No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সারা ভারতের মধ্যে প্রথম হাতি পোষ মেনেছিল এই বাংলায়   

    সারা ভারতের মধ্যে প্রথম হাতি পোষ মেনেছিল এই বাংলায়   

    Story image

    চার বেদের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন হল ঋগ্বেদ। যে সময়ে ঋগ্বেদ লেখা হয়েছিল, তখন আর্যরা হাতি চিনতেন না। ঋগ্বেদে মাত্র ৫ বার ‘হস্তি’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্যের মতে, ৩ জায়গায় ‘হস্তি’ মানে হাত বা পা-ওয়ালা ঋত্বিক। আর ২ জায়গায় ‘হস্তি’ বলতে হাতি বোঝানো হয়েছে। তবে এটা পরিষ্কার যে আগে তাঁরা কখনও হাতি দেখেননি। তাই হাতির সম্পর্কে লিখেছেন, “মৃগা ইব হস্তিনঃ” এবং “মৃগ ন হস্তি” অর্থাৎ হাতওয়ালা মৃগ। এমনকি শুঁড় বা ‘শুণ্ড’-রও কোনো উল্লেখ নেই। 

    তৈত্তিরীয় উপনিষদে অবশ্য স্পষ্ট করেই বলা আছে হাতির কথা। হিমালয় দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে হাতি বলি দেওয়ার নিদান রয়েছে সেখানে। ষোড়শ মহাজনপদের যুগ, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে হাতিকে পোষ মানানোর রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ এবং তাঁর ভাই দেবদত্ত, দু’জনেরই হাতি ছিল একটি করে। ‘কথাসরিৎসাগর’ থেকে জানা যায়, হাতি বশ মানানোয় যথেষ্ট নাম করেছিলেন বৎস রাজ্যের শাসক উদয়ন। তাঁর শ্বশুর চণ্ডপ্রদ্যোতেরও হাতিশালা ছিল। 

    তবে উত্তর ভারতের মানুষরা যখন হাতি ধরা শিখেছেন, তার অনেক আগে থেকেই এই বাংলার মানুষ হাতিকে বশ মানানোর কৌশল রপ্ত করেছিলেন। রামায়ণে আছে রাজা দশরথের জামাই লোমপাদের গল্প। এই লোমপাদ অঙ্গরাজ্যের রাজা ছিলেন। তাঁর একবার শখ হয়েছিল, দেবরাজ ইন্দ্র যেমন হাতির পিঠে চড়েন, তিনিও সেভাবে হাতি পিঠে বসে ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু হাতি কীভাবে বশ করতে হয়, সেই বিদ্যা আশেপাশের কেউই জানতেন না। তিনি শরণাপন্ন হলেন ঋষিদের। কিন্তু ঋষিরাও পারতেন না হাতিকে পোষ মানাতে। অবশেষে হাতি খুঁজতে দিকে দিকে লোক পাঠালেন তাঁরা। 

    এদের মধ্যে একটা দল অনেক ঘুরতে ঘুরতে এক বিশাল আশ্রমের সামনে হাজির হল। পাহাড়ে ঘেরা সেই জায়গা, লৌহিত্য বা ব্রহ্মপুত্র নদী সেখান দিয়ে গিয়ে সাগরে মিশেছে। আর ওইখানে চরে বেড়াচ্ছে অনেক হাতি। একজন মুনিও রয়েছেন, যিনি হাতিদের পরিচর্যা করেন। এই সব দেখে শুনে তারা ফিরে গেল রাজার কাছে। শুনে তো রাজা ভারি খুশি। তখনই লোকলস্কর নিয়ে সেই জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সেখানে গিয়ে তিনিও হাতিদের দেখা পেলেন, কিন্তু হাতিকের যিনি লালন-পালন করেন, সেই মানুষটির সঙ্গে তখন সাক্ষাৎ হল না। জানতে পারলেন, হাতিদের সেবা করতেই তিনি দূরের কোথাও গেছেন। রাজার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁর নির্দেশে হাতির দলকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল চম্পা নগরে, যা কিনা লোমপাদের রাজধানী। ঋষিদের কথামতো সেখানে একটা হাতিশালা বানিয়ে রাখা হল ওই হাতিগুলোকে।

    এদিকে সেই মুনি তো আশ্রমে ফিরে এসে দেখলেন, হাতিদের কোনো চিহ্ন নেই। দুঃখে তাঁর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। খুঁজতে বেরোলেন প্রিয় পোষ্যদের। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে এক সময়ে খবর পেলেন, চম্পা নগরীতে সেই হাতিগুলোকে রাখা আছে। তখনই ছুটে গেলেন সেখানে। দেখলেন, হাতিদের বেঁধে রাখা হয়েছে, তারা অসুস্থ, না খেয়েদেয়ে স্বাস্থ্য গেছে ভেঙে, সারা দেখে ঘা। তখনই গাছগাছালি থেকে ঔষধি পাতা-শেকড়-বাকড় নিয়ে হাতিদের সুশ্রুষা করতে লাগলেন সেই লোকটি। তাঁকে পেয়ে হাতিদেরও আনন্দ আর ধরে না।

     
    খবর গেল রাজা লোমপাদের কাছে। রাজা এসে ওই মুনিকে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। কিন্তু সেই মুনি তো আর মুখ খোলেন না। অনেক সাধ্যসাধনা করা হল তাঁকে। শেষমেশ তিনি বলেন, তাঁর বাবা সামগায়ন, মা রেণুকা। গোত্র কাপ্য। হাতিরাই তাঁর বন্ধু। হাতিদের পালন করেন বলে লোকে তাঁকে ‘পাল’ বলে ডাকে। তাঁর নাম তাই পালকাপ্য এরপর রাজার অনুরোধে হাতিদের কীভাবে চিকিৎসা করতে হয়, সেটাও জানালেন, যার নাম ‘হস্ত্যায়ুর্বেদ’ বা ‘পালকাপ্য’। পণ্ডিত চেন্তসাল রাও আর্যদের সাড়ে চার হাজার গোত্রের নাম সংগ্রহ করেছেন। তাতে কাপ্য নামের কোনো গোত্র নেই। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে, এই পালকাপ্য আর্য ছিলেন না। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে করেন, পালকাপ্য ছিলেন বঙ্গদেশের বাসিন্দা। একদিকে হিমালয় পর্বত, একদিকে ব্রহ্মপুত্র নদী এবং আরেকদিকে সমুদ্র। এরই মাঝখানে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সারা ভারতের মধ্যে প্রথম হাতিদের পোষ মানানো হয়েছিল এই বঙ্গভূমিতেই। 

    হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এটাও জানিয়েছেন, ‘হস্ত্যায়ুর্বেদ’ পড়তে পড়তে তাঁর মনে হয়েছে, তা অন্য কোনো ভাষা থেকে সংস্কৃতে অনুবাদ করা হয়েছে, পুরোপুরি সংস্কৃত ব্যাকরণ মেনে তা চলছে না। সারা ভারতে এখনও অবধি খুঁজে পাওয়া হাতিদের ওপর রচিত এই বই এটিই প্রথম। মহাকবি কালিদাসের লেখা থেকে জানা যায়, এই শাস্ত্র খুবই প্রাচীন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৫ম বা ৬ষ্ঠ শতকের মানুষ ছিলেন এই পালকাপ্য। 

    তথ্যসূত্র – বাংলার গৌরব, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সম্পাদনা – জিসান হাবিব, প্রকাশক – পত্রলেখা। 
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @