No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মানিব্যাগ আনতে গিয়ে ইক্যুয়েশনে ডুবে গেলেন 

    মানিব্যাগ আনতে গিয়ে ইক্যুয়েশনে ডুবে গেলেন 

    Story image

    পাপিয়া দেবী অশ্রু
    বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্বভাবে ছিলেন একজন আত্মভোলা কবি। পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন। প্রায়শই পরনের ফতুয়া ভুল করে গায়ে না জড়িয়ে কাঁধে চাপিয়ে রাখতেন। জুতোর অবস্থাও ছিল এমন যে প্রায় সময়ই দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে সবখানে ঘুরে চলে আসতেন। মাথায় তো চিরুনি বোলানোর কথা তাঁর সজ্ঞানেও আসত না হয়তোবা। কিন্তু এই খেয়ালি মানুষটি যখন অঙ্ক কষতে বসতেন তখন আর সময়জ্ঞান হিসেবে থাকত না তাঁর। আবার কখনও কখনও জটিল ধারার অঙ্ক থেকে ছুটি নিয়ে ডুবে যেতেন সাহিত্য এবং সঙ্গীতের জগতে। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত এবং সাহিত্যেও ছিল তাঁর আন্তরিক আগ্রহ ও বিশেষ প্রীতি। প্রায়ই তাঁকে দেখা যেত সদ্য প্রকাশিত ফরাসি বইয়ের মধ্যে গভীরভাবে ডুবে থাকতে।

    সত্যেন্দ্রনাথ একজন ভালো সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন বটে। উচ্চমানের সঙ্গীত শোনার জন্য তিনি রাতের পর রাত জেগেই কাটিয়ে দিতেন। তিনি খুব ভালো এস্রাজ বাজাতেন। মন খারাপের সময়গুলো কাটাতেন এস্রাজের সুর-সাধনার জগতেই। যখন তিনি কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন থাকতেন তখনই বেজে উঠত তাঁর এস্রাজের সুর। ঢাকা থাকার সময় তাঁর এই অভ্যাস নিয়মিতই ছিল। অনেক সময় তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সঙ্গীতের সুর নিয়ে গবেষণা করতেন। নতুন করে তিনি সুর সৃষ্টি করতে চেষ্টা করতেন। তিনি সম্পূর্ণ সচেতনতার সহিত এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে শেখার চেষ্টা করতেন ঠিক যেমন একই স্বভাব ছিল তাঁর গবেষণা কর্মের ক্ষেত্রে।

    বাগান করা ছিল তাঁর কাছে শখের ঘরানা ব্যাপার। সময় ও সুযোগ পেলেই তাঁর শখের বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সাহিত্যজগতে আনাগোনার মধ্য দিয়ে তাঁর পরিচয় ঘটে সাহিত্য জগত দিকপাল বুদ্ধদেব বসুর সাথে। আর তাঁর সে পরিচয় কালের আবর্তে পৌঁছে গিয়েছিল কলকাতার ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ‘কবিতা ভবন’ দ্বারপ্রান্তে। সেখানে প্রায় সময় সত্যেন্দ্রনাথ যেতেন, আড্ডা দিতেন, সময় কাটাতেন। আড্ডার আসরে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। কথিত আছে, তিনি বুদ্ধদেব বসুর ‘মেঘদূত’ এবং বদলেয়ার অনুবাদ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছিলেন।

    ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও অনেক সময় তাঁর মতামত নিতেন। তিনি গান গাওয়া, এস্রাজে সুর তুলে গণিতজ্ঞদের নিয়ে অনেক মজার রসিকতায় কবিতা ভবন মাতিয়ে তুলতেন। তাছাড়া গায়িকা রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে অনর্গল জার্মান আর ইতালীয় ভাষায় মজার অনেক গল্পও করতেন।

    বাংলা সাহিত্যের উপর তাঁর ছিল অগাধ পড়াশুনা। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ছিল তাঁর সবিশেষ ঝোঁক। এ নিয়ে একটা গল্প বেশ প্রচলিত আছে। একবার সত্যেন্দ্রনাথের ঢাকার বাড়িতে অন্নদাশঙ্কর রায় গিয়েছিলেন। দেখেন কী, মশারির ভেতরে শুয়ে শুয়ে ‘প্রোফেসর’ বই পড়ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাঁর পড়া বইগুলোর কোনোটি কিন্তু বিজ্ঞানের বই নয়। আরেকদিন তাঁকে দেখেছিলেন প্রাকৃত ভাষায় লেখা ব্যাকরণ বই পড়তে। সত্যেন্দ্রনাথের লেখালেখিতে পাওয়া যেত এক পুরোদস্তুর সাহিত্যিকের ছোঁয়া। তাঁর বিভিন্ন লেখা পড়লে তা সহজেই বোঝা যায়।

    প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়কার ঘটনা। সে সময় তিনি একটি রোমান্টিক গল্প এবং একটি প্রবন্ধ লিখে ভীষণ বাহবা পেয়েছিলেন। তাঁর আরেকটি খেয়াল ছিল টেনশান কাটাতে ইনডোর খেলা। আই এস সি তে থাকাকালীন তিনি নতুন নতুন ক্যারম খেলা শিখেছিলেন। পরে সে খেলায় দিনরাত এক করে খেলতে শুরু করেন, তাতে অবশ্য মায়ের বকুনি কোনো অংশেই কম শুনতেন না, অথচ ক্যারমের নেশা যেন তাঁকে ছাড়েই না! এত বুঁদ হয়ে খেলার পরেও কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টে কোনো হেরফের হত না। বরঞ্চ প্রথম শ্রেণীতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাদাম কুরি, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নিয়মিত যোগাযোগ হত। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের ‘বিশ্বপরিচয়’ বিজ্ঞানগ্রন্থ, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘জাপানে’ ভ্রমণরচনা ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বের উপরে কাজ করে অনেকেই নোবেল পেলেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে কিন্তু নোবেল দেওয়ার কথা কেউ তোলেননি।

    আত্মভোলা এক মানুষ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। এ নিয়ে তাঁর জীবনে রয়েছে নানা মজার ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একটি ঘটনা। একদিন সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার বায়না ধরল। সত্যেন্দ্রনাথ তখন গণিতের একটা জটিল সমস্যা সমাধানে চিন্তামগ্ন। তারপরও মেয়ের জোরাজুরিতে রাজি হলেন। মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেন সিনেমা হলে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে টাকা দিতে গিয়ে দেখেন মানিব্যাগ বাসায় ফেলে এসেছেন। চিন্তিত মুখে মেয়েকে সিনেমা হলের সামনে অপেক্ষা করতে বলে একই ঘোড়ার গাড়িতে বাসায় ফিরে এলেন। টেবিলের ওপর থেকে মানিব্যাগটা তুলতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টি পড়ল কিছুক্ষণ আগে শেষ করতে না পারা বৈজ্ঞানিক সমস্যাটির সমাধানের ওপর। তারপর ভুলে গেলেন সিনেমা দেখার কথা। মেয়েকে যে সিনেমা হলের সামনে একা ফেলে এসেছেন ভুলে গেলেন তাও। সবকিছু ভুলে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সমস্যাটির সমাধানে।

    এদিকে গাড়োয়ান অপেক্ষা করে আছে। কাউকে যে সে বলবে তাঁকে গাড়িভাড়া দিয়ে বিদায় করার তেমন কোন মানুষও খুঁজেও পাচ্ছিল না গাড়োয়ান। এত বড় বিজ্ঞানীর বাড়িতে হাঁক-ডাক করারও জো নেই। দু’ঘন্টা পরেও যখন বিজ্ঞানী বের হচ্ছেন না তখন গাড়োয়ান সাহস করে ঘরে ঢুকে দেখে বসু চেয়ারে বসে অংক কষছেন। গাড়োয়ান যখন ডাক দিল সত্যেন্দ্রনাথ চমকে উঠলেন, “কী হল?” গাড়োয়ান সিনেমায় যাওয়া আর মেয়ে সিনেমা হলে একা অপেক্ষা করছে বলাতে সত্যেন্দ্রনাথ সম্বিত ফিরে পেলেন এবং তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।

    (ঋণ – রোর বাংলা)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @