‘আমার কাছে প্যাশনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ববোধ’ : পৌলমী নাগ এক্সক্লুসিভ

‘হঠাৎ যদি উঠল কথা’ – জনপ্রিয় একটি ইউটিউব চ্যানেল। খানিক বিতর্কিতও বটে। যে চ্যানেলের প্রধান এবং একমাত্র মুখ পৌলমী নাগ। ‘ইন্ডিপেনডেন্ট জার্নালিজম’-এর চেয়েও পৌলমী তাঁর পেশাকে ‘সিটিজেনস্ জার্নালিজম’ বলতেই পছন্দ করেন। বঙ্গদর্শনের সিনিয়ার সাব-এডিটর সুমন সাধু’র সঙ্গে পৌলমী নাগের হঠাৎ আড্ডা জমল। জানা গেল নানান কথা। যা এতদিন কেউ জানেননি। সেই সৎ, সাহসী, জেদি পৌলমী নাগের সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার রইল, আমরা তার নাম দিয়েছি – ‘হঠাৎ যদি পৌলমীর কথা’।
সুমনঃ আপনার ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘হঠাৎ যদি উঠল কথা’। শুরুটা কি হঠাৎ করেই হয়েছে?
পৌলমীঃ একদমই তাই। আলাদা করে কোনো পরিকল্পনা ছিল না যে এইরকম একটা ইউটিউব জার্নাল করব বা এমন ভাবেই কথা বলব। মনে হল, এটাও একটা প্ল্যাটফর্ম। যে কথাগুলো বলতে চাইছি বা কাজগুলো করে আমি মানুষের কাছে পৌঁছতে চাইছি, ইউটিউব সেই সুযোগটা আমায় দিতে পারে। সবটা হঠাৎ করেই শুরু হওয়া, সেখান থেকেই ‘হঠাৎ যদি উঠল কথা’।
সুমনঃ তার আগে তো আপনি দিল্লিতে সাংবাদিকতা করেছেন কিছু বছর। ওখান থেকেই কি পরিকল্পনা চলছিল?
পৌলমীঃ না, কলকাতা ফিরে এসে। দিল্লিতে কাজ ছেড়ে দেবার পরে সে অর্থে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। শুধু এটা জানতাম যে, যেটা করতে চাইছি, সেটা হচ্ছে না। এটাকে সাংবাদিকতা বলে না। কাজ ছেড়ে দিয়ে কিছু টাকাপয়সা জমিয়েছিলাম। অনেককিছু ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাথায় ইউটিউবটাই এল। বাবা-মায়ের থেকেও কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। কারণ তাঁদের কাছেও ইউটিউব বিষয়টা একেবারে নতুন ছিল। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে চাকরিটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তাই ওঁদের ভালোভাবে বিষয়টা বুঝিয়েছিলাম, যে দ্যাখো এটাও একটা অপশন হতে পারে। তার কিছুদিন পরেই চ্যানেলটা শুরু করলাম।
সুমনঃ এটা কত সালের কথা?
পৌলমীঃ ২০১৮।
আরও পড়ুন: শনিবারের কড়চা ৬ – এই সমাজে যাঁরা ‘অ-সাধারণ’
সুমনঃ আপনি একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক। সম্ভবত কোনো প্রেস কার্ড ইত্যাদি নেই। এইরকম একটা ডামাডোল পরিস্থিতিতে কীভাবে প্যাশনটা টিকিয়ে রাখছেন?
পৌলমীঃ স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার থেকেও বলা ভালো সিটিজেন জার্নালিজম। তথাকথিত বড়ো সংবাদমাধ্যমগুলি এই ডামাডোল পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের যে কথাগুলো বলার কথা, সেগুলো বলছেন না। তাই আমি আমার চারপাশে যা যা দেখছি, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে একটা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কিছু মানুষের সামনে প্রশ্নগুলো রাখার চেষ্টা করছি। এই পরিস্থিতিতে আমার প্যাশনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ববোধ। আমার মতো যাঁরা এইভাবে কাজ করছেন, বড়ো বড়ো সংবাদমাধ্যমের থেকেও বেশি দায়িত্ব তাঁদের। কারণ এখানে আমার মাথার উপর কেউ নেই। আমিই লিখছি, আমিই বলছি, আমিই তথ্য জোগাড় করছি। পাশপাশি এটাও ঠিক কখনও যদি ভুল তথ্য পরিবেশন করি, তাহলে কখনও না কখনও সেটা ধরা পড়বেই। তাই আমাদের মতো সাংবাদিকদের সবসময় সজাগ থাকা উচিত। সর্বোপরি নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকা উচিত।
সুমনঃ মহিলা বলে আপনাকে অনেক কটূ কথা শুনতে হয়েছে সম্ভবত। সেই মেয়ে যখন রাজনৈতিক হেভিওয়েট নেতানেত্রীদের নিয়ে এত সাহসী কথা বলেন, তখন সেইসমস্ত নেতানেত্রীদের থেকে কোনো ফোন বা মেসেজ পান?
পৌলমীঃ আগে যখন সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান করতাম, তখন কিন্তু আমাকে নিয়ে মানুষের এত বক্তব্য বা বিদ্রূপ ছিল না। যখন থেকে দেশের রাজনীতি নিয়ে অনুষ্ঠান করা শুরু করলাম, তারপর থেকেই লোকের বক্তব্য- আপনি মহিলা হয়ে কেন এত কথা বলছেন! মহিলারা রাজনীতির কী বোঝে! ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সত্যি কথা বলতে, আগে এগুলো দেখে যতটা খারাপ লাগত এখন আর লাগে না। আমি ভাবিতই নই সেসব বক্তব্য নিয়ে। ওগুলো নিয়ে দশমিনিট ভাবা মানে সময় নষ্ট। তার জায়গায় একটা ভালো গান শুনব বা বই পড়ব। আর গান শুনে কাজ করতে বসলে মাথা ঠান্ডা থাকে।
আর যে সমস্ত নেতানেত্রীদের নিয়ে আমি কথা বলছি, তাঁদের দিক থেকে কোনোদিন কোনো ভালো বা খারাপ মতামত পাইনি। যখন কিছু নেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তখন তাঁরা হয়তো বলেছেন তোমার অনুষ্ঠান দেখেছি বা ভালো লেগেছে। আসলে পুরো সাহসটাই আমি মায়ের থেকে পেয়েছি। মা একজন নার্স। কিছুদিন আগে এক আন্দোলনে ঝড়-জল-রোদের মধ্যে মা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নার্সদের সমবেতনের অধিকারে। আমাকে মায়ের মেয়ে বলা যেতে পারে।
সুমনঃ আগে দেখতাম আপনার চ্যানেলে সাংস্কৃতিক চর্চা হত বেশ। যেমন বোরোলীন, শকুন্তলাদেবী বা বাঙালিদের নিয়ে অনেক কন্টেন্ট হত। এখন আর করছেন না কেন? এগুলো কি আর দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে না?
পৌলমীঃ না, একেবারেই তা নয়। আমাকে অনেকেই বলেন, তুমি রাজনীতি নিয়ে কথা বলো কারণ সেগুলো ‘পাবলিক খায়’। কিন্তু আমি বলব, চটুল বা ঝালমুড়ি টাইপ কন্টেন্ট পাবলিক অনেক বেশি খায়। সেগুলো করলে হয়তো আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারতাম বা রোজগারও বেশি হত। কিন্তু ওগুলো করতে পারব না। আমি একটা সময় শিক্ষকতা করতাম। ওই বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, বাংলা-বাঙালি, আমাদের ঐতিহ্য এগুলো নিয়ে ওরা কিছু জানে না। আমাদের যে আড্ডা দেওয়ার একটা রীতি ছিল, সেটা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তাই আমি আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে অনুষ্ঠান করতে শুরু করলাম আড্ডার ছলে। কিন্তু কোনো মানুষ রাজনীতির বাইরে নন। চারদিকে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, সেই সমস্ত কিছুকে বন্ধ করে রেখে শুধু কি সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক? সেখান থেকেই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। তবে আগামী দু-তিনমাসের মধ্যে আশাকরি বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কন্টেন্ট নিয়ে আসব।
সুমনঃ আপনার কথা বা চ্যানেলের ওরিজিনালিটিটা কী? মানে আপনাকে তো তথ্য সংগ্রহের জন্য টেলিভিশন, সংবাদপত্র বা ওয়েব পোর্টালের সাহায্য নিতে হচ্ছে। এবার তারা যদি ভুল সংবাদ পরিবেশন করে, তাহলে তো একটা রিস্ক থেকে যায়। যাচাই করেন কীভাবে?
পৌলমীঃ প্রথমত, আমি কোনো খবর দিচ্ছি না। খবর দেওয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল রয়েছে। অমুক নেতা তমুক নেতার নামে খারাপ কথা বলেছেন- এটা কোনো খবর হতে পারে না। এটা হচ্ছে আসল খবরকে ঢেকে রাখার মরিয়া চেষ্টা। আমি এগুলোকে সরিয়ে মূল ইস্যুটা নিয়ে বিশ্লেষণ করছি খানিক আড্ডার ছলে। সেই বিশ্লেষণে আরও অনেক তথ্য যোগ করছি, প্রশ্ন তুলছি এবং উত্তর দেবারও চেষ্টা করছি, যাতে মানুষ নিজের সিদ্ধান্তটা নিজেই নিতে পারেন। শুধুমাত্র একটা দিক নয়, সমস্ত দিকগুলোর কথা উপস্থাপন করছি। আর এখন ইন্টারনেটের যুগে সত্যি খবর পাওয়া কোনো অসুবিধাই নয়। একটা ওয়েবসাইটে একটা খবর দেখে সেটাকেই সত্যি বলে ভাবলে হবে না। অনেকগুলো ওয়েবসাইট দেখতে হবে। এই যে এখন দলবদলের ঘটনা ঘটছে। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কংগ্রেস থেকে একগুচ্ছ লোকজন নিয়ে বিজেপিতে চলে গেলেন। এটা তো প্রথম নয়। এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেই ধরনের রেফারেন্স খুঁজে বের করতে হবে। ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা সমস্ত ভাষার ওয়েবসাইট নিউজপেপার দেখতে হবে। আমার মনে হয়, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ভুল তথ্য পাওয়া যতটা সহজ, সঠিক তথ্য পাওয়াটা ততটাই সহজ। বিষয়টা হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করে আমি সবার আগে বলব, এটা করলে চলবে না। একটু সময় নিয়ে একটু ধৈর্য ধরলে সবটাই বোঝা যায়। আর সেখানে রিস্কও থাকে না।
সুমনঃ এখন নিশ্চয় আপনাকে অনেকে চিনতে পারেন। এমন কোনো মনে থাকার মতো প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে পারবেন? যেটা আপনার মগজে শাণ দিতে সাহায্য করেছে?
পৌলমীঃ আমার অনুষ্ঠানে দেখেছি অনেকেই কমেন্ট করে লেখেন, আপনি তো এই দলের হয়ে কথা বলছেন বা আপনি তো বিকিয়ে গেছেন। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খুব সহজেই বিকিয়ে যেতে রাজি। কিন্তু আমি আমার নিজের জন্য যে দামটা ঠিক করেছি, সেই দাম কোনো রাজনৈতিক দল দিতে পারবে না। রাস্তায় বেরোলে যখন কোনো বয়স্ক মানুষ আমায় চিনতে পারেন, কথা বলেন, আমি তাঁর পায়ে হাত রেখে প্রণাম করি এবং তিনি আমায় আশীর্বাদ করে বলেন, তোমার অনুষ্ঠান খুব ভালোলাগে। এর চেয়ে বেশি দুর্মূল্য আর কীইবা হতে পারে। আর এগুলোই আমরা ভুলতে বসেছি। ভুলে যাচ্ছি বলেই মানুষ খুব সহজে বলে দিতে পারছেন, আপনি বিক্রি হয়ে গেছেন।
সুমনঃ ভবিষ্যতে চ্যানেলটাকে কোন জায়গায় দেখতে চান?
পৌলমীঃ শিরদাঁড়া সোজা রেখে মাথা উঁচু করে যে কাজটা করছি, সেটা যেন চালিয়ে যেতে পারি। ভয়টা যেন জাঁকিয়ে না বসে। ভবিষ্যতেও যেন ‘হঠাৎ যদি উঠল কথা’ সত্যি কথাগুলো ওঠাতে পারে সোচ্চার কণ্ঠে।
সুমনঃ এখন এত এত ইউটিউব চ্যানেলের ভিড়ে আমাদের আপাত শিক্ষা, ভাষা ব্যবহার, বডি শেমিং, হোমোফোবিয়া, পিতৃতন্ত্র খুব বাজে জায়গায় চলে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। মানুষকে আঘাত করা বা হেয় করার প্রবণতা খুব বাড়ছে যে কারণে। এবং লোককে গালিগালাজ দেওয়ার মাধ্যমও সহজ হয়ে গেছে। যুক্তির বাইরে গিয়ে কথা বলছেন অনেকে। তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলবেন? শুধুমাত্র সাবস্ক্রাইবার আর শেয়ার বাড়ানোর জন্য এটা কি খুব রুচিশীল পদ্ধতি হচ্ছে?
পৌলমীঃ ইন্টারনেট যেমন মানুষকে শক্তি দেয়, তেমনই লুকাতেও সাহায্য করে। কেউ না কেউ এই সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যেটা বোঝেন না সেটা হচ্ছে, একটা সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পরেও আরেকটা সমস্যাকে তাঁরা নিজেদের প্ল্যাটফর্মে ছোটো করছেন। ধরা যাক, কেউ একজন ফেমিনিজম নিয়ে কথা বলছেন, আবার তিনিই হয়তো পরে সমকামীদের ছোটো করছেন। বা তিনিই হয়তো পিতৃতন্ত্র পরিকাঠামোর হয়ে কথা বলে ফেলছেন অজান্তেই। এগুলো খুব সুক্ষ বিষয়। গুরুত্ব দিয়ে বোঝাটা খুব জরুরি। শুধুমাত্র সাবস্ক্রাইবার বাড়ানোর জন্য এগুলো কোনো পথ হতে পারে না। আমাদের এত এত মানুষ ফলো করছেন মানে কিছু জিনিস তো আমরা ক্রিয়েট করতে পারছি। এবার আমাদেরও দায়িত্ব থাকে খুব সহনশীল উপায়ে ভদ্রভাবে সঠিক ভাষায় একটা জিনিস উপস্থাপন করার।
সুমনঃ এই সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে আপনার প্রিয় নেতা এবং প্রিয় নেত্রী কোন দুজন?
পৌলমীঃ এই উত্তরটা দিলে খুবই বিতর্ক হবে, তাও বলছি।
প্রিয় নেতা দিলীপ ঘোষ। কারণ রাজনীতিটা উনি দারুণ বোঝেন। উনি বুঝে গেছেন, এই ধরনের বিতর্কিত কমেন্ট করলে হেডলাইনে থাকা যায়।
প্রিয় নেত্রী অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যেভাবে লড়াই করে তিনি উঠে এসেছেন, যেভাবে টিকে আছেন সেটা সত্যিই শেখার মতো। বহুবার তাঁকে শুনতে হয়েছে মমতা ব্যানার্জি এবার শেষ। কিন্তু উনি ময়দান ছাড়েননি। এবং ইনিও সাংঘাতিকভাবে রাজনীতিটা বোঝেন।