কলেজস্ট্রিটের ফেলুদা, যিনি আবার সরবৎ-ও বানান

আবার এসেছেন ফিরে পাতা পিঁড়িটির নীড়ে খাদ্য-সমুখে এই বাংলায়। বন্ধুগণ, তিনি ফিরে এসেছেন। দামোদরস্তয় শেঠস্কি। ওঁর দাদুর দাদুকে চেনেন, শ্রীযুক্ত দামোদর শেঠ। তিনি অল্পতে খুশি ছিলেন না সেসব তো আপনারা জানেনই, তাই বাংলা ভাগ বাটোয়ারার দুঃখে এদেশ ছেড়ে সপরিবারে চলে গেলেন রাশিয়া! রাশিয়া তখন বৃহত্তম দেশ। জল গড়িয়ে গেল বহুদূর। রাশিয়াও টুকরো টুকরো হয়ে পিৎজা হাট হয়ে গেল। সেই দুঃখ বইতে বইতে তিনি আবার ফিরে এলেন, কোনও পিৎজা নয় বার্গার নয়, হট ডগ নয়, নিছক সাধারণ বাঙালির খাদ্যখাবার সন্ধানে। দামোদরস্তয় শেঠস্কি শুরু করলেন তাঁর খাদ্যান্বেষণ।
পাতের শুরুতে সরবত, বুঝলেন কি না। খিদে নামক বীজের গোড়ায় তাকে আরও চাগাড় দিতে গলা ভেজানোর এমন মোক্ষম উপাদান আর কীই বা আছে! শুরুর দিনে আজ আমি খাদ্যান্বেষী। বেশ একটা একটা সত্যান্বেষী গন্ধ, হুঁ হুঁ… তার আগে একটু বইটই ঘাঁটব বলে বইপাড়া চত্বরে গেছলুম আরকি। বাংলা ভাষা এখন কেমন চলছে, এগোচ্ছে, একটু স্বাদ নেওয়ার সাধ। একটু হাঁটাঘোরা, বই নাড়াচাড়া করতে না করতেই খিদের টিকি টং করে উঠল। তার ওপর আমার নধরকান্তি, জিনে পাওয়া চেহারা বুঝলেন কি না। হাঁফ ধরছিল। তার ওপর যা গরম! ঠিক এমন সময় পাশ দিয়ে দুই কলেজ ছোকরা বলতে বলতে চলে গেল- ‘আররেহ চ, ফেলুদার সরবত খেলে সবাই পাস হয়ে যায়, নো টেনশন!’
তা বন্ধুরা, টেনশন-এর বাংলা হল দশটি ছেলে। আর আমি সেই হারাধন, বাংলায় ফিরতে পকেটের অর্ধেক টাকা পরিযায়ী পাখির ডানা গজিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গেছে। প্যারামাউন্ট মোর সইবেনিকো। ওই দামে সরবত খেয়ে গলা কেটে আমি কণিস্ক হইবনিস্কো! তাই রাস্তার খাদ্যই মোর রাস্তাপপুলাস!
বঙ্গোপসাগর আর মায়ানমারের পাশে এই কলেজ স্ট্রিট। আহা, চমকাবেন না। মানে গুগল ম্যাপে সার্চ করতে প্রথমে এটাই দেখিয়েছিল। বিশ্ব এখন দু’রকম। নেট স্লো থাকলে একরকম, ফাস্ট থাকলে আরেকরকম। স্লো থাকলে বঙ্গোপসাগরের ওপর দেখা যায় এটিএম কাউন্টার, বাংলাদেশের উত্তর দিনাজপুর আর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর মিশে গেছে। এমনই উপরিপাতন যে কোনও বেড়াজাল নেই আর দেশে দেশে। নেট স্লো থাকার একমাত্র এই আনন্দ কোনওভাবে বাদ দেওয়া যায় না। আর আমার তো এই গুগল ম্যাপ ভরসা।
সূর্যসেন স্ট্রিট ধরে কলেজ স্কোয়ার ঘেঁষে ধ্যানবিন্দু, প্যারামাউন্ট ছাড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে এবং অবশ্যই দুই ছোকরার পিছু নিতে নিতে আমি যেখানটায় গিয়ে দাঁড়ালাম সেটা বঙ্কিম স্ট্রিট বঙ্কিম হওয়ার একদম গোড়ায়। যেখান থেকে রাস্তা বাঁক নিয়েছে এম. জি. রোডের দিকে। ঘাড় বাঁদিকে ঘোরালে প্রেসিডেন্সি কলেজ। একটু এগিয়ে ডান দিকে চলে গেছে হরিদাস পাল স্ট্রিট, আরেকটু এগোলে কফি হাউস। ঘাড় ডানদিকে ঘোরাতেই দেখি উপরে হোর্ডিং ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল। তার তলায় দুই ছোকরা দাঁড়িয়ে। আর এক পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট সাইজের ঠ্যালাগাড়িতে লেখা ‘ফেলুদার স্পেশাল আমপোড়া সরবৎ’। বাংলা ভাষায় ‘ৎ' উঠব উঠব করছে, আর ইনি এই অক্ষরকে জলে ভিজিয়ে জিইয়ে রেখেছেন। রামধনু ছাতার তলায় সহাস্য এক ছয় ফুট এক ইঞ্চির ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। মানে, জাস্ট এক ইঞ্চির জন্য আসল ফেলুদাকে দেখার চান্স মিস হয়ে গেল। বিশ্বাস হচ্ছে না?
‘আপনি আমার কথা বিসোয়াস করছেন না?’, মগনলাল মেঘরাজ সবুজ ঘোলা সরবত বাড়িয়ে দেওয়ার পর এমন কথাই মোহনভোগবাবু থুড়ি, লালমোহনবাবুকে বলেছিলেন। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর সেই সরবতের মতো শিরদাড়াকে স্ট্র বানিয়ে গা ঠান্ডা করা দৃশ্য মনে পড়ছে? লালমোহনবাবু বিষের ভয়ে বিষম খেলেও, বাজি লাগিয়ে বলতে পারি, এমন কোনও নাম গুলিয়ে যাওয়া বা বিষম খাওয়া কোনওটাই আপনার হবে না। হাতের মুঠোয় দাম মগনলালের পেয়াদার বানানো সরবত এ নয়। সর্বোপরি ফেলুদার সদাহাস্য মুখের আতিথেয়তায় কুলকুল ঠান্ডা সরবতের চুমুকে চুমুকে হৃদয়ের উষ্ণতা। গলা ব্যথা যাক কোকাকোলা ব্যাং-এর ডাকে!
দেখতে দেখতে দশ বারো বছর পেরোতে চলল। সেই কবে থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে ডায়মন্ড হারবার থেকে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছনো। তারপর মেচুয়া বাজারে লেবু কেনা, পুদিনা বাড়ি থেকেই। আর প্যাকেটের ভেতর বিটনুন, জলজিরা আর কী কী মেশানো মোক্ষম ওই মশলা, এই ফেলুদার ‘সরবতাস্ত্র’, যা তৃষ্ণার্ত পিয়াসী মানুষকে জিভের টাকরায় গিয়ে ঘায়েল করবেই করবে। আলাদা করে চামচ লাগে না, চকচকে ছুরি দিয়ে লেবু কেটে সেই ছুরি দিয়ে না দেখেই আন্দাজমতো নুন গ্লাসে ঢেলে দিচ্ছেন ফেলুদা। তারপর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর মতো এক গ্লাস থেকে আরেক গ্লাসে উড়ন্ত জল মিশে যাচ্ছে কখনও আম পোড়ায়, কখনও পুদিনা ছ্যাঁচায়, কখনও বা নিকাটো লেবুর নির্যাসে। সঙ্গে হাওয়ায় হাওয়ায় তাতে মিশে যাচ্ছে ফেলুদার ছুঁড়ে দেওয়া লাজুক হাসি। এ কি মার্শিয়াল আর্টের চেয়ে কিছু কম? এক ফোঁটা জলও বাইরে গিয়ে পড়ছে না!
‘ভালোবেসে মা এই ডাকনামই দিয়েছিল’, ফেলুবাবু বললেন। মুখে সেই লাজুক হাসি। হিন্দু স্কুলের অভিভাবক থেকে শুরু করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বইপাড়ার ক্রেতা-বিক্রেতা, মায় স্কুলের ছাত্রছাত্রী, কলেজের ছোঁরাছুঁরি সকলেই ফেলুদা-ফ্যান। ধোঁয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে সরবতের জল, স্পেশাল মশলার গন্ধ বঙ্কিম স্ট্রিটের তেমাথার মোড়ে বইপোকাকে ফেলুন্যাটিক করতে বাধ্য।
‘এলুম গেলুম জয় করলুম’-এর মতো ভালো দোকান যেমন থাকবে, তাদের পাল্লা দিয়ে ‘কলকাতার ভিতর আরেক কলকাতার’ মতো রাস্তার ওপরেও কতরকম মানিক যে ছড়িয়ে আছে, সেসবের খোঁজ আরও মজার, আরও আনন্দের। এই বেভুল বিভ্রান্তিকর ছিবড়ে ছিবড়ে মেঘ-বৃষ্টি দ্বিধার ঘাম বইপাড়া ঢুকে পড়লে, বুদ্ধির গোড়ায় বরফের ধোঁয়া আর সরবত ঢালতে ফেলুবাবুকে মিস করা বোকামোই হবে। একটু পাশে তোপসেও আছে, যদিও সে উজ্জ্বল। ফেলুবাবুর ছেলে। সেও বাবার হাত ধরে বাবার ব্যবসায়। বুদ্ধিদীপ্ত সরবতের পাশে ‘উজ্জ্বল’ সরবতের পরিচিতিও ক্রমশ আলোকময়।
খিদে এবার সপ্তমে। এবার কিছু ভাজাভুজির দিকে যেতে হইব। ভাত তো সবে হাঁড়িতে উঠল। ফুটতে দেরি। কথা হবে শিগগির!
কত কী বলার ছিল যে-
কথায় আছে- দিন আনি দিন খাই। সরবতওয়ালাদের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে- পুদিনা নিই দিন খাই! এই pun পানযোগ্য কতটা, তা নিয়ে সরবত-এ-ঈশক বলিবে। সরবতের ব্যবসা এই দাপুটে গরমজুড়ে। যদিও এদেশে বারো মাসে ৩৬০ দিন গরমই। তবুও হেরফের তো থাকেই। ফেলুদা তাই সেখানে পিছিয়ে not। শীত পড়লেই দেখতে পাবেন ওই একই জায়গায় ফেলুদা স্পেশাল মুড়িমাখা, আলু কাবলি, চুড়মুড় এসে বসেছে ফেলুদার রহস্যময় ওই মশলা নিয়ে। ভালোবাসা আসলে গভীর, কিন্তু ওপরে ওপরে এই মশলা ছড়ানো দাগ-গন্ধ আমাদের আসলে হয়রান করে দেয়- ভালোবাসা থাকে কোথায়? তাকে বৎসরবৎ খুঁজে খুঁজে মানুষ হয়রান, পথিক পরাণ, সরবত খান। ঠান্ডা জল এখানে উষ্ণতা নিয়ে বসে আছে।