No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাবা মারা গিয়েছিলেন জলে ডুবে, সেই থেকে ৩০ বছর ধরে নদীই হয়ে উঠল সংসার

    বাবা মারা গিয়েছিলেন জলে ডুবে, সেই থেকে ৩০ বছর ধরে নদীই হয়ে উঠল সংসার

    Story image

    কখনও তিনি তিস্তার খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন, আবার কখনও ফুলবাড়ি সীমান্ত টপকে মহনন্দা সাঁতরে চলে যাচ্ছেন বাংলাদেশে। উদ্দেশ্য একটাই, মানবিক ধর্ম পালন। আর এই ধর্ম পালন করতে তিনি সীমানা মানতে রাজি নন। কোথাও কোনও শিশুকিশোর নদীতে ডুবে গেলে বা কেউ নদীতে নেমে হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজতে নদীতে ঝাঁপ দেন কাশ্মীরা। এভাবে কখনও জীবিত কখনও মৃত অবস্থায় বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন তিনি। তিনি মনে করেন, হিন্দু-মুসলিম নয়, মানবিকতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আর তা পালন করতে, মানুষকে বাঁচাতে এবং অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছাকে রক্ষা করতে বারবার তিনি নদীতে ঝাঁপ দেন।

    ভালো নাম গৌরাঙ্গ রায়। সবাই কাশ্মীরা বলেই চেনেন। কাশ্মীরা নামটি আসলে জেলের ভিতরে তাঁকে দিয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজের এক ডাক্তার। সেটা ১৯৭৬ সালের ঘটনা। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল চত্বরে এক ক্যান্টিন চালাতেন গৌরাঙ্গ রায়। বিভিন্ন ডাক্তার থেকে শুরু করে ডাক্তারির ছাত্ররা তাঁর ক্যান্টিনে নিয়মিত আড্ডা দেওয়ার পাশাপাশি জলখাবারও খেতেন। ডাক্তার আর ছাত্ররা তাঁর ক্যান্টিনে বসেই চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। আর দিনের পর দিন সেসব শুনে ডাক্তারদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছিলেন গৌরাঙ্গ।

    কাশ্মীরার গাড়ির নাম কে ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ কাশ্মীরা ওয়ার্ল্ড

    পড়াশোনা তেমন কিছুই হয়নি। তৃতীয় শ্রেণি উত্তীর্ণ। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যাতায়াত ও পরে ডাক্তারির ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করে ভাঙাভাঙা কিছু ইংরেজি শব্দ ঠোঁটস্থ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল চত্বরে ডাক্তারির ছাত্রদের তীব্র আন্দোলন ও ধর্মঘট হলে তাতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন গৌরাঙ্গ। ছাত্রদের আন্দোলনে মাইক ভাড়া করা, অটো ঠিক করে দেওয়া সবেতেই তাঁর অবদান ছিল মনে রাখার মতো। আর সেই সময় পুলিশ সব আন্দোলনকারী ডাক্তার ও ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠালে গৌরাঙ্গও গ্রেপ্তার হন। তখন জেলের মধ্যে এক চিকিৎসক গৌরাঙ্গের নাম দেন কাশ্মীরা। 

    চেহারা নাকি অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো। তাই কাশ্মীরা। সেই থেকে কাশ্মীরা নামটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন মহলে। কাশ্মীরা বলেন, “আমার ক্যান্টিন যখন উঠে গেল তখন স্থির করলাম, ডাক্তর তো হতে পারব না। তবে ডেড-ডক্টর হলে ক্ষতি কি? ডেড-ডক্টর মানে মৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা। যদি পচা-গলা মৃতদেহকে যত্ন করে মৃতের আত্মীয় পরিজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়? সেই ভাবনা থেকে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া।” ডুবে যাওয়া মানুষকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা। শিলিগুড়ি পার্শ্ববর্তী এলাকায় নদীতে ডুবে যাওয়া বহু মানুষকে উদ্ধার করতে স্পিড বোট নেমেও ব্যর্থ হয়। শেষে কাশ্মীরা গিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন দেহ। এর জন্য তাঁকে নদী সাঁতরে বাংলাদেশেও যেতে হয়েছে। 

    এখন তাঁর বয়স ৬৬ বছর। আর এই অন্যরকম মানবিক কাজ করে চলেছেন ত্রিশ বছর ধরে। এখনও পর্যন্ত দশ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন তিনি। শুধু জলে ডুবে যাওয়া দেহ উদ্ধারই নয়, গাইশাল ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে অন্যত্র পোকায় খাওয়া পচাগলা মৃতদেহ কিংবা কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনা হলেও পুলিশের কাছ থেকে ডাক পড়ে কাশ্মীরার। যেসব মৃতদেহ থেকে দুর্গন্ধে সবাই পালিয়ে যায় সেখানে কাশ্মীরা এগিয়ে গিয়ে দেহ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গ বা মেডিক্যাল কলেজের ময়না তদন্ত বিভাগে পৌঁছে দেন। তাঁর একটি টেম্পো বা অটো রিকশা রয়েছে। নামও দেওয়া আছে তাতে। কে ওয়ার্ল্ড। মানে কাশ্মীরা ওয়ার্ল্ড। আমেরিকা থেকে পাহাড় বেড়াতে আসা কোনও পর্যটকের দেহ উদ্ধার করে বিমানবন্দর পর্যন্ত  সেই পর্যটকের আত্মীয়র কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজও তিনি করেছেন। তাই অটোতে নিজের নামের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড কথাটি জুড়ে দিয়েছেন তিনি।

    পুলিশ সামান্য কিছু টাকা গুঁজে দেয়, তা দিয়ে কোনওমতে সংসার চলে কাশ্মীরার৷ কাশ্মীরা বলেন,  “আমার অটোয় মৃতদেহ ওঠে। আমার সংসার আছে। তাই কিছু টাকা আসে বটে। কিন্তু আসল কাজ হল, সেবা।” তবে নদীতে কেউ ডুবে গেলে অন্য উদ্দীপনায় কাজ করেন কাশ্মীরা। কারণ, তাঁর বক্তব্য, বাবা যতীনচন্দ্র রায় নৌকায় মারা গিয়েছিলেন বাংলাদেশ (তখন পূর্ব পাকিস্তান)  যাওয়ার সময়। ভারতে তাদেরকে রেখে তাঁর বাবা বাংলাদেশের বাড়ি দেখতে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন খুব ছোটো। সেই থেকে নদী তাঁকে টানে। নদীতে ডুবে কারও মৃত্যু হোক তা তিনি চান না। তাই কেউ নদীতে ডুবে গিয়েছে শুনলেই তিনি নদীতে ঝাঁপ দেন। শিলিগুড়ির পাশে ফুলবাড়ি বা সেভকের তিস্তার কাছে একটি স্পিড বোট ক্লাব চান কাশ্মীরা। বহুবার তিনি এই কাজের কথা উপরমহলে জানিয়েছেন। কিন্তু তথাকথিত প্রশাসনিক সাহেবরা পড়া-লেখা জানেন না বলে কাশ্মীরার কথাকে গুরুত্ব দেননি। যদিও এখন বিভিন্ন মহল শিলিগুড়ি বাগডোগরা গোঁসাইপুরের বাসিন্দা কাশ্মীরাকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করেছে। এবছরই ডিসেম্বর মাসে শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ পৌষমেলা কমিটি কাশ্মীরাকে সংবর্ধনা জানানোর প্রস্তুতি নিয়েছে বলে মেলা কমিটির তরফে বিশিষ্ট সমাজসেবী জ্যোৎস্না আগরওয়াল জানিয়েছেন।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @