No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ইঞ্জিন+ইয়াররিং

    ইঞ্জিন+ইয়াররিং

    Story image

    (১)
    সে এক দিন গেছে বটে! সারা সেমিস্টার যার সঙ্গে আলাপই হয়নি, পরীক্ষার সময় সামনে সিট পড়েছে বলে ‘তুই তো আমার ভাই রে...’ বলে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেই ভাতৃত্ববোধ বজায় ছিল শেষ সেমিস্টার পর্যন্ত। চার বছরে জিন এমন সেট যে, একমাত্র সুরজিৎ ছাড়া আর কারও হাতের লেখা ভালো পড়তেই পারতাম না আমি। রেজাল্ট বেরোতে দুজনেই অবাক, সব লেখা এক হওয়া সত্ত্বেও পয়েন্ট থ্রি বেশি পেলাম কী করে! সুরজিৎ রাগ করত। বলত, ‘পরেরবার থেকে তোকে আর দেখাব না কিছু।’ সঙ্গে-সঙ্গে হাজির ছোট সিল্ককাট। কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবি? নে ভাই। তুই আমার বন্ধু না? এমন করতে পারবি আমার সঙ্গে?

    নেক্সট ফেজ, ফাইনাল সেমে ইন্টারভিউ বোর্ড। গ্রুপ ডিসকাশন চলছে, নির্ভয়া-কাণ্ডের ধর্ষকের ইন্টারভিউ তখন বেরিয়েছিল সদ্য, তা-নিয়েই। বাংলা নট অ্যালাউড। হিন্দি-ইংরাজি মিশিয়ে চিৎকার করছে সবাই। আমি মিনমিনে গলায় কী বলেছিলাম মনে নেই, তবে বেশ কয়েকবার ‘পত্রকার পত্রকার’ বলে চিৎকার করেছিলাম সাংবাদিকের প্রসঙ্গ ওঠায়। ওই একটা গম্ভীর হিন্দি শব্দ বলতে পেরে বেশ আনন্দ হয়েছিল। সেমিনার হলে রেজাল্ট বেরোল সেদিনই। সুরজিৎ চাকরি পেয়েছে। আমি ফক্কা। খানিক পর বাথরুমে গেলাম সিগারেট টানতে। সুরজিৎ পিঠে হাত রেখে বলল, ‘চাপ নিস না, হয়ে যাবে।’ 

    পরের ঘটনা বেশ মজার। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে জনা পনেরো চান্স পেয়েছিল ওই কম্পানিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ফেক। পিটিও(প্লেসমেন্ট ট্রেনিং অফিসার)-কে ঘিরে বিক্ষোভ। গোলগাল পিটিও বেচারা যথাসাধ্য রাগী মুখে বোঝাচ্ছেন সকলকে। ফিক-ফিক হাসছি ছাদে গিয়ে। তাড়াতাড়ি কাটতে হবে আজ। কফি হাউসে বন্ধুদের আড্ডা। আমি, এই দশকের ল্যাজবিশিষ্ট একজন – এইসব ইঞ্জিনিয়ারিং-কে এত পাত্তা দিলে চলে?

    (২)
    কলেজে কতজন যে গলায় মালা পরিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ইয়ে, মালা নয়, টাই। প্রায়ই বান্ধবীদের কাছে গিয়ে কাঁদো-কাঁদো মুখে বলতাম, পরিয়ে দিবি? ওরা কলার ঘিরে, যত্ন করে ফাঁস বেঁধে দিত। গরম লাগছে যে! লাগুক। এটুকু সহ্য না করলে ইঞ্জিনিয়ার হবি কী করে! অথচ পরীক্ষার হলে, যখন প্রশ্ন দেখে মনে পড়ছে ভাস্কর চক্রবর্তীর লাইন – ‘মুখ যেন জাপানী অক্ষর’, আর বাথরুমে লুকিয়ে রাখা অর্গানাইজার ডাকছে ‘আয় আয় আয়’, বুঝেছিলাম টাই-এর মহিমা। আফশোস হত, পরতে পারি না বলে। বন্ধুরা কী সুন্দর টাইয়ের ভিতরের ভাঁজে চোথা লুকিয়ে রাখত, ফাঁকতালে খাতার ভিতরে রেখে বড়-বড় ইকুয়েশন নামিয়ে ফেলত অনায়াসে। আর আমি, ভালো ছেলে, দৌড় বড়জোর পরীক্ষা শুরু হওয়ার খানিক আগে গিয়ে বেঞ্চে টুকে রাখা। না-মিললেই কেস। হাঁ করে বসে আছি বাইরের দিকে তাকিয়ে, হলের গার্ড সামনে এসে বলছেন ‘লিখছিস না কেন’, উত্তর দিচ্ছি করুণ মুখে – ‘সব পড়েছিলাম স্যার, এত কঠিন প্রশ্ন যে...!’ পরীক্ষার দিনগুলো দাড়ি কাটতাম না, যাতে আরও অসহায় দেখায়। স্যারেরা গলে যেতেন। বলতেন, ‘আর যাই কর, কথা নয়।’ কথা দিলাম। আপনি প্রণম্য, স্যার! টুক করে একবার পা ছুঁয়ে নেওয়া। ‘পরের সেমে এমন হলে কিন্তু ছাড় পাবি না।’ সে দেখা যাবে। এবারে পাশ করি তো আগে!

    রেজাল্ট বেরোলে, বাড়িতে বাবার গর্জন। মায়ের কাঁদোমুখ। দ্যাখ, অমুকও তোর থেকে বেশি পেয়ে গেল। ফলে, মনে-মনে একটা লিস্ট বানিয়ে রাখতাম, যারা আমার থেকেও কম পেয়েছে। মা’কে পরপর নামগুলো বলতে পারলেই নিশ্চিন্তি। গুটিগুটি নিজের ঘরে ফিরে এসে, আহ্‌ শান্তি! সেভেন পয়েন্ট পেয়েছি, আর কী চাই! জীবন কি শুধু ওই নাইন পয়েন্ট পাওয়া ছেলেমেয়েদের খপ্পরে? কবিতা লিখতে পারে ওরা? সাহিত্য পড়েছে?

    (৩)
    ‘ভাই, তোর তো চিন্তা নেই! লেখালিখি করেই কেটে যাবে লাইফ। আমায় দ্যাখ, সেই সকাল নটায় বেরোই, এখন আটটা বাজে, বাড়ি ফিরছি। লাইফটা হেল হয়ে গেল রে! তুই ভালো আছিস খুব।’
    কটমট করে তাকালাম ছেলেটার দিকে। বন্ধু? শালা, চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব তোমার। লেখালিখি করে টাকা আসে এই বাংলাবাজারে? নিজে তো আইটিতে চাকরি বাগিয়ে বিশ হাজার ঘাপলাচ্ছ মাস গেলে, আর আমায় জ্ঞান দিতে এসেছ! যা বাড়ি যা! শাস্তি হিসেবে ওর হাত থেকে কেড়ে নিলাম আধখাওয়া সিগারেট। কলেজ শেষ হয়ে গেছে প্রায় ন’মাস তখন। বাইরের লোকের কাছে গর্ব করে বেড়াচ্ছি – ভাগ্যিস চাকরি পাইনি, তাই বেলঘরিয়ার ইতিহাস লেখার মতো ভারিক্কি একটা কাজ করতে পারলাম। আড়ালে চাপ – ‘কতদিন, আর কতদিন, বল মা!’ হেমন্ত মুখুজ্যে গান গাইছেন আমার ভিতরে। 

    একদিক থেকে ভালো ছিল সেইসব দিনও। সন্ধ্যাবেলা, কোনও কাজ নেই বলে স্টেশনে গিয়ে চা খাচ্ছি, বন্ধুরা চাকরি করে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরছে। ‘ভুলেও কখনও আইটিতে যাস না তন্ময়, লেখালিখি সব মাথায় উঠবে।’ উদাস তাকিয়ে থাকতাম। কোর সেক্টরে মার্কেট কেমন? ‘ধুর! সেখানেও তো রিক্রুটমেন্ট নেই।’ বলছিস? আচ্ছা, যাব না তাহলে! ‘কী হবে টাকার পিছনে ছুটে, যদি শান্তিই না পাই’ - ডায়লগের অভাব নেই কোনও।

    অথচ কপালে ইঞ্জিনিয়ার-এর ছাপ্পা। যেখানেই যাই, ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করে লোকজন – ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে এসব করো কেন?’ ভালো লাগে, তাই। লোকজন হাসে। আহা, ভালো কাজ নিয়েই তো আছ! তা আছি বইকি। গুঁজে শার্ট পরতে হয় না, পায়ে বুটের বালাই নেই, যেখানে খুশি বসে পড়তে পারি বাবু হয়ে – ওইসব ঝকঝকে ইঞ্জিনিয়ারদের প্রোটোকল থেকে বাঁচার যে কী আরাম! ‘তাহলে, খাবি কী করে?’ কিছু একটা জুটিয়ে নেওয়া যাবে। বন্ধুরা ফ্লেকে উঠে গেছে। মাঝেমধ্যে ক্ল্যাসিক। আমার ধাত তোমার ধাত ছোট সিল্ককাট ছোট সিল্ককাট। 

    (৪)
    একসময় ভাবতাম, ট্রেনের বিশাল ইঞ্জিনে মিষ্টি একটা মেয়ের কানের দুল হারিয়ে গেছে, সেই দুলটা খুঁজে মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার যে আর্ট, সেটাই ইঞ্জিনিয়ারিং। ইঞ্জিন+ইয়াররিং=ইঞ্জিনিয়ারিং। হায় সে রোমান্টিক মনের কল্পনা! পরে বাঁশ খেয়ে বুঝেছি, আমার মতো পাতি বাঙালি ছেলের কাছে ওসব আসলে নাইকুইস্ট প্লটের মতোই প্যাঁচালো। যতই প্র্যাকটিস করো, গ্রাফে মিলবে না কিছুতেই। 

    তখন সেকেন্ড সেমিস্টার শেষের পথে। বেসিক ইলেকট্রিকাল পড়া প্রায় কমপ্লিট। সন্ধেবেলা আড্ডা মারতে মারতে, শানু জিজ্ঞেস করেছিল – ‘বল তো, ফিউজ কাকে বলে?’ থতমত খেয়ে উত্তর দিয়েছিলাম – ওই তো, যা উড়ে যায়! সেই থেকে আজ অবধি, প্রসঙ্গ উঠলেই ফিউজ আমার কাছে একটা পাখি হয়ে আসে। শর্ট সার্কিট হয়ে উড়ে যাওয়া একটা পাখি, যার ডানায় লেগে আছে আগুন। এ-জন্যেই আমার আর এই ফিল্ডে চাকরি করা হল না। যখন সার্কিট ডায়াগ্রাম ঝিম ধরাত প্রতিদিন, কলেজের খাতায় লিখে রেখেছিলাম সম্বিত বসুর লাইন – ‘অন্যমনস্কতা একধরনের কনসেনট্রেশন’। সেই খাতা আজ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বেঞ্চে খোদাই করে আমি+তুমি লেখাও। ঝিলপাড়ে বসে পা দোলাতে দোলাতে মনে পড়ে, কলেজে ম্যানার্স শেখানোর ম্যাম বলেছিলেন, খাওয়ার সময় শব্দ করা কিংবা খেয়ে ঢেঁকুর তোলা অপরাধ। অথচ ভাত খেয়ে ঢেঁকুর না-তুললে মনে হয়, খাওয়াই হল না ঠিকঠাক। ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে বুঝি ভড়ং শেখা জরুরি? খালি ছুট ছুট আর ছুট?

    পৃথিবীর সমস্ত দৌড়ের বিপরীতে পেতে দিলাম আমার এই সরে আসা। বন্ধুরা, ‘ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন, পাপ ছিল কিনা!’
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @