দড়িশিল্পে লোকযন্ত্র ও লোকপ্রযুক্তি

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার সবক্ষেত্রেই উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কিন্তু কোথাও কোথাও আছে উলট পুরাণের গল্প। মান্ধাতা আমলের লোকযন্ত্র ও লোকপ্রযুক্তিকে অবলম্বন করে দিব্ব্যি চলে আসছে কুটিরশিল্পকর্ম। যেমন পূর্ব বর্ধমানের দাঁইহাট-বেড়াগ্রামে লোকযন্ত্র ও লোকপ্রযুক্তির সহায়তায় পুরুষানুক্রমে তৈরি হচ্ছে পাট থেকে নানা সাইজের দড়া দড়ি ও রসা।
প্রাচীনকাল থেকেই খড় শন-পাট-খেজুরের পাতা বাবুইঘাস কলার বাসনা প্রভৃতি ছিল দড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ। দড়ি মানেই পাকানো পদ্ধতির আবিষ্কার। মানুষ বুদ্ধি খাটিয়ে গাছের ডাল বা দুটো খুঁটি পুঁতে আড়াআড়িভাবে আর একটা ডাল সেট করে বানিয়ে ফেলেছিল তাঁতের আদিম এক লোকযন্ত্র। এই কাঠামোর উপরে বাঁশের নল পড়িয়ে মোটা দড়ি দিয়ে টানাপোড়েন শুরু করে। দড়ির দু প্রান্তে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দুটো পোড়ামাটির বল বা পাথরের টুকরো। এই হলো গিয়ে আদিম মাকু। এমন সুতো লাগা পোড়ামাটির মাকু রাঢ়-বঙ্গের একাধিক প্রত্নক্ষেত্র থেকে মিলেছে। এইভাবেই মানুষ প্রাকৃতিক তন্তু পাকিয়ে আবিষ্কার করেছিল তাঁতযন্ত্র।
সময়ান্তরে সেই সুতো বা দড়ি তৈরির কৌশলের নানা পরিবর্তন এসেছে। হস্তশক্তির পরিবর্তে বৈদুত্যিক শক্তির প্রয়োগ হচ্ছে। যন্ত্রের আমূল পরিবর্তন এসেছে। যুক্ত হয়েছে কম্পিউটারের বহুমুখী প্রয়োগ। তবু কোথাও কোথাও রয়ে গেছে সেই আদিম বুনন প্রক্রিয়া। বেড়ার দড়িশিল্প তারই এক সফল দৃষ্টান্ত। দড়া বলতে মোটা দড়ি। এর সাইজ তিনরকম। গোরু মোষ বাঁধার দড়া। নাঙলা রসা। কল বসানোর মোটা কাছি। দাঁড়ি পাল্লার জন্য মোটা রসা আর সরু দড়ি বা খাটিয়া।
প্রথমে মহাজনের কাছে পাট কিনে এনে পাটচুল বানানো। লাগে চার ফুট লম্বাও এক ফুট চওড়া একটি কাঠের পাটা। পাটায় ১০ ইঞ্চি লম্বা প্রায় ৩০টি ধারালো শিক পোঁতা থাকে। লোকযন্ত্রটির নাম কাঁটা। পাটের গোড়ার দিকটা ঐ কাঁটায় ফেলে চিঁড়তে হবে। এর ফলে তৈরি হয় পাটচুল। বুননের জন্য আঁশ বানানোর পর এবার ফাঁকা মাঠে শুরু বুনন প্রক্রিয়া।
সঙ্গে জড়িয়ে আছে কয়েকটি লোকযন্ত্র। যেমন মই - ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশ। মাঝামাঝি ফাটিয়ে চাষের মই-এর আকৃতি করে নেওয়া হয়। মই-এর মাথায় আড়াআড়ি শক্ত কাঠি লাগে নাম মাকাশি। কল - এটি দড়ি তৈরি করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকযন্ত্র। বাঁশের কাবারি দিয়ে তৈরি সরু কাঠি। তার ভিতরে পরানো হয় ৮ ইঞ্চি লম্বা ফাঁপা বাশের নল। মাথায় লাগানো থাকে পাতলা কাঠের একটা হুক। হুকের মাথায় আটকানো থাকে একটা মোটা সুতো। হুকের কাজ হলো যাতে পাটচুল গুছি করার সময় বেরিয়ে না যায়। তার মাথার পরানো সুতোর নাম লতি। এই কলগুলি দড়ির ঘনত্ব অনুসারে সরু মোটা ছোট-বড়ো হয়ে থাকে।
গুছি দিয়ে নানা মাপের দড়া দড়ি তৈরির জন্য যে লোকযন্ত্রটি লাগে তার নাম কামরাঙা, বালা ও ফিনকি। কামরাঙার মতো দেখতে একটি কাঠের বেলন ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা। পরিধির চার পাশে নালি কাটা। এর ভিতর দিয়ে গুছিগুলো যায় এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র রক্ষা করে। ফিনিকি হলো একটি চ্যাপ্টা লোহার বালা সহ ইঞ্চি ৫ লম্বা একটি দন্ড।মাথাটি হুকের মতো। এই লোহার বালার সাহায্যে দড়া বা দড়ি নানা আকৃতির হয়ে থাকে। ১০-১২ ফুট লম্বা একটা মোটা সুতোর নাম জুতি। দড়ির দুটি প্রান্তে আটকানোর জন্য গুছি বাঁধা থাকে। এর কাজ হলো দুপ্রান্ত ধরে ওঠানামা করে কলে পেঁচিয়ে পাক ধরানো। দড়া ভাঙার পর পাইকারি বিক্রি হয় কলকাতায়। স্থানীয় হকাররাও কিনে গ্রাম-গ্রামান্তরে বিক্রি করে।
পাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই এই জীবিকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। একদা দড়িশিল্পী এখন কেউ রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে, কেউ বা রিকশা বা টোটোচালক ইত্যাদি। বর্তমানে প্রায় ৫০ জন দড়িশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মোকসেদ সেখ, খোরসেদ,বকুল, জাকিরদের পাশাপাশি টেক্কা দিয়ে কাজ করছেন রেহানাবিবি জরিনাবিবি সামিনা খাতুনরা। অধিকাংশই দরিদ্র। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার। দড়ির কাজেই সংসারের সকলের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা। পাটের দরের সঙ্গে তাদের ভাগ্যও উঠানামা করে। এবছরে পাটের দর কিছুটা স্থিতিশীল বলেই লাভের মুখ কিছুটা হলেও দেখতে পেয়েছেন বলে অধিকাংশ দড়িশিল্পীরা জানিয়েছেন।