রবীন্দ্রগান আর সেলাইয়ের এক আশ্চর্য আলাপ

“সেথা করে আসা যাওয়া
নানারঙা মেঘগুলি।
আসে আলো,আসে হাওয়া
গোপন দুয়ার খুলি”
রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’ ও ‘চিত্রবিচিত্র’-র ‘ফুল’ কবিতায় রয়েছে এই পঙ্ক্তিগুলি। শেষ পঙ্ক্তিতে গোপন দুয়ার খোলার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কী সেই গোপান দুয়ার? সেখানে হয়তো কল্পলতার আসন পাতা হয়। আর সেই আসনে বসেই সীমা সেন বোনেন রবীন্দ্র-গানের অন্তর্জগৎ।
নদীয়া জেলার শান্তিপুরের উল্লেখযোগ্য একজন বুনন শিল্পী হলেন সীমা সেন। পারিবারিক সূত্র ধরে সেলাইয়ের জগতে প্রবেশ। আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী ললিতমোহন সেনের পরিবারের পৌত্রবধূ। স্বামী প্রবর্তক সেন, মেয়ে শ্রীদত্তা সেন। যদিও বঙ্গদর্শনের পাঠকরা ইতিমধ্যে সীমা সেনের সেলাই এবং পরিচয় সম্পর্কে অবগত রয়েছেন, তবু আরো একবার গৌরচন্দ্রিকা সেরে নেওয়া।
সম্প্রতি, কবিপক্ষ উপলক্ষে শান্তিপুরের প্রতিচ্ছবি আয়োজিত গোস্বামীপাড়ার বনকুঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সীমাদির একক বুননশিল্পের প্রর্দশনী। সীমাদি এবারের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের জগৎ। গানের মধ্য দিয়ে দৃশ্যকল্পের খোঁজ। এই খোঁজের পথে তিনি বেঝে নিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দশটি গান, যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে দৃশ্যবীজ। আর, এরই সূত্র ধরে সীমাদির সেলাইয়ের সজীবতায় আবার সবুজ আঙিনায় ভর করে আমরা কিশলয় ভোর দেখলাম। আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, নাটক ইত্যদির মধ্যে অপার দৃশ্যবীজ তো লুকিয়েই থাকে।
“ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে
কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে”
বারে বারে এই যে কান পেতে থাকার মধ্যে এক অবলোকনের জন্ম হয়। যে অবলোকন দৃশ্যমানতা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য প্রচ্ছন্ন রহস্য আমাদের মুগ্ধতার অবচেতন স্তরে নিয়ে যায়। যে অবচেতনকে ভর করেই হয়তো সীমাদি বুনে চলেন একের পর এক বুননভাষ্য।
আরও পড়ুন
বাংলার আসনের অন্দরের কথা ১
সীমাদির বেছে নেওয়া গানগুলি ছিল–
১. এসো এসো প্রাণের উৎসবে
২. আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
৩. একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ
৪. বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
৫. ফিরে চল্ ফিরে চল্ ফিরে চল্ মাটির টানে
৬. আমি তোমারি মাটির কন্যা জননী বসুন্ধরা
৭. সে বাতাসে তরী ভাসাব না যাহা তোমা পানে যদি নাহি বয়
৮. মাটির প্রদীপ সারা দিবসের
৯. আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
১০. হে নূতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ
পাবলো পিকাসো বলেছিলেন, ‘যে ছবি আঁকে তার শুধু দুটো চোখ থাকে? আর যে গান করে তার শুধু কান থাকে? আসল ব্যাপারটা একেবারে উল্টো।’ বস্তুত, এই গানগুলির মধ্যে দিয়ে সীমাদি ছবি ও গানের গূঢ় রহস্যময়তার দিকগুলি ধরতে চেয়েছেন। যেখানে উঠোন রাঙা হচ্ছে কৃষ্ণচূড়া আভায়, অঙ্গনের মাতৃস্নেহে বড় হওয়া বেগুন গাছ, উঠোনের একপাশে লাউগাছের মাঁচায় লাউ ধরেছে, বাড়ির পৈটেয় বসে শিশু নিজের মনে পড়ছে সহজপাঠের ছড়া। অদ্ভুত এই দৃশ্যসৃজনের মধ্য দিয়ে এক নিজস্ব জগৎ তৈরি করেছেন শিল্পী। প্রতিটি ছবিতে রয়েছে একান্ত কিছু নিজস্বতার ছাপ। কল্পপথিকের এই দৃশ্য-সন্ধান যা ছবিগুলির দিকে এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। এ দেখার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রগানের ছায়া সুজন হয়ে উঠি আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের জায়গায়।
সীমাদির সেলাইতে প্রথাগত বুননের থেকে অপরদিকে যাওয়া আছে। কোথাও কোথাও ছবিগুলিতে আত্মমগ্নতার নানা দিক লক্ষ করা যায়। বিশেষত তাঁর সেলাই করা একটা পোষ্টকার্ড অবাক করে দেয় আমাদের। অন্যান্য সমস্ত ছবিগুলি ছাপিয়ে যেন এই ছবিটার দিকেই বার বার তাকাতে ইচ্ছে করে। কারণ, আজ আমাদের কাছে স্মৃতির সেই পোষ্টকার্ড আর নেই। তার উপর, আবার সেই চিঠিতে সেলাই করা রবীন্দ্রনাথ এবং ডাক-টিকিটের রবীন্দ্রনাথ অপার মুগ্ধতার দিকে নিয়ে যায় আমাদের। আমরা অবাক হই, জেগে উঠি আত্মতায়।
গান ও দৃশ্যের মধ্যে একটি নিবিড় ভূখণ্ড আছে। সেই ভূহণ্ডের খোঁজ পেয়েছেন সীমাদি। তাঁর বুনন ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরাও সেই অলীক ভূখণ্ডের বাসিন্দা হয়ে উঠি কখন। গান জুড়ে আসে ক্যানভাসে, রঙে ভরে ওঠে সুর।