সবাই হিমু হতে পারে না

হলুদ কোনও পাঞ্জাবি আমার নেই। অন্যান্য রঙের যাও বা আছে, পকেট ছাড়া ভাবা যায় না। ভার হয়ে থাকে মোবাইল, লাইটার, সিগারেটের বাক্স। কখনও কখনও বাড়ির চাবিও। মানিব্যাগ। এসব সংসার গুছিয়ে যখন বেরোই, জড়িয়ে থাকে পিছুটান। নীরব কোনও রাস্তা ধরে চুপচাপ হেঁটে যেতে আমার ইচ্ছে হয় খুব। হলুদ আলো থেমে যাবে উঁচু দেওয়ালের কাছে এসে, মোড়ের মাথায় কয়েকটা কুকুরের জটলা, পাশের বাড়ির তিনতলা থেকে ভেসে আসবে কিশোরীর রেওয়াজ – এমন একটা রাত উপহার চাই কলকাতার কাছে। পায়ে-পায়ে স্ট্র্যান্ড রোড। এখানে-ওখানে গায়ে চাদর টেনে ঘুমিয়ে আছে কিছু লোক। সারা রাতেও ঝাঁপ পড়ে না – এমনই একটা চায়ের দোকান আমার ঠিকানা। কাছেই শ্মশান। আসছে যাচ্ছে। যারা থেকে গেল, তাদের ধোঁয়ায় জ্বালা করবে চোখ। ডোমের হাত ধরে বলব, ‘ভালো থাকুন দাদা।’ আর চোখের সামনে শহর কলকাতা আস্তে আস্তে নেমে যাবে গঙ্গায়, উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাবে শক্তিকে – ‘ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং...’
সবাই হিমু হতে পারে না। তবুও চাইব কলকাতা আর ঢাকার মধ্যে পার্থক্য না থাকুক কোনও; ওই যে দূরের রাস্তাটা, যেন আমাকে শাহবাগ থেকে টানতে টানতে নিয়ে যায় ফার্মগেট অব্দি। তারপর হারিয়ে ফেলি সব। বিভ্রান্ত হয়ে শুয়ে পড়ি ফুটপাথে। আমার বাবা ডাইরিতে কোনও উপদেশ লিখে যাননি। মহাপুরুষ হওয়া এ-জীবনে আর হল না। শুধু, জড়িয়ে না-পড়ার দীক্ষা যেন রাখতে পারি। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন ‘পাঁকাল মাছের মতো’ হতে। আমি দেখব, শুনব, বুঝব এবং ভান করব ভুলে যাওয়ার। তোমার মনে কষ্ট দিয়ে, মেয়ে, কষ্ট পাব নিজেও। অনেক নীলপদ্ম জমবে আমার কাছে। কিন্তু, একবার দিয়ে দিয়েছি বলে জমে-থাকা নীলপদ্মগুলো নিয়ে কী করব, জানি না।
হিমু জানত। আর সে-কারণেই সে আলাদা। অথচ এই যে আমি, তোমাকে রূপা বলে ডাকি, অবহেলাও করি প্রচুর; তবু যত্নে খামতি নেই কোনও। হিমু মহাপুরুষ বলে পার পেয়ে গেছিল। আমি তোমার হিমু হব কী করে! রাতের শহর সবাইকে সব দেয় না। শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে, চারদিকের শুষ্ক বিষণ্ণতা ও হঠাৎ-গাড়ির শব্দ শুনে আমার মৃত্যু-মৃত্যু খেলতে ইচ্ছে করে খুব। তুষার রায়ের মতো। গাড়ি আসতে দেখে দৌড়ে রাস্তা পার হব; বেঁচে গেলে তো ঠিকই আছে, নইলে রক্তমাখা একটা শরীর কাঁপতে কাঁপতে খুঁজবে তোমাকে। ভাবি। হিমু এমন ভাবেনি। সে পাইপের মধ্যে শুয়ে দু-প্রান্তের পৃথিবীকে বাহুল্য মনে করত। আমি পারিনি। যেমন পারে না হিমু হতে চাওয়া হাজারো যুবক। তন্ময় হয়েই থেকে যায় তারা। কিংবা তাও নয়। নিজের পরিচিতি পেরিয়ে হিমালয় হওয়া সহজ বুঝি?
হিমু কি শহীদ কাদরী পড়েছিল? ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/কিন্তু শান্তি পাবে না পাবে না পাবে না’? রাস্তার প্রতিটা নুড়ি আমার লাথিতে ছিটকে যায় অন্য কোনও নুড়ির কাছে। ও হলে ওদের ঠিক মিলিয়ে দিত। নিজে সরে এসে অন্যদের মিলিয়ে দেওয়ার যে নিয়ম, তা হিমু জানত। অন্তত, নিজেকে সরিয়ে নিতে। যাতে সাময়িক কষ্ট পেলেও, অন্যজন বুঝতে পারে, এর সঙ্গে আসলেই থাকা যায় না।
প্রকৃতপক্ষে ‘হিমু’ একটা ধর্মের নাম, যে ধর্মের আমি অভিনেতা। অথচ কলকাতা বা ঢাকা এসবের জানে না কিছুই। আমাকে প্রশ্রয় দেয়; ভারী পকেট আর পিছুটান সত্ত্বেও মিলিয়ে দেয় হিমুর সঙ্গে। আমি আর হিমু একই পাঞ্জাবির মধ্যে ঢুকে ঘুরে বেড়াই, বাগবাজার আর সদরঘাট গুলিয়ে ফেলি ক্রমশ। যেন কেউ অপেক্ষা করছে –যেতেই হবে; না গেলে হিমুত্ব মিথ্যা, মিথ্যা এই ঔদাসিন্য। শহর আমাদের প্রতারক বলে গাল দেবে তখন। প্রত্যেকটা রাস্তা আমাদের পায়ের নীচ থেকে সরিয়ে নেবে পথ। দূরে তখনও দাঁড়িয়ে তুমি – হাতে খাবার – যেন আগে থেকেই জানতে, অভুক্ত আছি সারাদিন।
রূপাকে ছাড়া হিমু হয় না। হিমুকে ছাড়া রূপা। তোমাকে ছাড়া আমিও কি, বলো?