কলাভবনে দলে ভারি হচ্ছে অবন ঠাকুরের ‘রসিক’ উত্তর-প্রজন্মরা

“শতাব্দীর পর শতাব্দী লন্ডন শহরের উপরে কুহেলিকার মায়াজাল জমা হতেই রইলো--- কবে এক হুইস্লার এসে তার মধ্য থেকে আনন্দ পাবেন বলে।... মোগলবাদশার রত্নভাণ্ডারে তিন পুরুষ ধরে জমা হতে লাগলো মণিমাণিক্য সোনারূপা---এক রাজশিল্পীর ময়ূর-সিংহাসন আর তাজের স্বপ্নকে নির্মিতি দেবে বলে। তেমনি যে আমরাও আয়োজন করছি চেষ্টা করছি, শিল্পের পাঠশালা শিল্পের হাট কারুছত্র কলাভবন-- এটা ওটা বসাচ্ছি সব সেই একটি আর্টিস্টের একটি রসিকের জন্য-- সে হয়তো এসেছে কিংবা হয়তো আসবে।”
‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’-তে ‘শিল্পে অনধিকার’ প্রসঙ্গে কথাগুলি বলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজো শিল্পজগতের প্রতিটি মানুষের কাছে এই কথাটি ধ্রুব সত্যি। সেই রসিকদের অপেক্ষাতেই তো শিল্পের কাছে আত্মসমর্পণ করেন শিল্পীরা। অবনীন্দ্রনাথের সাধের কলাভবনে কিন্তু এমন রসিকরা দিন দিন জড়ো হচ্ছেন। কিছুদিন আগের একটি প্রদর্শনীশালা তারই নিশ্চিত ইঙ্গিত দিয়ে গেল।
কদিন আগেই কলাভবনের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের শিল্পকর্মের পসরা সাজিয়ে হাজির হয়েছিলেন গগনেন্দ্র শিল্প প্রর্দশনীশালায় চ্যাপ্টার ‘আস’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে। আঠারোজন শিল্পী, সকলেই কলাভবনের চিত্রকলা, ছাপাইচিত্র, ভাস্কর্যের মতো ভিন্ন বিভাগে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রী। তাদের অসামান্য কিছু কাজ নিয়েই তিনদিনের এই প্রদর্শনীশালার আসর। সেখানে চোখে পড়ার মতো, বলা ভালো অবাক করে দেওয়ার মতো একাধিক কাজে শিল্পকলার নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার যথেষ্ট উপাদান লুকিয়ে।
'মা’, অনামিত্র দাস
যেমন, ছাপাইচিত্র বিভাগের ছাত্র অনামিত্র দাসের লিথোগ্রাফি মাধ্যমে করা ‘মা’ কাজটি। নিবিড় শৈল্পিক দক্ষতার পরিচয় গোটা কাজটি জুড়েই। প্রতিকৃতির অভিব্যক্তি এখানে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। চুল, চোখ, নাক, মুখের মধ্যে সচেতনভাবেই আলোছায়ার ব্যবহার করেছেন শিল্পী। তেমনই পশ্চাৎপটে ‘কনট্রি’র মাধ্যমে সৃষ্ট টেক্সচারস্ বা বুনোটে ছন্দময়তা বজায় রয়েছে। যা প্রতিকৃতিটিকে পশ্চাৎপটের থেকে আলাদা করেছে। প্রতিকৃতিচিত্রটি ‘হাফ্ বাস্ট’, প্রোফাইলে বসে দর্শকের দিকে মুখটি ঘুরিয়ে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে মূলত প্রতিকৃতি আলোকচিত্রের গঠনগত দিকটির সঙ্গেও কিছুটা সাদৃশ্য ধরা পড়ে। যেমন, যে কোনো ব্যক্তির প্রতিকৃতি কোনো একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে সুন্দর বা বেশি সুন্দর লাগে। একজন প্রতিকৃতি আলোকচিত্রীর প্রধান কাজ সেই নির্দিষ্ট দিকটি চিহ্নিত করা, যেখান থেকে তোলা আলোকচিত্র প্রতিকৃতিটিকে দৃষ্টিমধুর করে তুলবে। শিল্পী অনামিত্র দাসের প্রতিকৃতিটিতেও বসার ভঙ্গির উপস্থাপনায় যা বিশেষভাবে স্পষ্ট।
বিহান দাসের ‘স্টিচিং দ্য এম্পায়ার’
ওই বিভাগেরই ছাত্র বিহান দাসের ‘স্টিচিং দ্য এম্পায়ার’ কাজটিও যথেষ্ট প্রশংসনীয়। প্লেটোগ্রাফি মাধ্যমে সাদা কাগজের জমির ওপর কালো রং-এর প্রয়োগ, টেক্সচারসের সুনিপুণ ব্যবহার, ছবির গঠনগত সামঞ্জস্য-- সব কিছুই দর্শকের চোখ টানে। ছবিতে রয়েছে একটি সেলাই মেশিন। সেলাই মেশিনের সুচ কোনো দেশের মাথার ওপর থাকলে প্রতিনিয়তই তা বুননের মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যে বিস্তারের সখ্য রাখতে চায়। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যায় সংগ্রাম, যুদ্ধ। যার প্রতিফলন কাজটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। যা এই সময়ে অনেকটা প্রাসঙ্গিক।
‘পেইন', শ্রীলেখা আদক
শ্রীলেখা আদকের ‘আনটাইটেলড’ কাজে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মোটিফ। যার ছন্দোময় ব্যবহার লক্ষ করার মতো। কালো-সাদা রং-রেখার মোটিফের মাধ্যমে ছবির ভূমিকে অসামান্যভাবে ভেঙেচুরে নিয়েছেন শ্রীলেখা। তেমনি ছবিতে থাকা পাখি, বেড়াল, গাছের মতোই বিভিন্ন উপাদানের অবস্থানের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার দিকটিও সচেতনভাবেই শিল্পী স্মরণে রেখেছেন। কাজটি লিথোগ্রাফি মাধ্যমে করা। লিথোগ্রাফি ছাড়াও এচিং মাধ্যমে করা শ্রীলেখারই ‘পেইন, উন্ডেড’ কাজগুলির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে একাকিত্ব, বিষণ্ণতা। কাজের অধিকাংশ জুড়েই কালো রং-এর আধিক্যর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে নিঃসঙ্গ অবয়বের ভাষ্য।
'বনান্ত', ইন্দুলেখা ঘোষ
‘শিল্পকলার ইতিহাস’ বিভাগে পাঠরতা ইন্দুলেখা ঘোষ নিসর্গ-প্রকৃতির ছবি তোলার পাশাপাশি ভালোবাসেন চিত্রকলার কালি-তুলির মাধ্যমকেও। যার টানে ছুটে যান শান্তিনিকেতনের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। এরই প্রাঞ্জল প্রতিফলন ‘বনান্ত’ কাজটি। শিল্পীর দেখায় জায়গা করে নিয়েছে সাঁওতাল গ্রামের ঘর, চারপাশের নিসর্গ। কখনো স্থূল আবার কখনো সূক্ষ্ম রেখার মাধ্যমে কাগজের মধ্যে ছবির প্রাণ প্রতিষ্টা পেয়েছে। সেইসঙ্গে ছবিতে তৈরি হয়েছে আলো-ছায়ার দ্বন্দ্ব। প্রকৃতিকে তিনি কতটা নিবিড়ভাবে আত্মস্থ করেছেন ‘বনান্ত’ তারই নির্দশন।
‘অ্যান অ্যাক্ট অব পোলারাইজেশন’, সৌমাভ দাস
সৌমাভ দাসের তেলরঙের মাধ্যমে ক্যানভাসে করা ‘অ্যান অ্যাক্ট অব পোলারাইজেশন’ কাজটি একটু অন্য স্বাদের। শিল্পীর কথায় ‘পোলারাইজেশন’ একটি অতি প্রাচীন ও একইসঙ্গে অবশ্যই আজকের সময়েরও গল্প। যার ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক রয়েছে। যেমন, ভঙ্গিগত, অবস্থানগত, যৌনতার কিংবা বর্ণের দিক থেকে। আদপে সমস্ত আঙ্গিকেরই মূলগত ক্ষেত্রটি একই। ‘অ্যান অ্যাক্ট অব পোলারাইজেশন’ কাজটিতে একটি বিশেষ ভোগ্যপণ্যের মাধ্যমে সেই পোলারাইজেশনকে ধরতে চাওয়ার চেষ্টা, যার পথ অবশ্যই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির উলটোদিকে।
বিকি দাসের ‘আনটাইটেলড’
বিকি দাসের ‘আনটাইটেলড’ ভাস্কর্যে সাইকেল জায়গা করে নিয়েছে প্রাত্যহিক জীবনযাপনের উপাদান হিসাবে। আমাদের প্রতিদিনের দেখা সাইকেল যেমনটি হয় সেখান থেকে শিল্পীর দেখা অন্যরকমের। সেখানেই শিল্পীর স্বাতন্ত্র। সাইকেলের ভাঙা অংশগুলো একত্র করে সাইকেলকে নতুনভাবে গড়ে তোলার এই চেষ্টায় সকলের দেখা থেকে শিল্পীর দেখা পৃথক হয়ে ওঠেছে।
এছাড়াও, রাজা বোরোর লিথোগ্রাফি মাধ্যমে করা ‘হেলপিং হ্যান্ডস’ কাজটিও গভীর অধ্যয়নের ফসল। আবার, ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র কৃষ্ণ ঘোষ-এর করা ফাইবার গ্লাসের ‘ফিগারাল ফর্ম’ শীর্ষক কাজটিতে দুটি অবয়বের পারস্পরিক মেলবন্ধনের সম্পর্ক উঠে এসেছে। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য শিল্পীদের ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে করা কাজগুলিও যথেষ্টই প্রশংসার দাবি রাখে।
কলাভবনের ছাত্রছাত্রীদের তিনদিনব্যাপী এই প্রদর্শনীও আসলে অনেক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়ে গেল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘রসিক’রা যে দলে ক্রমশ ভারি হচ্ছে, বলাই বাহুল্য।
প্রচ্ছদের শিল্পী- শ্রীলেখা আদক
ছবি সহায়তা- ইন্দুলেখা ঘোষ, শ্রীলেখা আদক, অনামিত্র দাস, বিকি দাস ও লেখক।