শালবন, হাতির পাল, অযোধ্যা আর এক অলীক দৌড়

ক্যাম্পের বাইরেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কুকুবুরু আর মাঠাবুরু। দুই পাহাড়। এমনিতে দেখতে নিরীহ। কিন্তু, পাহাড়ের ভিতরের বনে নাকি হাতি আসে। কষ্টেসৃষ্টে মাঠাবুরুর মাথায় উঠলে দেখতেও পাবেন হাতির পালের চলাফেরার চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে বন জুড়ে। হেলে আছে বুনো কুল গাছ। হাতি গা চুলকেছিল। আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া অর্জুন মাহাতো বললেন, এইসব কারুকাজ খুব বেশি দিন আগের নয়। এছাড়া, পাহাড়ের গা বেয়েই শালবন, বুনো ঝোপ। দু-একবার লেপার্ডের দেখাও মিলেছে। কয়েক বছর আগে ক্যাম্প থেকেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল ছাগল ছানা।
আরও পড়ুন
শালরাজা আর সীতার দেশের ‘সত্যি রূপকথা’
এইসব নিয়েই চর্চা চলছিল ক্যাম্প জুড়ে। পরেরদিন, রবিবার ভোরেই শুরু ‘দ্য বেঙ্গল আলট্রা’র দৌড়। ২৫ কিমি, ৫০ কিমি আর ৮০ কিমি—এই তিনটে ক্যাটেগরিতে দৌড়বেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা রানাররা। এটা ট্রেল রান। মানে, এবড়ো-খেবড়ো, ভাঙাচোরা, পাহাড়ি পথে দৌড় হবে। দৌড় হবে পাহাড়ের গা বেয়ে, শালবনের ভিতরে দিয়ে, সাঁওতাল গ্রামে ঢুঁ মেরে, ডুংরির পাশ দিয়ে। দৌড় হবে পাখিপাহাড়কে বের দিয়ে, অযোধ্যা লোয়ার ড্যাম থেকে সোজা চড়াই ভেঙে আপার ড্যামকে পাশে রেখে মার্বেল লেক অবধি। শীতের শেষ পাত। ক্যাম্পের উঠোনে সারি সারি পলাশ গাছের একটায় ফুল এসেছে। দুপুরে চড়া রোদও ওঠে। সেই রোদ পাহাড়ে ছিটকে এসে লাগবে দৌড়বিদদের গায়ে। পাথুরে পথ পরীক্ষা নেবে পায়ের পেশির। এরই সঙ্গে জুড়বে গা ছমছমে বুনো পরিবেশ।
নিরাপত্তার সমস্ত দিক অবশ্য খতিয়ে দেখা হয়েছে দৌড় শুরুর আগে। তবুও, উদ্যোক্তারা খানিক চিন্তায়। রানারদের অবশ্য খুব দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হল না। তারা পাস্তা খেয়ে শুতে চলে গেলেন তাড়াতাড়ি। ভোর চারটেয় শুরু হবে দৌড়। চোদ্দ ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার শেষ করতে হবে। তাই, আলো ফোটার আগেই যতটা সম্ভব এগিয়ে যাওয়া। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি খুঁটিয়ে দেখতে রাত্রিবেলাতেই মাথায় হেড টর্চ লাগিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকজন। পথে মার্কিং ঠিক আছে কিনা দেখে আসতে। চারপাশে তখন কিলবিল করছে জ্যোৎস্না। ক্যাম্পে খানিক আগেই শেষ হয়েছে ছৌনাচ। এর মধ্যেই বনের পথে, গা ছমছমে পাহাড়কে পাশে রেখে যারা মার্কিং করতে গেল, তাদের ভয় বলে যে কিছু আছে বিশ্বাসই হয় না।
এ এক আশ্চর্য ইভেন্ট। আমি তো খানিক হুজুগের বশেই চলে গেছিলাম ‘দ্য বেঙ্গল আলট্রা’কে চাক্ষুষ করব বলে। মিথ্যে বলব না, এই ইভেন্ট কলকাতায় হলে যেতাম না। পুরুলিয়ার নিসর্গ, পর্যটকদের কাছে অচেনা দৌড়ের এই পথ—এসব দেখার লোভটাই টেনে নিয়ে গেছিল আমায়। এই ট্রেল রানের প্রধান আয়োজক, পুরুলিয়ারই ভূমিপুত্র সৈকত দত্ত আমায় জানিয়েছিলেন-- তাঁর ইচ্ছে এই ইভেন্টের মধ্যে দিয়ে অনাবিষ্কৃত পুরুলিয়াকে নতুনভাবে চেনানো। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের বিশ্ব মানচিত্রে পুরুলিয়াকে স্থায়ী জায়গা করে দেওয়া। তখন এইসব শুনে খুব কিছুই বুঝিনি। শুধু বুঝেছিলাম, এমন ট্রেল রান বাংলায় আর হয় না। ৮০ কিলোমিটার দৌড়ের কথা শুনে অবাক লেগেছিল। নিজে জীবনে টানা ৫ কিলোমিটারও দৌড়ইনি। ট্রেল রান কাকে বলে, সে বোঝাও নেট ঘেঁটে আর ইউটিউব দেখে। ফলে, জানাই ছিল না কী বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে! জানাই ছিল না, এমন এক ইভেন্ট আমাদের রাজ্যেও হয়। এক কথায়, আন্তর্জাতিক মানের ইভেন্ট।
মুগ্ধতা শুরু হল ক্যাম্পে পা রাখার পর থেকেই। প্রতিযোগিতার নামগন্ধ নেই এই পরিবেশের কোথাও। সমস্ত রানার একসঙ্গে খাচ্ছেন, গল্প করছেন, একে-অপরের চোটের খোঁজ নিচ্ছেন। একইসঙ্গে চোখে পড়ল স্বেচ্ছাসেবকদের। কেউ ওড়িশা থেকে, কেউ কলকাতা থেকে এসেছেন শুধু এই ইভেন্টে সাহায্য করবেন বলে। চাকরি থেকে একদিনের ছুটি পেয়েই চলে এসেছেন কেউ কেউ। এই দৌড়ে রানারদের ভাগ্যে তাও মেডেল জুটবে, মহার্ঘ আইটিআরএ পয়েন্টও মিলবে। কিন্তু, স্বেচ্ছাসেবকদের তো বস্তুগত কোনো পাওনা বা লাভ নেই। তারপরেও, তারা গোটা পথটা রেকি করেছেন বারবার। বয়সে বেশিরভাগই কিশোর বা যুবক। তবে, দৌড়পাগল কয়েকজন মধ্যবয়স্ক নারী-পুরুষও আছেন এই দলে। ভোর চারটেয় বেরনো। তার আগে সারা রাত ধরে দায়িত্ব ভাগাভাগি চলল। চলল, শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনা। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর এক একটা হাইড্রেশন পয়েন্টের দায়িত্বে থাকবে কয়েকজন করে। রানারদের জল, প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার, দরকারে ম্যাসেজ, ওষুধের ব্যবস্থা করবে এরাই। আর রাস্তায় সাইকেলে, বাইকে, গাড়িতে থাকবে আরো অনেকে। কোনো রানারকেই একা ছাড়া যাবে না।
একই তাঁবুতে থাকার সুবাদে দেখছিলাম সবাইকে। ট্রেন জার্নির পর অভ্যস্ত শহুরে শরীর ঘুম চাইছিল। কিন্তু, ঘুম আর হল কই! এরাও তো ঘুমোচ্ছে না। কত অদ্ভুত সব চরিত্র। অনেকেই কলকাতায় চাকরি করে। শহরের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে থাকে এরা!
পরিচয় হল তরুণ মাহাতোর সঙ্গে। তরুণ অবশ্য পুরুলিয়ারই ছেলে। বাংলা নিয়ে পড়ছে। গত পনেরো-কুড়িদিন সে বাড়ি ফেরেনি। সাইকেল নিয়ে ঘুরছে পুরুলিয়ার আনাচে-কানাচে। খবর পেয়ে চলে এসেছে এখানেও। পরিচয় হল সুস্মিতাদি, সৌমিক, অবিনাশ, বাপিদা, পিন্টু, রিতমদের সঙ্গেও। পরিচয়টা আরো ঘন হল দৌড়ের দিন। রানারদের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে ছিল এঁরা। রানাররা হাঁপিয়ে গেলেই বাড়িয়ে দিয়েছে জল। সময় ফুরিয়ে এলে পাশে দৌড়েছে নিজেরাও, যাতে এনার্জি আর মোটিভেশনে খামতি না পড়ে রানারদের। কেউ দৌড় শেষ করলে উচ্ছ্বাস করেছে শিশুর মতো। ইভেন্টের দিন এক-একজন অযোধ্যার মাথায় উঠেছে অন্তত পাঁচ-ছবার। কখনো খাবার নিয়ে, কখনো রানারদের সঙ্গ দিতে, কখনো অন্য কোনো কাজে।
কত অদ্ভুত সব দৃশ্যের জন্ম হচ্ছিল গোটা দৌড়ে। অভিষেক তুঙ্গ প্রথম হয়ে ৮০ কিলোমিটার শেষ করলেন বড়ো অনায়াসে। বললেন, আরো আগে শেষ করা উচিৎ ছিল। দ্বিতীয় রানার দৌড় শেষ করার আগেই রেডি হয়ে ট্রেন ধরতে চলে গেছেন তুঙ্গ। যেন জানতেন, সময়ের ভুল হবে না। বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন সিফত। প্রথম বাংলাদেশি মহিলা আলট্রা রানার। ৭০ কিলোমিটার দৌড় শেষে ক্লান্ত সিফত উদ্যোক্তাদের বলছেন, তাঁকে পারতেই হবে। কারণ, তিনিই বাংলাদেশ থেকে আসা প্রথম মহিলা রানার। দৌড় শেষ করা ছাড়া তাঁর আর কোনো পথ নেই।
আর, দৌড়ের পথ! এই পুরুলিয়া কীভাবে এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল! মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক পাখি। উঁচু পাথরের মাথায় বসে থেকেই বাগালে ঢুকে পড়া ছাগলদের তাড়াচ্ছেন স্থানীয় এক মানুষ। গ্রামের বাড়ির দেওয়ালে আলপনা। ঝিরিহিরি হাওয়া অযোধ্যার মাথায়। ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়া পথ। প্রথম ল্যাপ শেষ করে ক্যাম্পে ফিরে শুশ্রূষা নিতে নিতেও এই পথের ঘোর কাটছিল না রানারদের। সন্ধে নেমে আসছিল। আকাশটা লাল করে সূর্য ডুবছিল পাটে। নিজেদের নিংড়ে দৌড়ের শেষ কয়েক কিলোমিটার উতরে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতেও মুগ্ধ হয়ে পুরুলিয়াকে দেখছিলেন রানাররা।
দৌড় শেষ হল। হস্তশিল্পীদের হাতে তৈরি মাটির তৈরি মেডেল দেওয়া হল রানারদের। সৈকত বলেছিলেন, এই ইভেন্ট পুরুলিয়াকে নতুনভাবে চেনানোর জন্যেও বটে। তাঁর প্রতিটা পরিকল্পনাতে সেই ছাপ স্পষ্ট। তাই, ট্রফির জায়গায় ছৌয়ের মুখোশ, স্থানীয়দের হাতে তৈরি গামছা। রানাররা প্রায় সবাই বললেন, এমন রাস্তা, নিসর্গ ভারতের খুব কম ট্রেল রানেই আছে। সব দিক থেকেই যে এই ইভেন্ট আন্তর্জাতিক মানের, সে কথাও উঠে এল তাঁদের মুখে।
এবারে দু’বছরে পা দেওয়া এই ইভেন্টে পরের বছর থেকেই হয়তো উপচে পড়বে রানারদের ভিড়। হয়তো বিদেশ থেকেও রানাররা ছুটে আসবেন চ্যালেঞ্জিং পথ আর অপূর্ব নিসর্গের যুগলবন্দির টানে। হয়তো দ্রুতই বিশ্ব পর্যটনের মানচিত্রেও জায়গা করে নেবে পুরুলিয়া। কিন্তু, ফেরার সময় জ্যোৎস্নায় লেপ্টে থাকা শালবনের পথ ধরে ফিরতে ফিরতে আমার মনে হচ্ছিল একটা অন্য কথা। এই ভয়ঙ্কর বিভেদ, মৌলবাদ, ঘৃণার আবহের মধ্যেও কী নিবিড় আত্মীয়তা তৈরি হতে দেখলাম অবিনাশ-হাসানদের মধ্যে। এও তো আমারই দেশ। এও তো আমাদেরই সংস্কৃতি...
অন্ধকার মাঠাবুরুর কোনো এক কোণ থেকে তখন ভেসে আসছে রাখালিয়া বাঁশির সুর।