সেকেলে একান্নবর্তী কলকাতা এবং মাছে-ভাতে বাঙালি

মাছ নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতার শেষ নেই। যেকোনো শুভ কাজ মানেই মাছ থাকা চাই-ই চাই। তবে সেকেলে কলকাতা মানে ব্রিটিশ কইলকাত্তায় জাত মাছ বলতে বোঝানো হত – রুই, কাতলা, মাগুর, কই, তোপসে, মৌরলা, খয়রা, ভেটকি, ইলিশ আর চিংড়ি। একটু টাকা-পয়সা যাদের ছিল, তাঁদের সকলের বাড়িতেই প্রত্যেকদিন অন্যান্য খাবারের সঙ্গে চলে আসত এইসব মাছ। আবার শুভ দিন, মানে ছেলে-মেয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে মাছের মুখ দেখে, বাড়িতে নতুন বউ ঢুকছে মাছের মুখ দেখে, সন্তানের অন্নপ্রাশন বা উপনয়নের সময়ও মাছ খাওয়ার চল রয়েছে। নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে দুধে-আলতার পাথরে যেই দাঁড়ায়, ওমনি তার বাঁ হাতে একটা জ্যান্ত মাছ ধরিয়ে চারপাশে বলাবলি হয়, “চেপে ধর গো, চেপে ধর, সংসারের বাঁধন আঁটো হবে”। আবার ফুলশয্যার রাতে বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বউয়ের কানে কানে নাকি বলে দেয়, “মাছের স্বপ্ন দ্যাখো”। তাহলে নাকি আমরণ মাছ খাওয়ার বিলাসে মজে থাকবে বউটি।
আরও পড়ুন
বঙ্গদর্শন পুজোসংখ্যা, ১৪২৬
এই মাছের প্রতি ভালবাসাটা আবার সবার যে আসত এমনও না। কারণ সেকেলে কলকাতায় কিছু কিছু মাছের দামও ছিল বেশ আকাশছোঁয়া। রমেশ দত্ত তাঁর ‘সংসার’ (১২৯২ বঙ্গাব্দ) উপন্যসে বহু যুগ আগে নায়িকা বিন্দুর ঝি-র মুখ থেকে বলিয়েছিলেন, “বড়ো বড়ো কই মাছ পাওয়া যাবে না কেন মা? তা সে কি ছোঁয়া যায়? এক একটা দু পয়সা তিন পয়সা চার পয়সা চায়। ওমা, মাগুর মাছের কথাটি কইও না, একটা বড়ো মাগুর মাছের দাম চার পয়সা ছ পয়সা আট পয়সা।” সেকালে একান্নবর্তী বাড়িগুলোয় নিয়মিত ঝগড়া লাগত মাছের মুড়ো কে পাচ্ছে কে পাচ্ছে না, তাই নিয়ে। বাঙালির এই মাছপ্রীতি নিয়ে অসামান্য লিখেছেন কল্যাণী দত্ত তাঁর ‘থোড় বড়ি খাড়া’ গ্রন্থে। তিনি সুন্দরভাবে তাঁর দিদিমার যুগে ছড়া কেটে কেটে লিখেছেন কত কী। সেখানে এসেছে নানা বই, নানা জন আর নানা মাছের প্রসঙ্গ। সেখানে তিনি একজায়গায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ এনে লিখেছেন – “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাথাটি মস্ত বড়ো দেখাত, তাই ইস্কুলের বন্ধুরা তাঁকে যশুরে কই বাঁ কশুরে জই বলে খেপাত। যশোর জেলায় বড়ো বড়ো কই পাওয়া যায় ঠিকই, তবে এই রসিকতা যারা করত, তারা তো সব কলকাতারই ছেলে।” এরপরেই কল্যাণীদেবী কত্তাগিন্নির একটু বচসা তুলে ধরেছেন – “তুই যদি হোস ভালোমান্ষের পো/ তবে কাঁটখান খেয়ে মাছখান থো”।
কল্যাণী দত্ত এ-ও বলেছেন সেকালের কলকাতায় ঘরের মেয়ে বা গিন্নিদের সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল মাছ কোটা। এমনকি এ-ও বলেছেন, ঘুসো, মোচা, ধেনো, কাদা এসব ছিল ‘গরিবের চিংড়ি’। তাই নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলতেন, “চিংড়ি মাছ খেয়ে সোমবার নষ্ট করতে নেই।” এই চিংড়ি মাছ নিয়ে সাংঘাতিক একটি শ্লোক আছে – “গলদাং বাগদাং রস্যাং নারিকেলসণ্বিতাং।/ অলাবুলৌভনাং কৃত্বা ভক্ষিতব্যং ‘শুভযোগে’।।” অর্থাৎ, গলদা বাগদা চিংড়ির সঙ্গে লাউ আর নারকেল দিয়ে শুভযোগ ঘটলে অবশ্যই খাবে। ঠিক যেমন কলকাতার প্রায় সমস্ত মানুষের শুভযোগ ঘটত মোহনবাগান ম্যাচে জিতলে। আর বাঙালির ঘরে ঘরে তখন রসনাতৃপ্তির জন্য থাকত শ্রেষ্ঠ পদ চিংড়ি।
লেখার একদম শেষে কল্যাণী দত্ত প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক ইন্দ্রনাথ বাঁড়ুজ্যের কথা টেনে বলেছেন – ইলিশের গুণকীর্তনে তাঁর মতো পঞ্চমুখ হতে তো আর কাউকে দেখলুম না। জগতের, কলকাতা শহরের দুঃখকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করে বলেছেন, প্রথম দুঃখ ভদ্দরলোকেদের, ট্রামগাড়িতে উঠলে ভাড়া দিতে হয়। দ্বিতীয় দুঃখ মেয়েদের, স্বামীকে আপিস যেতে ছেড়ে দিতে হয়। তৃতীয় দুঃখ, ইলিশ হেন মাছ, তাতে আবার কাঁটা হয়। সবই উত্তম কথা। কিন্তু সভয়ে বলি, আদপে কাঁটা না থাকলে মুড়ো চুষে রস পেতুম কি?
মাছের প্রতি নজর বাঙালির নড়বে না। এত এত যুগ পরেও সকালের বাজারে মাছ কিনতে যাওয়ার সময় ভালো মাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়া আর একটু দরদাম না করলে সেই মাছ হজমও হবে না – তা চিংড়িই হোক বা ইলিশ, সাধের কই হোক বা পুঁটি।
গ্রন্থঋণ- থোড় বড়ি খাড়া – কল্যাণী দত্ত (থীমা প্রকাশনী)
গ্রন্থচিত্রণ- পূর্ণেন্দু পত্রী