পঞ্চাশ বছরে মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’
আজকের এই ওটিটির যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানান সংস্কৃতির যে সকল কনটেন্ট সিনেমার ভাষায় মূর্ত হয়ে চলেছে, তা আর সাধারণের নাগালের বাইরে নেই। ছবির আন্তর্জাতিক ভাষার সাক্ষী হওয়ার জন্য ‘এলিট’ দর্শক হওয়ার প্রয়োজনও বোধহয় ফুরিয়েছে। আজকের দিনে তাই বলাই যায়, যা যত বেশি আঞ্চলিক, তা তত বেশি আন্তর্জাতিক। প্রযুক্তির বদান্যতায় প্রান্তিক যেভাবে স্পটলাইটে উঠে আসে, সমকালও কালোত্তীর্ণ হয়ে যায় সৃজনশীল পাগলামির ছোঁয়ায়। যুগের হুজুগে যারা কাঁধ মিলিয়েছেন অনিশ্চয়তাকে আঁকড়ে ধরে, ইতিহাস কি ভুলে যেতে পারে অমরত্বের প্রত্যাশাহীন সেই দুঃসাহসী মানুষদের? ক্রমাগত নিজেকে ভাঙা-গড়ার এই নির্মম খেলায় যারা মেতেছিলেন বাঙালি চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও চিন্তক মৃণাল সেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
‘পদাতিক’ প্রসঙ্গে আরেকটি যে বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় তা হল, নারীমুক্তি ও সচেতনতা বিষয়ে এক আকর্ষণীয় ডিসকোর্স নায়িকা শীলা মিত্রের সঙ্গে অপর কয়েকজন মহিলার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে এসেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজ পরিবর্তন নারীর অবস্থানকে পুরুষের সমপর্যায়ে যে উন্নীত করতে পারেনি সেই সত্য এবং সেই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বামপন্থী আদর্শকে বেছে নেওয়ার যে পথ বেরিয়ে এসেছে ইন্টারভিউয়ের শেষে, তাকে কি বামপন্থী প্রোপাগান্ডা বলা চলে? আসলে তৎকালীন সমাজ ও সময়ের বাস্তবতাকে বোঝার জন্য তাঁর হাতিয়ার ছিল মার্ক্সবাদী বীক্ষণ।
অধ্যাপক ও চলচ্চিত্র-সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে ধার করে বলতে হয়, “সময়ের সঙ্গে এত তীব্র সহবাস, নিজের সময়ের ঠোঁটে এরকম চুম্বনের দাগ আর কেউই রেখে যাননি। না সত্যজিৎ, না ঋত্বিক। তাঁরা মহাকাব্যপ্রণেতা হতে পারেন কিন্তু হয়তো ইস্তেহার লেখার দায়, স্বেচ্ছায় ও সানন্দে, মৃণাল সেন নিয়েছিলেন।” (মৃণাল সেন – সময়ের স্বাক্ষর, বাংলা লাইভ.কম, ১৪ মে, ২০২৩) তাই তো কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই নান্দনিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছিলেন দৈনন্দিনতাকে। এই ‘ক্ষুধার নন্দনতত্ত্ব’ই নিবিড়ভাবে ছুঁতে পেরেছিলো মধ্যবিত্বের বারোমাস্যা, ঠিক যেমনভাবে নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে ছুঁয়েছিল সমসাময়িক তৃতীয় বিশ্বের অর্থাৎ আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ‘ইম্পারফেক্ট সিনেমা’। সোলানাসের ‘দি আওয়ার অফ দ্য ফার্নেসেস’ (১৯৬৮), আলেয়ার ‘মেমোরিজ অফ্ আন্ডারডেভেলপমেন্ট’ (১৯৬৮) বা সেমবেনের ‘হালা’ (১৯৭৫)-র বাস্তবতার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭১), ‘কলকাতা একাত্তর’ (১৯৭২), ‘পদাতিক’ (১৯৭৩), ‘কোরাস’ (১৯৭৪)-এর মতো ছবিগুলির; নয়া-উপনিবেশবাদের সঙ্গে মধ্যবিত্তের সংঘর্ষ যার বিষয়বস্তু এবং বামপন্থার সঙ্গে অন্তহীন সংলাপ যার তাত্ত্বিক সংশ্লেষ।
মৃণাল সেনের বহুল আলোচিত ছবিগুলির মধ্যে সত্তরের দশক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময়েই নির্মিত হয় মৃণাল সেনের কলকাতা ট্রিলজি (Mrinal Sen Calcutta Trilogy) : ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা একাত্তর (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩)। আদ্যন্ত বাম-পন্থায় বিশ্বাসী মৃণাল সেনের রাজনৈতিক ডিসকোর্স অত্যন্ত সরাসরিভাবে উঠে এসেছে এসব ছবিতে। মৃণাল তাঁর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে নির্মিত ছবিগুলিকে মোটামুটি ইটালিয়ান নিওরিয়ালিজমের ধারায় এগিয়ে নিয়ে গেলেও সত্তরের দশকে নির্মিত ছবিগুলির প্যাটার্নে আমূল বদল আসে। অ্যান্টি-নিওরিয়েলিজমের পাশাপাশি ফরাসি নিউওয়েভের লক্ষণ প্রকট হতে শুরু করে। সিনেমায় গল্প বলার পরিচিত রীতিকে ভেঙে ভারতীয় ছবির গায়ে রীতিমতো উদোম হাওয়া বইয়ে দেন তিনি। কলকাতা ট্রিলজির তৃতীয় ছবি ‘পদাতিক’ বা ‘The Guerilla Fighter’ এবছর পঞ্চাশে পা দিলো।
সত্তরের দশক এক বৈশ্বিক ডামাডোলের অধ্যায়। দুর্নীতি, বেকারত্ব, অবসাদ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থার মধ্যে দিন বদলের স্বপ্ন দেখার যে রোম্যান্টিক বামপন্থী আন্দোলন এদেশে ঘটে চলেছিলো, তারই দলীয় ও উপদলীয় বিভাজন এবং দিশাহীন ভবিতব্যের ডিসকোর্স মূল কাহিনির প্রেক্ষাপট। পুলিশ হেফাজত থেকে পলাতক এক নকশাল কর্মী যুবক (সুমিত- ধৃতিমান চ্যাটার্জী) দলীয় নির্দেশে ঘটনাক্রমে আশ্রয় নেয় ডিভোর্সি এক যুবতী (শীলা- সিমি গাড়োয়াল)-র নির্জন ফ্লাটে। দলীয় নেতৃত্বের দিশাহীনতা এবং অপদার্থতায় হতাশ এই যুবক দলীয় উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ দল তাকে বিচ্ছিন্ন করে। ছবিটির কাহিনি ও সংলাপে- আশিষ বর্মন এবং মৃনাল সেন নিজে। চিত্রগ্রহণে কেকে মহাজন। আবহে আনন্দ শঙ্কর। প্রধান চরিত্রে – ধৃতিমান চ্যাটার্জী, সিমি গাড়োয়াল এবং বিজন ভট্টাচার্য।
‘পদাতিক’ ছবির শুরুতেই দেখা যায় প্রিন্টিং মেশিনে নিউজপেপার স্ক্রলিং হতে হতে হঠাৎ থেমে যায়। পরপর কিছু ফ্রিজ শটে খবরের হেডলাইন উঠে আসে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবহে চলতে থাকে সত্তর দশকের উত্তাল কলকাতার আন্দোলন, মিছিলের শব্দ। আবার নিউজ প্রিন্টারে স্ক্রলিং। তারপর স্লো-মোশানে জুম আউট হয়ে যাওয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন কলকাতা শহরের দৃশ্যের ওপর বড়ো বড়ো অক্ষরে তৎকালীন কলকাতা শহরকে নিয়ে ডায়েরি লেখার মতো স্টেটমেন্ট। পিছনে নায়কের কণ্ঠে সেই স্টেটমেন্টের শক্তিশালী ভয়েস ওভার। তারপর হঠাৎ গেরিলা পদ্ধতিতে অতি দ্রুত গতিতে চলমান ক্যামেরা চার্জ করতে থাকে উত্তাল কলকাতা শহরের অলিগলি। টাইটেল সিকোয়েন্স শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত শুধু এটুকু অংশেই ধরা পড়ে সমগ্র ছবির টেকনিক এবং বিষয়ভাবনা।
বস্তুত, মৃণাল সেনের হাত ধরেই ভারতীয় নবতরঙ্গ (ইন্ডিয়ান নিউ-ওয়েভ) রীতির সূত্রপাত। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ (১৯৫৯) বা ‘জুলে জিম’ (১৯৬২) -এ যেমন ফ্রিজ শটের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়েছে, মৃণালের ছবিতেও সেই রীতির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়, সেসময় অনেকেই যাকে ‘গিমিক’ বলে বিদ্রুপ করেন। সরলগতির গল্প বলার স্টাইলকে ভেঙে এই যে স্পেস এর জন্ম দেওয়া তা কিন্তু শুধুমাত্র দর্শককে ‘ফিল্ম’ আর ‘রিয়েলিটি’র পার্থক্যকে মনে করিয়ে দেওয়া বা কোনো বিশেষ সিনেম্যাটিক ইমেজকে হাইলাইট করার উদ্দেশ্যেই নয়, তা এসেছে অনেকটাই বাস্তবিক প্রয়োজনে। ‘পদাতিক’ ছবিতে নায়কের মাথার ওপর সিলিং ফ্যান বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে ছেদ তা কি নিছক ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া? তৎকালীন কলকাতা শহরের বিদ্যুৎ সংকট, লোডশেডিংয়ের ইতিহাস কি বিধৃত নেই এই দৃশ্যে? অভাব তো এভাবেই শিল্প হয়ে ওঠে। আঞ্চলিকতাও মিলেমিশে যায় আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে।
ব্রেস্টীয় অ্যালিয়েনেশন এবং প্যান্টোমাইমের ড্রামাটিক প্রয়োগের মাধ্যমে মৃণাল সেন ভারতীয় ছবির ভাষাকে এক অন্য পরিসরে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। তাঁর আরও কিছু জনপ্রিয় ছবির মতো ‘পদাতিক’-এও লক্ষ্য করা যায় প্যান্টোমাইমের ব্যবহার। ছবির নায়ক সুমিতকে প্রথম দেখা যায় অন্ধকারে ঘেরা আলোর ফ্রেমে শুধু একটি মুখ হিসেবে। ফোর্থ ওয়াল ভেঙে সেও ব্রেস্টীয় ভঙ্গিতে সরাসরি তাকিয়ে থাকে ক্যামেরা অর্থাৎ দর্শকের দিকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস লিখেছেন, “এরা কাহিনির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা মুখ, যারা প্রত্যক্ষ বার্তা দিতে প্রস্তুত, ডাইড্যাকটিক সংযোগ ঘটানো যাদের উদ্দেশ্য।” (মৃণাল সেন ও সিনেমার আন্তরিকতা, দেশ, ১৭ মে, ২০২৩)
সিনেমার ভাষার মধ্যে আরও কিছু নাটকীয় এলিমেন্ট লক্ষ্য করা যায় ‘পদাতিক’ ছবিটিতে। যেমন ‘কলকাতা একাত্তর’-এর ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে এই ছবিতে, যাকে মৃণাল সেন বলেছেন ‘ক্রস্-ফার্টিলাইজেশন’। সুমিত ও শীলার কথোপকথনের মধ্যে দেখা যায় হঠাৎ ভিয়েতনাম, আঙ্গোলার গেরিলা যুদ্ধের ফুটেজ। আবার ষাটের দশক থেকে উত্তপ্ত কলকাতার অলিতে গলিতে ঘুরে যেসব মিছিল, জমায়েতের ছবি তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন সেগুলোকেই বারবার ব্যবহার করেছেন ‘ইন্টারভিউ’ থেকে ‘কোরাস’ পর্যন্ত চারটি ছবিতে। রেডিওর স্থানীয় সংবাদ, খবরের কাগজের হেডলাইনের ‘অতিবাস্তব’ সব ইমেজের ব্যবহারের মাধ্যমে ফিকশনকে প্রায় ডকুমেন্টেশনের পর্যায়ে উন্নীত করতে পেরেছিলেন তিনি। সমকাল, ইতিহাস এভাবেই বারবার সিনেম্যাটিক ন্যারেটিভে ঢুকে পড়ে জন্ম দেয় এক অস্থিরতা ও অস্বস্তির। এবং এখানেই তিনি পুরোপুরি আলাদা হয়ে যান সমকালীন মায়েস্ত্রো সত্যজিতের থেকে। সমকালের ঋত্বিক ঘটকের ছবিতেও এক পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপটিক অস্থিরতা ও অস্বস্তি রয়েছে, কিন্তু তা মূলত দেশভাগ জনিত যন্ত্রণার অন্তর্লীন আর্তনাদ হয়ে মহাকাব্য হয়ে উঠেছে, আর মৃণাল সেখানে নাগরিক জীবনের অন্দরমহল থেকে রাজপথে, গলিঘুঁজিতে, ধ্বংসস্তূপের ওপর পদাতিক হয়ে অবলীলায় প্রশ্নহীন দর্শকের সঙ্গে ডিসকোর্স তৈরি করে গেছেন।
‘পদাতিক’ প্রসঙ্গে আরেকটি যে বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় তা হল, নারীমুক্তি ও সচেতনতা বিষয়ে এক আকর্ষণীয় ডিসকোর্স নায়িকা শীলা মিত্রের সঙ্গে অপর কয়েকজন মহিলার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে এসেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজ পরিবর্তন নারীর অবস্থানকে পুরুষের সমপর্যায়ে যে উন্নীত করতে পারেনি সেই সত্য এবং সেই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বামপন্থী আদর্শকে বেছে নেওয়ার যে পথ বেরিয়ে এসেছে ইন্টারভিউয়ের শেষে, তাকে কি বামপন্থী প্রোপাগান্ডা বলা চলে? আসলে তৎকালীন সমাজ ও সময়ের বাস্তবতাকে বোঝার জন্য তাঁর হাতিয়ার ছিল মার্ক্সবাদী বীক্ষণ। মার্ক্সবাদে বিশ্বাস অটুট থাকলেও তৎকালীন কমিউনিস্ট দলের প্রতি তাঁর যে প্রশ্নহীন আনুগত্য ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। আমাদের নায়ক সুমিত আসলে মৃণাল, মৃণালই পদাতিক। তাই তাঁর সকল রাজনৈতিক ছবিই সমাজ-বাস্তবতার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ডাইড্যাকটিক অর্থাৎ ডিসকোর্স হয়ে উঠেছে, প্রোপাগান্ডা সেখানে অধরা।
মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’ পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও ঘটেছে অনেক। তবু ‘পদাতিক’-এর মৌলিক প্রশ্নগুলি আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? দুর্নীতি, বেকারত্ব, হতাশা আর দিশাহীনতার কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা? আবার সমাজ-বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে যদি এ সময়ের সিনেমার দিকেও তাকানো যায় তাহলেও হতাশ হতে হয়। আমাদের বর্তমান সেই অর্থে শান্ত ও অনুদ্বিগ্ন নয়, তবুও শুধুই নির্বোধ শিল্প আর প্রোপাগান্ডায় গা ভাসিয়ে চলেছি আমরা। ইতিহাস সচেতনতা এবং আত্ম-সচেতনতার অভাবই বোধহয় আমাদের শৈল্পিক বন্ধাত্বের মূল কারণ।