অন্ধত্ব চোখের, অন্তরের নয়

চোখ ঢাকা কালো চশমায়, দুটো হাত – হাতের আঙুল খুঁজে নিচ্ছে কিছু পোড়া টালি, টুকরো কাগজ, কালি-কলম, রং। কখনও ম্যুরাল বানাচ্ছেন, কখনও দেশলাই ঠুকে জ্বালিয়ে নিচ্ছেন সিগারেট, কখনও বসে আছেন, বসে বসে চেয়ে আছেন, চেয়ে আছেন এক দৃষ্টিতে… যে দৃষ্টি তাঁর অন্তরের।
সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়
বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়; অন্ধত্ব যাঁকে গ্রাস করতে পারেনি, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যিনি শিল্পের দিশারী হয়েছেন, নিজস্ব আন্তরিকতায় ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার সূচনা করেছিলেন। ৫৩ বছর বয়সে, তিনি যখন সম্পূর্ণভাবে অন্ধ, বলতেন: ব্লাইন্ডনেস ইজ আ নিউ ফিলিং, আ নিউ এক্সপিরিয়েন্স, আ নিউ স্টেট অফ বিয়িং৷ অন্ধত্ব একটা নতুন অনুভূতি, একটা নতুন অভিজ্ঞতা, একটা নতুন জীবন।
কোলাজ, ১৯৭০
তাঁর পরিচিতি এমনই ছিল যে, জীবনের শেষবেলায় পৌঁছেও শান্তিনিকেতন সমাজের বাইরে কেউ তাঁকে বিশেষ চেনেনি। বিস্তীর্ণ খোয়াইয়ের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা একটি তালগাছের মধ্যেই তাঁকে খুঁজে নিতে বলেছিলেন ছাত্র সত্যজিৎ রায়কে। “খোয়াই বাদ দিও না। খোয়াই আর তাতে একটা সলিটারি তালগাছ। ব্যস। আমার স্পিরিট, আমার জীবনের মূল ব্যাপারটা যদি কোথাও পেতে হয়, ওতেই পাবে। বলতে পার, ওটাই আমি।”
তাঁকে নিঃসঙ্গ বলাটা ঠিক হবে না। একা থাকার জন্য নয়, একাকিত্ব অনুভব করার জন্য তিনি ছিলেন একা। বলেছেন, “আমি নির্লজ্জের মতো সারাটা জীবন কাগজের ওপর রঙ লেপ্টেই কাটালাম। আসল কথা, আমার স্বভাব এমন যে কোনো সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে আমি নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারিনি। পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের ইতিহাস তৈরি হয়েছে আমার চোখের সামনে। দুর্ভিক্ষ, বন্যা, ভূমিকম্প ঘটেছে— এর সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আমার ছিল না। এ বিষয়ে কোনো ছবিও আমি করিনি। শিল্পী জীবনের পরাকাষ্ঠাই আমার চিরদিনের লক্ষ্য। আমি নিজেকে জানতে চেয়েছি এবং সেই জানার জন্যই অন্যকে জানতে চেষ্টা করেছি। আমি সাধারণের একজন, একথা আমি কখনো ভুলিনি।”
Still Life With Key
এই সাধারণের একজন হয়েই বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় আন্তরিক এবং বিরল কাজগুলি করেছিলেন। তিনি ‘শিল্পসর্বস্বতাবাদী’ বা ‘আঙ্গিকীকরণবাদী’ ছিলেন না। শিল্পের বিষয় হিসেবে গুরু অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলালের মতো ক্ষেত্রকে বেছে না নিয়ে তিনি চোখ রেখেছিলেন তাঁর চারপাশের প্রকৃতি, প্রান্তর, প্রাণী, মানুষ আর বিপুল প্রজ্ঞার জগতের উপরে। আসলে, প্রকৃতঅর্থে তাঁর গুরু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজেই বলেছেন, “আমার ছবি না দেখলে আমার জীবনের বৈশিষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে না।”