এপার-ওপার, মধ্যিখানে সাতটি দশক

বেলা বারোটার দক্ষিণ কলকাতা। রোদ-ছোঁয়া বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বাবা-ছেলে। ছেলের বয়স চার-পাঁচের বেশি নয়। হাঁটতে-হাঁটতে কানে এল বাবার কথা। ‘ওরা বলত – বিদেশি পোশাক পরবে না, বিদেশি খাবার খাবে না।’ ছেলের চোখে বিস্ময়। হাঁ করে গিলছে। আচ্ছা, তাহলে স্বাধীনতার প্রসঙ্গই! এমন সরল বর্ণনা কি ওই শৈশবের কাছে কোনো দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছে? একাত্তর বছর এবং তারও আগেকার কোনো দৃশ্য?
আমি নিজেই বা স্বাধীনতা বলতে কী বুঝি? ওই শিশুটির মতো আমিও কি বানিয়ে তুলি ঘোর? হয়তো কখনও ছিটকে পড়েছিলাম স্বয়ং দৃশ্যেই। কে জানে! বড় দূরের মনে হয় আজকাল। ভেবে দেখা যায়। ছুঁয়েও?
স্মৃতি – ১
১৪ আগস্ট, ২০১৭। রাত সাড়ে দশটা। ময়মনসিংহের পাটগুদাম মোড় থেকে বাস ছাড়ল কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। একটু এগোলেই বিশাল ব্রহ্মপুত্র। ব্রিজ পেরিয়ে, অন্ধকারের বুক চিরে বাস চলেছে গন্তব্যের দিকে। দু-পাশে ক্ষেত, বাগান। কোথাও বা গুমটি চালাঘর। চলেছি আমার দেশের বাড়ি খুঁজতে। ১৯৪৭ সালে কিশোরগঞ্জের যে ছেড়ে চলে এসেছিলেন ঠাকুরদা, দেশভাগের ঠিক সত্তর বছর পরে, ওই ১৫ আগস্টেই আমি হাজির হতে চাই সে-গ্রামে। বাংলাদেশের রাত নিঝুম। বাসের অন্যান্য যাত্রীরাও নিজেদের মধ্যে মশগুল। কেউ বা নিজের মাথা এলিয়ে দিয়েছে পেছনের সিটে। আর আমি, জানলার ধারে বসে মিলিয়ে নিচ্ছি সময়ের পিছিয়ে যাওয়া।
দূরের একটা বাঁক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এত আলো! আমার ঘোরলাগা চোখ ভর দিল অবচেতনে। মনে হল, ওই আলো ভেদ করে যেন এক্ষুনি বেরিয়ে আসবেন আমার না-দেখা ঠাকুরদা, আর তাঁর পিছনে ফুটে উঠবে গ্রাম, পুকুর, আমাদের বংশের ভিটে। নাহ্, সব মনে-হওয়া সত্যি হয় না। বিপরীত একটা বাস, খানিক বাদে পেরিয়ে গেল আমাদের। দুটো সময়ের সেই মিলনমুহূর্তে, চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম?
আরও পড়ুন
স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে বলি আমিই রোহিঙ্গা
একসময়, ঘড়ির কাঁটা গড়াতে-গড়াতে সাড়ে বারোটায়। বাংলাদেশের হিসেবে। অর্থাৎ, আমার দেশে রাত বারোটা। সত্তর বছর পূর্ণ হল স্বাধীনতার। দেশভাগের। সেদিনের অজস্র ঘর-হারানো মানুষের ব্যথা কতটুকুই বা বুঝি! তবু এই যে ছুটে যাওয়া, শিকড়ের খোঁজে, ইতিহাস সাক্ষী থাকুক – অতীতের ঋণ অস্বীকার করা যায় না আজও। আর বাকিটা, নিজেকে জানার পথ। উপনিষদের ঋষি যাকে ‘আত্মানং বিদ্ধি’ বলেছিলেন...
স্মৃতি – ২
অসম্ভব এক বৈপরীত্যের মধ্যে গিয়ে হাজির হয়েছি আমি। যে-দিনটা ভারতে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয় মহাসমারোহে, সেই দিনটাকে ঘিরেই বাংলাদেশ শোকে মুহ্যমান। কারণ, ১৯৭৫। কারণ, বঙ্গবন্ধু। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার দু-পাশে জায়গায়-জায়গায় পালিত হচ্ছে ‘শোক দিবস’। ১৯৭৫ সালের এই দিনেই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেনাবাহিনীর লোকেরা আক্রমণ করে উপস্থিত সবাইকে হত্যা করেছিল(দুদিন বাদে, ঢাকায় ফিরে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেছিলাম। এখন সে-বাড়ি মিউজিয়াম। তবু, দেওয়ালে-দেওয়ালে আজও গুলির চিহ্ন। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ। শুকিয়ে এসেছে; কিন্তু যা লাল – তাকে কি এড়ানো যায়!)।
১৫ আগস্টের সেই সকালে, কিশোরগঞ্জ সদর থেকে হোসেনপুরে চলেছি। হোসেনপুরেরই বর্শিকুড়া আমার গ্রাম। পরিচিত, কিংবা আত্মীয়-জ্ঞাতি কেউই থাকে না এখন। তবু যাচ্ছি, দেশভাগের মুখে থুতু ছিটিয়ে প্রমাণ করে দিতে – চাইলে এখনও ফেরা যায়। হ্যাঁ, একবেলার জন্য হলেও...
স্মৃতি – ৩
একটা পুকুর, চমকে দিল নামে। ‘শিবপুকুর’। একটা উঠোন, জল এনে দিল চোখে। ‘ওইহানেই তো ভটচাইজরা থাকতেন।’ সঙ্গে রইল জড়িয়ে ধরা – ‘আপনে তো এই গ্রামেরই ছেলে! এতদিন পরে আইসেন, আইয়েন আমার বাসায় খানিক জিরাইয়া যান।’ ১৫ আগস্ট আমাকে ছুঁড়ে দিয়েছে উত্তরাধিকারের সেই আবর্তে – যা থেকে চাইলেও আর কোনোদিন বেরোতে পারব না আমি। পায়ে-পায়ে ‘নারায়ণডহর ফ্রি প্রাইমারি স্কুল’। আমারই পূর্বপুরুষ এই স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ঠাকুরদা হেডমাস্টার ছিলেন এই স্কুলের। সামনে উড়ছে পতাকা। বাংলাদেশের। বৃষ্টিভেজা, স্বাধীন।
বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিচ্ছে চোখের সামনে যা-কিছু। শুদ্ধ করছে সব। মাঝখানের সত্তর বছর নরম করে দিচ্ছে ছাঁটে। যেন চাইলেই ছোঁয়া যায়, একসঙ্গে। ঠাকুরদার হাত ধরে কেউ ঘুরে বেড়াতে পারে বর্শিকুড়ার মাঠ-ঘাট-পথ দিয়ে। আমার স্বাধীনতা এখানেই। প্রত্যেকটা লোকের হাসি, আপ্যায়ন, চিনিয়ে দেওয়া আমাকে বাধ্য করছে ইতিহাসের দিকে আঙুল তুলতে। না। সবাই খারাপ না। খারাপ হতে পারে না সবাই।
অবশ্য, শেষ অব্দি পারার মধ্যে শুধু একমুঠো মাটি নিয়ে আসা। আর, স্মৃতির ছলে লিখে ফেলা এইসব আখ্যান, যা প্রত্যেক ১৫ আগস্টে ফিরে-ফিরে আসবে। একটা দিনের পরিচয় সম্পূর্ণ বদলে দেবে আমার কাছে। আমিও কি বদলে যাব, দিনে-দিনে?
সত্তা ও ভবিষ্যৎ
জানি না। শুধু অনুভব। যতটুকু পাওয়ার, আঁকড়ে ধরি যেন...