যেভাবে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলককে নাস্তানাবুদ করেছিলেন বাংলার সুলতানরা

দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলাকে তিনটি অংশে ভাগ করেছিলেন – লখনৌতি, সাতগাঁও বা সপ্তগ্রাম এবং সোনারগাঁও। এই তিন অংশের আলাদা রাজধানী এবং আলাদা শাসকও ঠিক করে দেন তিনি। এই তিন জন শাসকদের মধ্যে বিবাদ লেগেই থাকত। মহম্মদ বিন তুঘলক এই তিনটি অংশ বজায় রেখেই বাংলার প্রশাসনে বেশ কিছু রদবদল করেছিলেন। তাঁর আমলে দিল্লির রাজনৈতিক অবস্থা ছিল টলোমলো, ভারতের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘটে চলেছে। বাংলার শাসকরাও কলহ-বিবাদ-ক্ষমতার লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছেন সর্বদা, আর সুযোগ পেলেই নিজেদের স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করছেন।
আরও পড়ুন
বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাবের গল্প
১৩৪২ সালে লখনৌতির শাসক আলি মুবারককে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে নেন হাজি ইলিয়াস। কেউ কেউ বলেন, ইলিয়াসের আদি নিবাস ছিল পূর্ব ইরানের সিজিস্তান। আবার কোনো কোনো মধ্যযুগীয় গ্রন্থ অনুযায়ী তিনি ছিলেন আলি মুবারকের বৈমাত্রেয় ভাই কিংবা ভৃত্য। সে যাই হোক, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সিংহাসন দখল করে তিনি ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ উপাধি ধারণ করেন। এরপর তিনি সাতগাঁও আর সোনারগাঁও দখল করে নেন। তাঁর রাজধানী ছিল পান্ডুয়া। সমস্ত বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন শুরু হয়। এর আগে কোনো সুলতান গোটা বাংলায় রাজত্ব করেননি। ইলিয়াস শাহ দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য আক্রমণ করে ত্রিহুত দখল করে নেন, এগিয়ে যান হাজিপুর পর্যন্ত। চম্পারণ, গোরক্ষপুর, বারাণসী নিজের অধীনে আনেন। নেপাল এবং উড়িষ্যা আক্রমণ করে লুঠ করেন প্রচুর ধনরত্ন।
ততদিনে দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। ইলিয়াস শাহের ক্ষমতা বাড়তে থাকায় তিনি আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে দিল্লির সাম্রাজ্যে ইলিয়াস শাহ আঘাত হানলে ফিরোজ শাহ পাল্টা বাংলা দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৩৫৩ সালে ৯০ হাজার অশ্বারোহী, প্রচুর সংখ্যায় পদাতিক, ধনুর্বিদ এবং এক হাজার রণতরী নিয়ে পান্ডুয়ার দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন তিনি। চম্পারণ, ত্রিহুত, গোরক্ষপুর দখল করে নিয়ে কোশী নদী পার করে পান্ডুয়া দখল করে নেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। ইলিয়াস শাহ তাঁকে কোনো বাধা দেননি, নিজে পরিবার-পাত্র-মিত্র নিয়ে একডালা দুর্গে আশ্রয় নিলেন। এই দুর্গ কোথায় ছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। কেউ বলেন এটি মালদায়, কারও মতে এটির অবস্থান ঢাকা অঞ্চলে। আবার কোনো কোনো গবেষকদের মতে দিনাজপুর অঞ্চলে ছিল একডালা দুর্গ।
বেশ কয়েক মাস অবরোধের পরও ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ দখল করতে পারেননি। বাংলার পাইক বাহিনী তখন মরণপণ লড়াই করেছিল। যুদ্ধে নিহত হন পাইকদের সর্দার সহদেব। এরই মধ্যে বর্ষা চলে আসে। মশা, মাছি, সাপের উপদ্রবে ফিরোজ শাহের বাহিনী কাহিল হয়ে পড়েছিল। ফিরোজ শাহ তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন পান্ডুয়ার দিকে ফিরে যেতে। ইলিয়াস শাহ তখন দুর্গ থেকে বেরিয়ে দিল্লির বাহিনীকে আক্রমণ করেন। কিন্তু, সুবিধে করতে না পেরে আবার আশ্রয় নেন একডালা দুর্গে। শামস-ই-সিরাজ আফিফ লিখেছেন যে, ফিরোজ শাহ একডালা আক্রমণ করতে গেলে মুসলিম মহিলারা দুর্গের ছাদে উঠে কাঁদতে থাকেন। তখন ফিরোজ শাহের মনে করুণার উদ্রেক হয় এবং তিনি দিল্লি ফিরে যান। তবে, ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি। যাই হোক, ফিরোজ শাহ দিল্লিতে ফিরে গিয়ে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেন। অন্যদিকে, দিল্লির সেনাবাহিনী বাংলা ছাড়লেই ইলিয়াস শাহ তাঁর হারানো অঞ্চলগুলো দখল করে নেন। দেশ পর্যন্ত বাংলা আর দিল্লির মধ্যে সন্ধি হয়েছিল। ফিরোজ শাহ বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন, ইলিয়াস শাহ দিল্লিতে প্রচুর উপঢৌকন পাঠাতে থাকেন। দুই পক্ষের সীমানা ধরা হয় কোশী নদীকে।
ফিরোজ শাহ তুঘলক আবার বাংলা আক্রমণের সুযোগ খুঁজছিলেন। ইলিয়াস শাহের মৃত্যু হলে বাংলার সুলতান হন তাঁর ছেলে সিকন্দর শাহ। তিনিও দিল্লিতে উপঢৌকন এবং দূত পাঠিয়ে সদ্ভাভ বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু, ফিরোজ শাহ বাংলা আক্রমণের ব্যর্থতা ভুলতে পারেননি। এরই মধ্যে সোনারগাঁওয়ের পুরোনো শাসক ফকরউদ্দিন মুবারক শাহের জামাই জাফর খান দিল্লির সুলতানকে নালিশ করেন, ইলিয়াস শাহ ও সিকন্দর অন্যায্যভাবে তাঁর শ্বশুরের সিংহাসন কেড়ে নিয়েছেন। এই অজুহাতে ১৩৫৯ সালে ৮০ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে আবার বাংলা আক্রমণ করেন ফিরোজ শাহ। সিকন্দর শাহ বাবার মতোই সামনাসামনি যুদ্ধে না গিয়ে ফের একডালা দুর্গে আশ্রয় নিলেন। ফিরোজ শাহ কয়েক মাস অবরোধ চালিয়ে দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গ দখল করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত সিকান্দার শাহের সঙ্গে সন্ধি করে বাংলা ছেড়ে চলে যান তিনি। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলার সিকন্দর শাহের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছিলেন। আবার দু’পক্ষের মধ্যে দূত ও উপঢৌকন বিনিময় চলতে থাকে। এরপর আফগান সমরনায়কের উত্থানের আগে পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর বাংলা তার স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল।
তথ্যসূত্র –
১. বাংলার ইতিহাস: সুলতানি আমল, আবদুল করিম।
২. বাংলা দেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, রমেশচন্দ্র মজুমদার।