‘ভুবন সোম’-এর ৫০ বছর

১৯৬৯। মৃণাল সেন চলচ্চিত্রের ফর্ম নিয়ে ভাবতে বসলেন। সত্যজিৎ-ঋত্বিক জমানার সম্পূর্ণ বাইরে বেরিয়ে এসে মৃণাল শুধুমাত্র ছবির বিষয়বস্তুতেই থেমে না গিয়ে, ছবির গতি নিয়ে ভাবলেন। তখনকার ইউরোপিয়ান ছবির পরিচালক, যেমন এন্তোনিওনি, গোদার, বার্গম্যান কিংবা ফেলিনি চলচ্চিত্রকে জীবনের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পেরেছিলেন বা রাজনীতির কিছু সূক্ষ অংশ সিনেপর্দায় নিয়ে এসেছিলেন। মৃণাল সেন এমন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি তাঁর ছবিকে আন্তর্জাতিক স্তরে শুধু নিয়েই যাননি, একটা কনভারসেশন তৈরি করতে পেরেছিলেন। ‘ভুবন সোম’ ছবিটি ২০১৯ সালে ৫০ বছরে পা দিল। মৃণাল সেন নির্মিত প্রথম হিন্দি ছবি এবং ঘটনাচক্রে ব্যবসাসফল ছবি এটিই। বনফুলের গল্প অবলম্বনে এই ছবি তৈরি হয়।
‘ভুবন সোম’ ছবিতেই মৃণাল প্রথম প্রথাগত ধারাকে প্রত্যাখ্যান করে সিনেমার ফর্ম নিয়ে খেলা করেছেন নিজের মতো। সিনেমার কৌশল নিয়ে ভাবলেন এবং ভাবালেন। ভুবন সোম একজন বাঙালি। তবে টিপিক্যাল নন। কারণ মৃণাল সেন বরাবর এই টিপিক্যাল ঘরানার বাইরেই থাকতে চেয়েছেন। ভুবন সোম রেলওয়ের বড়ো অফিসার। নীতিবান, একনিষ্ঠ, সৎ এবং নিয়মনিষ্ঠ একজন মানুষ। চেন্স স্মোকার। ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায় ভুবন সোম নেম প্লেট লাগানো একটা দরজা, তার ভেতরে টেবিল জুড়ে অসংখ্য ফাইল, একটা কলম ফাইলে সই করে যাচ্ছে, আবহে রিং হচ্ছে ফোনে, একটা সিগারেট জ্বলছে অথচ চেয়ারটা ফাঁকা। অর্থাৎ মানুষটি অদৃশ্য। এই দৃশ্যের ক্ষেত্রে পরিচালক অ্যানিমেশন ব্যবহার করেছেন। এই একটি দৃশ্যেই চরিত্রটি আরও গভীর হয়ে উঠল। ভুবন সোম কখনও পাখি বিষয়ক বই পড়েন, কখনও সেনাবেশে গাড়িয়ালের কণ্ঠে গান শোনান- “চাহে কই মুঝে জংলি কাহে, ক্যাহতাহে তো ক্যাহতা রেহে...”। তাঁর পরিবর্তনের এটাই হয়তো কোনো আগাম সংকেত।
এই ছবিতে অভিনেতা উৎপল দত্ত নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। ছোটো ছোটো এক্সপ্রেশনের রাজা ছিলেন তিনি। তিনি একজন নীতিবান রেল কর্মকর্তা। কর্মসূত্রে আলাপ হয় গ্রামের মেয়ে গৌরির সঙ্গে। উৎপল দত্ত ভারতীয় সিনেমার দর্শকদের বুঝিয়েছিলেন চরিত্রের অভিব্যক্তিবাদ। আর ভুবন সোম মৃণাল সেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। আসলে জীবনের দেখা আর দেখার জীবন কোথাও গিয়ে মিলেমিশে যায়। নতুন রাস্তা খুঁজলেও বোধ উপস্থিত থাকে সেখানে। দেখার উপলব্ধি সেই পথের পথিক। দৈনন্দিন জীবনের খুব ছোটোখাটো জিনিসগুলোই মৃণাল তাঁর ছবির মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন। অথচ এই বলতে চাওয়ার রাস্তাতেই এনেছেন নতুন ফর্ম। সিনেমা হয়ে উঠেছে সাহিত্য কিংবা চর্চার অন্য একটা মাধ্যম।
কয়েকদিন আগেই আমরা মৃণাল সেনকে হারিয়েছি। তিনি এখন নেই, অথচ ভারতীয় দর্শকের বুকের ভিতর ভুবন সোম নামক একটি সৃষ্টির পঞ্চাশ বছর পালিত হচ্ছে। হোক না নীরব ভাবে, কিন্তু ভোলেনি কেউ। কারণ ভুবন সোমকে ভুলে গেলে ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটা অধ্যায়কে ভুলে যেতে হবে।