No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    প্রায় পাঁচ বছর ধরে তৈরি করেছেন প্রথম ছবি ‘ঝিল্লি’ : পড়ুন ঈশান ঘোষের সাক্ষাৎকার

    প্রায় পাঁচ বছর ধরে তৈরি করেছেন প্রথম ছবি ‘ঝিল্লি’ : পড়ুন ঈশান ঘোষের সাক্ষাৎকার

    Story image

    শান ঘোষ (Ishaan Ghose) একজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং চিত্রগ্রাহক। প্রায় বারো বছর ধরে তাঁর বাবা প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষের (Goutam Ghose) সঙ্গে কাজ করছেন। ‘ঝিল্লি’ (Jhilli) ঈশানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি। যা বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অফিশিয়াল সিলেকশন’-সহ এবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক বিভাগে সেরা ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে ছবিটি তৈরি করেছেন ঈশান। এর আগে তিনি গৌতম ঘোষের দুটি ছবি ‘শঙ্খচিল’ এবং ‘রাহগির’-এ সহযোগী পরিচালনার কাজ করেছেন। এবছরেই মুক্তি পাবার কথা ‘ঝিল্লি’-র। ঈশান ঘোষের চলচ্চিত্র-ভাবনা, বাবা গৌতম ঘোষের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা – সবকিছু নিয়েই এই বিশেষ সাক্ষাৎকার দিলেন বঙ্গদর্শনে। সাক্ষাৎকারটি নিচ্ছেন বঙ্গদর্শনের বিষয় সমন্বয়কারী এবং সাংবাদিক সুমন সাধু (Suman Sadhu)।

    ________________

    ‘ঝিল্লি’ তৈরি করার সময় সবচেয়ে কঠিন কাজ কী কী ছিল?

    ‘ঝিল্লি’-র শুটিং শুরু করেছিলাম ২০১৬-র শেষের দিকে। শেষ শুটিং ছিল ২০১৮-র অক্টোবরে। শুটিং শুরু করার সময় ধাপার যে ফ্যাক্টরিতে শুট করছিলাম, তার উল্টোদিকে একটা কনস্ট্রাকশন হচ্ছিল। শুনেছিলাম ভবিষ্যতে একটা পার্ক হবে সেখানে। সমস্ত স্থলরেখা (Landfall) ভর্তি করে এক ধরনের কৃত্রিম ঘাস লাগানো হচ্ছিল। কিন্তু পার্ক তৈরি হলে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হবে। ঝাঁ চকচকে পার্কের পাশে একটা জীর্ণ ফ্যাক্টরি – সমাজের চোখে বড্ড বেমানান। আমাদের ছবির শেষ দৃশ্যে এই কথাই বলা হয়েছে।

    আসলে, ধাপার মাঠে শুট করাটাই ছিল সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জিং। আমার কোনও দল (Crew) ছিল না, ছিলাম আমি আর অভিনেতারা। এই নয় যে, একদিন হঠাৎ ক্যামেরা নিয়ে চলে গেলাম আর শুটিং শুরু করে দিলাম। প্রথম থেকেই ধাপার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে প্রচুর কথা বলেছি, গল্প করেছি। মনে আছে ফ্যাক্টরিতে শুট করার সময় ভোরবেলায় চলে যেতাম। প্রথম এক-দেড় ঘণ্টা অভিনেতাদের বলতাম সকলে যেভাবে কাজ করছে, তোমরাও ওইভাবে সবার সঙ্গে কাজ শুরু করে দাও। এইভাবে অভিনেতারা অনুশীলন করেছে। ক্রমশ ফ্যাক্টরির কাজগুলো নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে এনেছে। কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে আমার পক্ষে সিনেমা বানানো অসম্ভব।

    নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে অর্থনীতির একটা অদ্ভুত সম্পর্ক। সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই আমাদের বৃহত্তর সমাজব্যবস্থাকে দেখতে চেয়েছিলাম।

    ‘ঝিল্লি’ | পরিচালকঃ ঈশান ঘোষ

    সিনেমায় ‘ইমেজ’ তৈরি – এটা আপনি কীভাবে দ্যাখেন?

    একজন পরিচালকের স্বতন্ত্র উপলব্ধি (Self Realization) এক্ষেত্রে খুব জরুরি। সে কী বলতে চায়, তার জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন –এগুলোই চিত্র নির্মাণ করতে সাহায্য করে, সিনেমার ভাষা ঠিক করে দেয়। সিনেমা শুধুমাত্র একটা গল্প আর সংলাপভিত্তিক মাধ্যম নয়, এটা একটা ‘ম্যাজিক্যাল’ শিল্পমাধ্যম (Magical Art form), যার এখনও অবধি নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা তৈরি হয়নি।
     
    শুনেছি ‘ঝিল্লি’ তৈরির সময় কোনো দৃশ্য নিয়ে আপনাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু যে সামগ্রিক রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, সেটা কীরকম ছিল? এবং ধাপার মাঠকেই বা কেন বেছে নিলেন?

    আমি প্রথম থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করব, যেটা হবে বাস্তবভিত্তিক। বাস্তবে কী হচ্ছে, তার থেকে অনেকসময় দূরে চলে যাই আমরা। যে বিষয়ে আমার প্রবল উৎসাহ, সেখানে সত্য থাকা খুব জরুরি। এই সমাজে একটা জিনিস তৈরি হচ্ছে, সেটা পচে গেলে আবর্জনায় পরিণত হচ্ছে, সেখান থেকে আবার একটা নতুন জিনিস তৈরি হচ্ছে। নাগরিক সভ্যতার (Urban Society) সঙ্গে অর্থনীতির একটা অদ্ভুত সম্পর্ক। সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই আমাদের বৃহত্তর সমাজব্যবস্থাকে দেখতে চেয়েছিলাম। কলকাতা শহরে ধাপার (Dhapa) মতো একটা বিশাল আবর্জনার স্তূপ, সেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ কাজ করে যাচ্ছে, সেখানেই সংসার পাতছে, তাদের কাছে নাগরিক সভ্যতা কেমন, তা দেখানোর জন্যই ধাপার মাঠকে বেছে নেওয়া। আসলে ‘ঝিল্লি’ ছবিতে ধাপা আস্ত একটা চরিত্র।

    ‘ঝিল্লি’ | পরিচালকঃ ঈশান ঘোষ

    এখনকার যে ভোগবাদী সমাজ, ধারাবাহিক বিপর্যয়, লোভ – সবটাই একটা অদ্ভুত দিকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব শিগরির হয়তো পুরো ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়বে। আপনি কি জানেন, ধাপার ডাম্প ইয়ার্ড থেকে অনবরত যে ধোঁয়া বেরোয়, সেটা আসলে মিথেন গ্যাস? ওখানকার ভিতরে গভীর গর্ত, তাতে ভর্তি প্লাস্টিক। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র নাগরিক সভ্যতার ক্ষয়ের জন্য। মনে রাখতে হবে, আমাদের যত ক্ষয় হবে, ধাপার মাঠও আকারে বাড়তে থাকবে। আমি আসলে সিনেমার মধ্যে দিয়ে এরকম ক্ষতিকর একটা অবস্থার সম্মুখীন হতে চেয়েছিলাম। যদিও শুরুতে বড়ো ছবি করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। নিজের জন্যই সামান্য কিছু কাজ করতে চেয়েছিলাম তথ্যচিত্রের মতো করে। শুটিং করতে করতে মাথায় আসে যদি এখানে কিছু চরিত্র যোগ করা যায়, তাহলে হয়তো আবেগগতভাবে কাজটাকে আরও মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। শুরুতে কোনো চিত্রনাট্যও ছিল না। এমনিতে সংলাপধর্মী ছবি আমার অপছন্দ। তার বাইরে কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। অভিনেতাদের শুটিং স্পটে নিয়ে গিয়ে নানান মুহূর্ত তৈরি করতাম। এবার দেখা গেল হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল, তখন অভিনেতাদের বলতাম তোমরা ভিজতে ভিজতে কিছু একটা করো। এইভাবে শুট করেছি। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকায় সেই মুহূর্তে আমার চারপাশে কী হচ্ছে, তার মধ্যে নিজেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে এটা একটা দারুণ প্রক্রিয়া। পরবর্তী ছবিও হয়তো এভাবে বানাব।

    আমি আসলে সিনেমার মধ্যে দিয়ে এরকম ক্ষতিকর একটা অবস্থার সম্মুখীন হতে চেয়েছিলাম। যদিও শুরুতে বড়ো ছবি করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। নিজের জন্যই সামান্য কিছু কাজ করতে চেয়েছিলাম তথ্যচিত্রের মতো করে।

    আপনার বাবা গৌতম ঘোষের কাজ এবং আপনার কাজ – কীভাবে তুলনা করবেন? বাবার কাজে আপনি কতখানি প্রভাবিত?

    তুলনার কোনো প্রশ্নই নেই। কারণ বাবা আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেন। অনেক ছোটো থেকে (প্রায় বারো বছর) বাবার সহকর্মী হিসেবে কাজ করছি। যা যা শিখেছি, সবটাই বাবার সঙ্গে কাজ করতে করতে। তাছাড়া বাবা প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের যে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সংগ্রাম – বাবার সিনেমার ক্যানভাসে সেগুলো বারবার ধরা পড়েছে। পরিচালক গৌতম ঘোষ কখনওই রূপকথার জগৎ তৈরি করতে চাননি। যে সিনেমা বাস্তববাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত, বাবা সবসময় সেই চরম বাস্তবের কথাই বলতে চেয়েছেন। বাবার মতো আমিও চাই নিজের সময়টাকে সিনেমার মধ্যে দিয়ে ধরে রাখতে।  

    ছবিঃ ঈশান ঘোষ

    ছবি তৈরির আগে একজন পরিচালকের যে অধ্যাবসায়, তা কি ক্রমশ কমে আসছে? বছরে পাঁচটা করে ছবি বানানোই কি একমাত্র পন্থা?

    এটা পুরোটাই নির্ভর করে ছবিনির্মাতা কী চাইছেন তার উপর। প্রথমেই বলে রাখি এটা পরিচালকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। ঠিক ভুলের প্রশ্নে যেতেই চাই না। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য যদি কিছু পাওয়ার জন্য বা সেলিব্রিটি পরিচালক হওয়ার জন্য হয়, তাহলে মুশকিল। প্রত্যেকদিন খবরের কাগজে নাম বেরোতে হবে, সারাক্ষণ শিরোনামে থাকতে হবে; এটাই তো সিনেমা বানানোর একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকরা এসব ভেবে কখনও সিনেমা বানিয়েছেন বলে মনে হয় না। একজন পরিচালকের কতগুলো ‘প্রজেক্ট’ হচ্ছে, হালআমলে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একবছরে যদি আমাকে পাঁচটা ছবি করতে হয়, তাহলে তো প্রত্যেকটা ছবি একই হয়ে যাবে। এতটুকু সময়ের মধ্যে কীভাবে নিজেকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাব! সিনেমার মতো কঠিন একটা শিল্পমাধ্যমে এটা কি সম্ভব!

    চলচ্চিত্র উৎসবে কি ‘ন্যারেটিভ’ ছবির প্রাধান্য বেশি? তুলনায় ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ ছবি গুরুত্ব হারাচ্ছে?

    ‘ঝিল্লি’ বানানোর সময় আমি জানতাম না, ছবিটা কোনদিকে যাবে বা এর ভবিষ্যৎ কী! পোস্ট প্রোডাকশনের পর ভাবতে শুরু করলাম কোথায় কোথায় পাঠালে মানুষকে ছবিটা দেখাতে পারব। আমি চেয়েছিলাম ছবিটা দেখে দর্শক একটা নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করুক। বিশ্ব চলচ্চিত্রে এখন অসাধারণ সব কাজ হচ্ছে। ভারতীয় ছবি তার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। আসলে আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে সকলেই ভীষণ বিভ্রান্ত। বিভ্রান্তিকর, অস্বস্তিকর এই সময় শুরু হয়েছে লকডাউন থেকে। সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা খুব প্রয়োজন।

    ‘ঝিল্লি’ | পরিচালকঃ ঈশান ঘোষ

    ‘জিরো বাজেটের ছবি’ (Zero Budget Film) বলে কি আদৌ কিছু হয়?

    সামান্য খরচে বড়ো ক্যানভাসে সিনেমা বানানো এখন সম্ভব। তবে পরিচালনার বাইরে গিয়ে অন্যান্য বিভাগের অধিকাংশ কাজ একজন পরিচালকের শিখে নেওয়া উচিত। তাহলে অনেকটা স্বাধীনতা বেড়ে যায়, অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না। কম বাজেটের হলেই যে সিনেমার সুযোগ আর পরিধি ছোটো হয়ে যাবে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই। আমার মতে, প্রথম ছবি একা একা তৈরি করার মধ্যে অদ্ভুত একটা আনন্দ আছে। পৃথিবীর বিখ্যাত পরিচালকরা তাঁদের প্রথম ছবি বানানোর সময় কতজনকে পাশে পেয়েছিলেন? একাই তৈরি করতে হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও ‘পথের পাঁচালি’ বানিয়েছেন এইভাবে। ঘুম-খাওয়া ভুলে দিনের পর দিন সেই কাজটার মধ্যে কীভাবে পড়ে থেকেছেন ভাবুন তো!

    ‘ঝিল্লি’ | পরিচালকঃ ঈশান ঘোষ

    গোটা বিশ্বে স্বাধীন চলচ্চিত্রের বাজার এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

    সাংঘাতিক কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যা হয়ে যাচ্ছে পরিবেশনায়। বেশিরভাগই ‘মুবি’ (MUBI)-তে মুক্তি পাচ্ছে, দু-একটা হয়তো সিনেমাহলে। কিন্তু ছবি বানাতে যে খরচ হচ্ছে, তা আর হাতে ফেরত আসছে না অনেকসময়। এইভাবে অনেক ছবি হারিয়ে যাচ্ছে, কত কত ভালো ছবির নাম জানতে পারছি না। তাই ডিস্ট্রিবিউশন বা পরিবেশনা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।

    আমার বারবার মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে সিনেমা আবার বড়োপর্দায় নিজের আভিজাত্য নিয়ে ফেরত আসবে। যদিও টিভি সিরিয়ালের মতো ওটিটি এখন অনেক দূর পৌঁছে গেছে। টিভির মতো ওটিটিতেও অনেকগুলো মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এর ফলে। এটা তো খুবই ভালো দিক। কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি, খুব কম লোক নিয়ে স্বল্প টাকায় বড়ো ক্যানভাসে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা’ (Independent Film) বানানো সম্ভব।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @