‘হ্যাপি টু ডিসটার্ব’ থেকে ‘টুম্পা’, ‘বিরহী’ – খোলামেলা আড্ডায় ‘চর্চিত’ সায়ন

বঙ্গদর্শনের সিনিয়ার সাব-এডিটর সুমন সাধুর মুখোমুখি রেডিও জকি ও অভিনেতা সায়ন ঘোষ। হেমন্তের এক দুপুরে আড্ডা জমে উঠল তুঙ্গে। উঠে এল হাল-আমলের হালহকিকত।
সুমনঃ একটা সময় শোনা যেত, রেডিওর সবচেয়ে বদমাশ আরজে-র নাম সায়ন ঘোষ। আপনার ‘হ্যাপি টু ডিসটার্ব’ একটা সময় প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু রেডিওর পেশা থেকে অভিনয়ে চলে এলেন কীভাবে?
সায়নঃ আমি কিন্তু অভিনেতা অনেক আগে, রেডিও জকি পরে হয়েছি। অভিনয়ে ভালো কাজ পাচ্ছিলাম না বলে রেডিওর চাকরি নিয়েছিলাম। তার মানে এই নয় যে, রেডিওটা ফাঁকিবাজি করে করেছি। কিন্তু আমি যেভাবে রেডিওকে দেখতে চাইছিলাম, সেভাবে কাজ এগোচ্ছিল না। ফলে একটা সময় পর রেডিও বোরিং হয়ে যেতে লাগল। কারণ রেডিও ধীরে ধীরে অডিও-ভিস্যুয়াল হয়ে গেল। শুনছি আবার দেখছি – দুটোই পাশাপাশি চলছে। এই মাঝামাঝি জায়গায় আমি থাকতে চাইছিলাম না। কমফোর্ট জোন থেকে বেরনোটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। অভিনয় আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছে, শেখাচ্ছে। এবং রেডিওর মতো অভিনয়টাও এখন দারুণ এঞ্জয় করছি।
সুমনঃ এখনকার প্রায় সমস্ত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওয়েব সিরিজে আপনাকে দেখা যাচ্ছে, যা তথাকথিত বড়ো হাউসের ছত্রছায়া থেকে অনেক দূরে৷ যদিও প্রায় সমস্ত সিরিজই ভাইরাল। বড়ো হাউস থেকে অফার এলে কি না করে দেন?
সায়নঃ আমি না করার কেউ নই। বরং বড়ো হাউস আমাকে বারবার রিজেক্ট করেছে। আমাকে নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা স্বাধীন নির্মাতারা করেছেন, বড়ো হাউস সেই সাহসটা দেখায়নি। তাছাড়া বড়ো হাউসের কাজে আমাকে ছোটোভাবে ব্যবহার করা হয়। হয় নায়কের বন্ধু, কিংবা পাড়ার একটা বদমাশ ছেলে কিংবা কারোর অ্যাসিস্টেন্ট। তাতে অভিনয় দেখানোর বিশেষ জায়গা থাকে না। ফলত পরবর্তীতে আমাকে আমার মতো একটা পথ বেছে নিতে হয়েছে। এমন একটা পথে এসে দাঁড়ালাম, যেটা বাংলায় এর আগে কেউ সেভাবে দেখাননি। আমার কাছে রাস্তাটা ফাঁকা ছিল। আর নিজেকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে আমি সবসময় ভালোবাসি।
বড়ো হাউসে নির্মাতা এবং দর্শকদের মাঝে একজন মিডল ম্যান থাকেন, যিনি দর্শকদের রুচিটা নির্ধারণ করে দেন – এই অভিনেতাকে নিলে দর্শক দেখবে না এবং একে নিলে দেখবে। কিন্তু ইউটিউবের মতো স্বাধীন প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যস্থতা কেউ করে না। সেখানে নির্মাতা এবং দর্শকদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে।
সুমনঃ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করা কি খুব সচেতন সিদ্ধান্ত?
সায়নঃ হ্যাঁ, একেবারেই। ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাজে কিন্তু টাকা থাকে না। বড়ো হাউসের কাজ অনেকটা বারোয়ারি পুজোর মতো। যেখানে স্পনসর আছে, পলিটিক্যাল ফান্ডিং আছে, স্টার-মুখ আছে। কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা ইউটিউবের কাজ হচ্ছে পাড়ার সরস্বতী পুজো। কিছু চাঁদা উঠল, কিছু নিজের পকেট থেকে গেল, একটা ছোটো করে মণ্ডপ বানালাম, খিচুড়ি খেলাম – অর্থাৎ এখানে সবার কন্ট্রিবিউশন থাকে। টাকাটা আমার কাছে বড়ো বিষয় নয়। তার জন্য ইভেন্ট হোস্ট বা মঞ্চের অনুষ্ঠান নানারকম কাজ করি। এমনকি বড়ো হাউসের ছোটো কাজও করি।
সুমনঃ আপনি প্রায় সাত-আট বছর রেডিওতে সঞ্চালনা করেছেন। সেই সময় নিশ্চয় রেডিওর শ্রোতা অন্যরকম ছিল। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছেন। এখনকার রেডিও অবস্থা কেমন— কী বলবেন?
সায়নঃ রেডিওর শ্রোতা এখন দর্শক হয়ে গেছে। শ্রোতা মানে যে শোনে, পাঠক মানে যে পড়ে, কিন্তু এখন সবাই দ্যাখে। এখন যদি কোনও শ্রোতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি রেডিও শোনেন? হয়তো উত্তর আসবে, অমুক কোনও রেডিও জকির ফেসবুক লাইভ দেখি। আমি একেবারেই বলছি না সেটা ভুল কিছু। কিন্তু এটা সত্যি যে, মানুষের শোনার বা পড়ার অভ্যাসটা কমেছে। রেডিওকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এই সময়টাই এমন। আমরা একটা ডিজিটাল রেভলিউশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের হাতে এখন প্রচুর অপশন। আমরা সারাক্ষণ ছুটছি। এত অপশনের ভিড়ে আবার আমাকে ফেসবুকের রিচ বাড়াতে হবে, ইন্সটায় ফলোয়ার বাড়াতে হবে, নিজেকে আপডেটেড রাখতে হবে। ফলে কোনো জিনিসটাই আর পুরোপুরি নেওয়া হচ্ছে না, তার মধ্যে থাকাও হচ্ছে না।
সুমনঃ আপনি নিজে কি রেডিও শোনেন?
সায়নঃ এখন খুবই কম শোনা হয়। ট্রাভেল করলে শুনি।
সুমনঃ যদি আপনার উত্থান নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে দেখব ‘মীরাক্কেল’-এর মতো একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মঞ্চে আপনাকে দেখা যেত। কিন্তু মানুষ ততটা চিনল না। তারপর ‘এঞ্জয় গুরু’ অনুষ্ঠানে সায়ন-দীপাংশু জুটি মারাত্মক হিট। এই যে আপনার ভিতর একজন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান আছে, সে কোথায় গেল?
সায়নঃ সে এখন ইউটিউবে ভিডিও বানাচ্ছে (হাসি)। আমার Raw-Sayan (র-সায়ন) নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। সেখানে সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলি নানান ফরম্যাটে। সেখানে অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলেছি, যেগুলো আগে এখানকার কোনও ইউটিউবার বলেননি। দর্শককে অনুরোধ করব, আমাদের ভিডিওগুলো দেখতে।
তাছাড়া লাইভ স্ট্যান্ড আপ কমেডি এখন সত্যিই কমে গেছে। লকডাউনের পর তো আরোই কমে গেছে।
সুমনঃ ‘টুম্পা’ হঠাৎ ক্লিক করে গেল কেন? কী মনে হয়? শুধুই গানের লিরিকের জন্য? নাকি সায়ন-দীপাংশু জুটি?
সায়নঃ সবকিছুর জন্য। ‘টুম্পা’ একটা সৎ যৌথ প্রচেষ্টা। আরব দে’র লেখা এবং গাওয়া, ইন্দ্রনীল চ্যাটার্জি এবং আরবের মিউজিক, অভিষেক সাহার অ্যারেঞ্জমেন্ট, প্রতীম বিশ্বাসের ক্যামেরা, দীপান্বিতা রায়ের শিল্প ভাবনা, অমর গুপ্তের কোরিওগ্রাফি – এবং আরও যারা যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের জন্য আমরা সাফল্য পেয়েছি। আমি, দীপাংশুদা ছাড়াও সুমনা একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছে। এটাও তো কম কথা নয়! নিজেরা আনন্দ পাব – এটাই আমাদের দাবিদাওয়া ছিল। সেটাই হয়তো ক্লিক করে গেছে। দর্শক-শ্রোতারা আমাদের প্রাণভরে ভালোবেসেছেন। আর ‘টুম্পা’ দশ বছরে একটাই হয়।
সুমনঃ ‘বিরহী’-তে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? প্রতিক্রিয়া কেমন পাচ্ছেন?
সায়নঃ অভিজ্ঞতা এবং প্রতিক্রিয়া দুটিই চমৎকার। মানুষের এত তাড়াতাড়ি ভালোলেগে যাবে, ভাবিনি। ইউটিউবে রিলিজ করার ফলে মানুষ ‘বিরহী’ উদযাপন করেছেন। কারণ খোলা মনে মন্তব্য করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা।
সুমনঃ মানুষ ফ্রিতে ‘বিরহী’ দেখলেন। লক্ষ লক্ষ ভিউ হল। কিন্তু ‘বিরহী’ যদি ইউটিউবে না হয়ে অন্য কোনো ওটিটিতে রিলিজ করত, মানুষ কি হইহই করে দেখত? প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য কিন্তু ‘সেলিব্রিটি’ পরিচালক নন।
সায়নঃ পৃথিবীর যেকোনো ওটিটির চেয়ে ইউটিউবের বিস্তার অনেক বেশি। সেখানে আমাকে কোনও সাংবাদিককে আলাদা করে বোঝাতে হচ্ছে না, সবাই সবটা দেখতে পাচ্ছেন। ‘বিরহী’ এক ধরনের আর্ট-প্র্যাকটিস। এর মধ্যে যা যা উপকরণ প্রদীপ্তদা দিয়েছেন, সেগুলো মানুষ উপভোগ করেছেন। চরিত্রগুলো বোঝার জন্য আলাদা করে কোনও রেফারেন্স নিতে হয়নি। গ্রামবাংলার এই দৃশ্যগুলো আসলে চিরন্তন। তাছাড়া জমিদার, বোম বলাই, গদাই, ট্যাপা, রাধা, কৃষ্ণ সকলেই মানুষের অতি পরিচিত। তাদের চারিত্রিক গঠনের সঙ্গে মানুষ রিলেট করতে পেরেছেন। ফলে ‘বিরহী’ মানুষ উদযাপন করেছেন। ওটিটি-তে রিলিজ করলে এত সংখ্যক দর্শক আমরা পেতাম কি পেতাম না, সেটা পরের বিষয়। যেকোনো মাধ্যমেই হোক, মানুষ দেখে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, এটাই আনন্দের বিষয়।
সুমনঃ টুম্পা, লালু, ময়না — যেকোনো ‘ক্যাওড়া’ গান মানেই কি সায়ন? একঘেয়ে লাগে না?
সায়নঃ এখনও অবধি একঘেয়ে লাগেনি। রেডিও ছেড়ে যখন অভিনয়ে এলাম, আমার মূল উদ্দেশ্যই ছিল কোনো খোপে নিজেকে বন্দি না করা। একদিকে যেমন টুম্পা, লালু, ময়না করছি – অন্যদিকে তো ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘অসুখওয়ালা’, ‘বিরহী’-ও করছি। ‘টাইম আপ’ বলে আমাদের একটা নতুন সিরিজ আসছে, যেখানে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেছি। আমি কিন্তু এক্সপ্লোর করে যাচ্ছি।
‘টুম্পা’ করার পর আমার কাছে প্রচুর আইটেমের অফার এসেছিল। কিন্তু আমি ‘ময়না আর ‘লালু’-টাই বেছে নিয়েছি। যদিও ‘লালু’ আলাদা কোনো আইটেম নয়, এটা সিরিজের অংশ। আমার মনে হয়, এই দুই দিক ব্যালেন্স করার প্রবণতাটা বাংলায় খুব কম অভিনেতার মধ্যেই আছে।
সুমনঃ রেডিওতে যদি আবার যাওয়ার সুযোগ ঘটে এবং সেখানকার প্রোগ্রাম আপনাকে নিজের মতো করে সাজানোর স্বাধীনতা দেওয়া হয়, কীভাবে সাজাতে চাইবেন?
সায়নঃ এক, গানের পাশাপাশি প্রচুর কথা বলতে চাই শ্রোতাদের সঙ্গে। দুই, শুধুমাত্র বলিউড ফিল্ম মিউজিক শোনাতে চাইব না – হিপহপ, র্যাপ, বাউল, রক, ইন্সট্রুমেন্টাল এবং বিশ্বের নানান গান শোনানোর চেষ্টা করব। আফ্রিকার গান থেকে ইরানিয়ান-তামিল-রবীন্দ্রসংগীত – সব ধরনের মিউজিক শুনিয়ে শ্রোতাদের একরকম ভালো গান শোনার অভ্যাস তৈরি করব।