমবেশি টিউশন পড়াতো, তা থেকেই উঠে আসত পত্রিকা চালানোর সামান্য খরচ।

    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়র ম্যাথামেটিকস্-এ এম.এস.সি পাঠরত ছয় জন ছাত্র খুঁজতে শুরু করেছিল সাহিত্যে গণিত এবং গণিতে সাহিত্য। এ ধরণের সাহিত্যকে তারা নাম দিয়েছিল ‘গাণিতিক সাহিত্য’। বাংলা সাহিত্যে একটা আন্দোলনের নাম গাণিতিক সাহিত্য। তাঁরা ছ’জন কে কে ছিলেন তা পত্রিকার পাতা থেকে উদ্ধার করা আজ অসম্ভব। তবে প্রথম থেকেই চিরঞ্জয় চক্রবর্তী, অনুপ সেনগুপ্ত এবং মানস বসু এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মিহির চক্রবর্তী নামে এক অধ্যাপক। পরে পরে অনেকে যুক্ত হয়েছেন এর সঙ্গে – তাঁরা মনে করেন, লিটল ম্যাগাজিন চলে আসলে একটা কীর্তন দলের মতো, বহু লোক যায়, আবার বহু লোক আসে। এ প্রবহমান। এভাবেই ‘ছয়’ গোষ্ঠী সংযুক্তি ও বিযুক্তির মধ্যেই সচল থেকেছে।

    গাণিতিক সাহিত্য আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি

    গণিত নিয়ে সাহিত্য? সমকালে অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক ভ্রূ কুঁচকিয়েছেন। তখন এঁরা হাজির হলেন কমলকুমার মজুমদারের কাছে, এঁদের লেখালেখি নিয়ে। তিনি উপদেশ দিলেন অথর্ব বেদের ‘শূল্ব সূত্র’ ও ১১৫০ সালে দ্বিতীয় ভাস্কর কর্তৃক লিখিত ‘লীলাবতী’ পড়ার। সমকালে সাহিত্য হইচই ফেলা শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের এক প্রবক্তা রমানাথ রায়ের কাছ থেকে শাস্ত্রবিরোধী ভাবনা বিষয়ক প্রবন্ধ চেয়ে ছাপালেন দ্বিতীয় সংখ্যায়। এভাবে তাঁরা বাংলা সাহিত্যের প্যারালাল ধারার ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে এগোতে চেয়েছিলেন। এঁদের নতুন সংখ্যা সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখতেন সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। একবার লিখলেন মতি নন্দী। আবার রমাপদ চৌধুরীর অ্যাসিস্টেন্ট রাধানাধ মণ্ডল একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখলেন তাঁর নিজস্ব পত্রিকায়। এভাবে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যের ধারা থেকে ফিডব্যাক পেতে থাকলেন।

    বুদ্ধদেব গুহ, মানস বসুর মাসতুতো দাদা। তিনি নিয়মিত পড়তেন ‘ছয়’ এবং উপদেশ দিতেন যে, এভাবে সাহিত্য হওয়ার নয়। কিন্তু তাঁরা জেদ ধরেছিলেন। নতুনভাবে সাহিত্যকে দেখতে চাওয়ার জেদ। এই আবিষ্কারের নেশাই তাঁদের সাতটা সংখ্যার বের করবার অনুপ্রেরণা।

    তাঁদের ছিল নিরন্তর অনুসন্ধান, পূর্ববর্তী সাহিত্যের মধ্যে গণিতকে খুঁজে পাওয়ার। এভাবে তাঁরা পৌঁছলেন আইনস্টাইনের কবিতার কাছে, ব্রেখটের গল্পের কাছে। সেসব অনুবাদ করে ছাপালেন তাঁদের পত্রিকায় একটা স্বীকৃতি আদায় করতে। অনুবাদ করলেন চিরঞ্জয় চক্রবর্তী, ঐন্দ্রিলা সেনগুপ্তা ছদ্মনামে। 

    ষাটের লেখক কানাই কুণ্ডু চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, তিনি এঁদের পত্রিকায় লিখতে চান। কিন্তু লেখা পছন্দ না হওয়ায় তাঁরা ফেরত পাঠান। এমনটাই হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক বড়ো অফিসার কমলাক্ষ গোস্বামীর ক্ষেত্রেও। যেকোনো রকম প্রলোভন থেকে বেরিয়ে একান্ত জেদে প্রমাণ করেছে নিজেদের মেরুদণ্ড। লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে এই উন্মাদনা, জেদ, শিল্পের নতুন রাস্তা খুঁজতে চাওয়া, একটা বিপুল পড়াশোনা করবার নেশা এক সময় পেয়ে বসেছিল। সেটা ছিল লিটল ম্যাগাজিনের ‘সুবর্ণযুগ’। আক্ষরিক অর্থেই ‘ধারা’ নয়, বিপরীতে ‘রাধা’ অনুসন্ধান লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষণ। যেকোনো ভাষা-সাহিত্যেই নতুন ‘রাধা’ অনুসন্ধানে লিটল ম্যাগাজিনের বিকল্প হয় না।

    ‘ছয়’ গোষ্ঠী ভেঙে যাওয়ার পর অনেকেই সরে যায় সাহিত্যের পরিমণ্ডল থেকে। একমাত্র চিরঞ্জয় চক্রবর্তী এখনও নিরন্তর লিখে চলেছেন। ‘তথাগত’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি নিজেকে সাহিত্যিক নয়, ‘মোমবাতি প্রস্তুতকারক’ বলতেই বেশি আগ্রহী। কেননা তাঁর পেশা মোমবাতি তৈরি করা, নেশা সাহিত্য। সাহিত্য থেকে কিছু পাওয়ার বাসনায় নয়, না লিখে থাকতে পারেন না বলেই লেখেন। এবং লেখেন মূলত নাম না জানা ছোটো পত্রিকায়। ২০১৮ সালে তিনি সম্মানিত হন ‘গল্পমেলা’ পুরস্কারে। তাঁর ‘বোকা প্রপিতামহ কথা’ উপন্যাস পড়ে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের মন্তব্য - “চিরঞ্জয় চক্রবর্তী উদীয়মান শক্তিশালী লেখক এবং তিনি একজন প্রকৃত সৎ লেখক। তাঁর অকৃত্রিম আন্তরিক আবেগ ও সততাই তাঁর রচনার অলংকার, তাঁর গদ্যের ঐশ্বর্য। ...নিজের অনন্ত কথামালা অকপটে ব্যক্ত করুন। একবিংশ শতাব্দী আপনার লেখা পড়বে।” অথচ একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের কতজন পাঠক পড়ছে চিরঞ্জয় চক্রবর্তীকে তা বোধহয় হাতে গুনে বলা যায়। এর কারণ কি এই যে, জলের থেকে হালকা বস্তুই জলের উপর ভাসে আর ভারি সব কিছুই ডুবে যায়?

    আপাতত ‘ছয়’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গাণিতিক সাহিত্য আন্দোলন চল্লিশ বছর পার করল। ‘ছয়’ তিন বছর চলার পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হয়তো, কিন্তু চিরঞ্জয়বাবু এখনও কলম তুলে নেননি এবং এটাই গাণিতিক সাহিত্যের খোঁজকে বহমান রেখেছে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @