চল্লিশ পুতুলের ‘থাকা’


একাধিক মৃৎমূর্তি একটি ফ্রেমে সন্নিবেশ করতে হলে চালির সাহায্য নিতে হয়। যেমন সাত পুতুলের জন্য দুর্গার একচালামূর্তি মধ্যযুগ থেকে একালেও সমান জনপ্রিয়। টেরাকোটা মন্দিরে সাবেকি একচালার মধ্যে সাত পুতুলের দুর্গাফলক মিলেছে অনেক। এমনকি অন্ত্যমধ্যযুগের একচালি প্রস্তরফলকেও দুর্গার পারিবারিক মূর্তি দেখা যায়। কিন্তু পুতুলের সংখ্যা যখন ৩০-৪০টি তখন সেগুলি একচালিতে আঁটা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষ লোকপ্রযুক্তির মাধ্যমে কাঠ-বাঁশ দিয়ে নির্মিত একটি অভিনব কাঠামো ‘থাকা’র সাহায্য নেওয়া হয়। যা আদতে একটা চাতালসহ সিঁড়ির মত দেখতে। উচ্চতায় মাত্র দশ ফুট। চওড়া গড়ে সাড়ে পাঁচ ফুট। সমগ্র থাকাটি যেন সমকোণী ত্রিভূজাকৃতি। থাকায় ধাপ অনুসারে একসঙ্গে ৩০ থেকে ৪০টি পুতুল অনায়াসে ধরবে। থাকা-র উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ হয়েছিল কাটোয়া-দাঁইহাট গাঙ্গেয় অঞ্চলে। বিশেষকরে কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ে ও দাঁইহাটের রাস উৎসবে আজও দেখা যায় এই বর্ণাঢ্য থাকা।
মৃৎমূর্তির পিছনে এই যে চালি বা পৃষ্ঠপট তা মূলত প্রস্তরবিগ্রহের প্রভাবজাত। গবেষকদের মতে, প্রাক-পালযুগে নির্মিত প্রস্তরমূর্তির পিছনে যে গোলাকার স্বল্পায়তনিক প্রভামণ্ডল ছিল তা ধীরে ধীরে বিবর্তনের হাত ধরে ঊর্ধে ও নিম্নে প্রসারিত হয়ে পৃষ্ঠপট বা চালিতে পরিণত হয়েছে। পাল-সেন যুগেই এর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হয়েছিল। যেমন একটি পারিবারিক ‘ভোগ-বিষ্ণুমূর্তি’তে মূল মূর্তি ছাড়াও লক্ষ্মী সরস্বতীসহ দুই সহচরী খোদিত থাকে। পাদপীঠে পূজকমুনি বা ভক্ত। পৃষ্ঠপটের ঊর্ধে মালাহাতে বিদ্যাধর বিদ্যাধরী, বিভিন্ন গণমূর্তি, দুপাশে দশাবতার মূর্তি ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। পাথরের মূর্তির এই চালি যখন মৃৎশিল্পে অনুকরণ হতে লাগল তখন প্রচুর মূর্তিসজ্জা জনিত তক্ষণশিল্পের এই সুবিধা স্বাভাবিকভাবেই মৃৎপ্রতিমার একচালিতে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এই কারণেই ধীরে ধীরে চালির পরিবর্তে এমন বিচিত্র থাকার উদ্ভব হয়েছিল।

একটি থাকার জন্য প্রথমে চাই কাঠের কাঠামো। লম্বায় ছ-হাত, চওড়া গড়ে পিছনে চার ও সামনে পাঁচ হাত। ট্রাপিজিয়মের মত কাঠামোর গঠন। আড়াআড়ি কাঠের সজ্জা থাকে ছয়টি। প্রতি কাঠে ছিদ্র থাকে ছয়টি করে। এবার ১২ খানা বাঁশ ফাটিয়ে ‘কাবারি’ পুঁতে দেওয়া হয়। বাঁশের কাবারি দিয়ে ধাপি বা সিঁড়ি বানানো হয় পাঁচ থেকে ছয়টি। সুতলি দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। সিঁড়ির চাতালটি সিংহাসনের মত। এবার সিঁড়ির দুদিকের রেলিং-এর মতো ছয়টি বা পাঁচটি করে সখি দাঁড় করানো হয়। এরা একহাতে রেকাবি কিম্বা মালা নিয়ে বা শঙ্খবাদন রত অথবা নাচের ভঙ্গিতে থাকে।
প্রতিটি থাকা-য় থাকে মহাভারত রামায়ণ কিম্বা পুরাণাদির নির্বাচিত নাটকীয় দৃশ্যসজ্জা। চাতালের মাথায় দৃশ্যসজ্জার মূল তিনটি চরিত্র। যেমন ‘কেষ্টকালী থাকা’ হলে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর। শিবদুর্গা কেন্দ্রিক পালা হলে শিব দুর্গা কার্তিক বা গণেশ ইত্যাদি। প্রতিটি সিঁড়ির দুপাশে দুই সখিকে বাদ দিলে আরো তিনটি করে পুতুল বসানো হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক ধাপিতে থাকে পাঁচাটি করে পুতুল। ছয় ধাপি হলে ৩০টি এবং অতিরিক্ত একটি ক্ষুদ্রমূর্তি পুজোর জন্য রাখা হয়। থাকার বিসর্জন হয় না।
পুতুলগুলি তৈরি করেন কাটোয়া দাঁইহাট বা পাটুলির কুম্ভকার বা পালেরা। পুজোর আয়োজক সংস্থার নির্দেশকের নির্দেশ অনুযায়ী শিল্পীরা পুতুল তৈরি করেন এবং থাকায় বসিয়ে দেন। এরপরে আসেন রূপসজ্জার শিল্পীরা। এই কাজগুলি যাত্রাদলের পেশাদারি পোশাকশিল্পীদের। চরিত্র অনুযায়ী যাত্রার রয়াল ড্রেস পরানো হয়। প্রতিটি পালার পরিচয় ও চরিত্রসজ্জার পরিচিতিটি লিখে একটি বোর্ডে টাঙানো থাকে। পরের কাজ আলোকশিল্পীর। তিনি সাদা টিউবলাইট দিয়ে থাকা সাজানো। থাকার দুপাশে বিভিন্ন রঙের পতাকা লাগানো হয়। এরপর লোহার তৈরি দুটি চাকা লাগানো গাড়িতে থাকা বসানো হয়। বাঁচের সময় আগে প্রচুর বাহক লাগত। বর্তমানে যন্ত্রচালিত গাড়িতে বসিয়ে শোভাযাত্রায় বের করা হয়।

থাকায় সখি থাকে ১২টি। মাঝের ১৮টি চরিত্র পালা অনুসারে পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন ধরনের পালা যেমন শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ, লক্ষণের শক্তিশেল, গান্ধারী জননী, বকাসুর বধ, কেষ্টকালী, অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, সীতার বিবাহ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কৃষ্ণলীলা, চৈতন্যলীলা ইত্যাদি। থাকায় যাত্রাশিল্পের প্রভূত প্রভাব পড়েছিল। কাটোয়া দাঁইহাটে একসময় যাত্রার বিপুল চল ছিল। আদি যাত্রাওলা গোবিন্দ অধিকারীর শিষ্য ছিলেন কাটোয়ার পীতাম্বর অধিকারী, জগদানন্দ প্রমুখরা। দাঁইহাটের নাট্যকর্মী অভিজিৎ ভট্টাচার্য জানালেন - থাকায় শুধুমাত্র পৌরাণিক পালায় ব্যবহৃত হয়। ব্যাতিক্রম শুধু মহাপ্রভুর জীবনালেখ্য রূপায়ণ। আনুমানিক অষ্টাদশ শতকে বা তার আগে এই থাকার উদ্ভব। প্রথম যুগে থাকা এত বড় ছিল না। ধীরে ধীরে তার রূপের বিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে একটা থাকার খরচ পড়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। অন্যতম থাকাশিল্পী গোপখাঁজির বুদ্ধদেব পাল জানালেন, থাকার চাহিদা বর্তমানে কমে গেলেও আজও এতদঞ্চলের রাস বা কার্তিকপুজোর বনেদিয়ানার প্রতীক এই থাকামূর্তি।