No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    হিমালয়ের কোলে ইচ্ছেপূরণের গ্রাম

    হিমালয়ের কোলে ইচ্ছেপূরণের গ্রাম

    Story image

    আকুল তিস্তাকে পাশে রেখে গাড়ি মোড় নিল ডানদিকের চড়াইতে। কিছুক্ষণ আঁকাবাঁকা পথ পেরোতেই সুন্দরী কালিম্পং। কালিম্পং ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল পেডং-এর দিকে। পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমের সীমানা এখানে। পেডং অবধি অবশ্য যেতে হবে না। তার আগেই পড়বে ছবির মতো সুন্দর আর্মি চেক-পোস্ট। রাস্তার দুপাশ জুড়ে পাইন। রংবেরঙের বৌদ্ধ নিশান উড়ছে হাওয়ায়। একটা নাকের মতো টিকালো পাহাড়কে বাঁ হাতে রেখে খানিক এগোতেই রামধুরা। রাস্তার ওপরেই গুটিকয় কাঠের খেলনা বাড়ি। বড়ির সামনে একচিলতে বারান্দায় বাহারি রঙের ফুল। ছোট্টো এক জনপদ। আর, সেই রামধুরাকেও ছাড়িয়ে সামান্য এগোলেই ডানহাতের সাইনবোর্ডে লেখা—‘ওয়েলকাম টু ইছেগাঁও’। সরু রাস্তা বেঁকে গেছে অজানা দেশের দিকে। বুনো ঝোপ, পাইন, বার্চের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গাড়ি উঠছে। আপনাদেরও আর তর সইছে না। মিনিট দশের মধ্যেই ম্যাজিক। একটা ছবির মতো সুন্দর গ্রামের নিচে এসে থামবে গাড়ি। সামনেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে লোকসাম বা রুম্বা। মালপত্তর নিয়ে যাবে পাহাড়ের মাথার ঘরটায়। আপনাদের কদিনের ঠিকানা আপাতত ওখানেই। ইছেগাঁও।

    আকুল হল তিস্তা

    ‘ইছে’—লেপচা ভাষায় শব্দের অর্থ ‘সবচাইতে উঁচু’। পাহাড়চুড়োয় সবচাইতে উঁচু গ্রাম। উচ্চতায় যদিও মাত্র ৫,৮০০ ফুট। তবু, পাহাড়ের চুড়ো তো। তবে, আপনার খালি মনে হবে, এই অর্থ ঠিক না। আসলে এই গ্রামের নামের আড়ালে অন্য ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। এই গ্রাম আসলে ইচ্ছেপূরণের গ্রাম।

    গোটা তিরিশেক পরিবারের বাস ইছে-তে। এক ঘরের উঠোন বেয়েই ধাপে-ধাপে সিঁড়ি বেয়ে পরের ধাপ। উঁচু ধাপের ঘর থেকে নিচের ঘরে অনায়াসে কথা চালাচালি করছেন মহিলারা। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে তুলো-লোমের কুকুর, মুরগি। ঝুড়িচাপা মুরগির ছানাগুলো কুটুরকুটুর করছে। পাথরের সিঁড়ির ধাপে রঙিন বুনো ফুলের ঝাঁক। বাড়ির সামনে অর্কিড। পাশেই বড়ো এলাচের ক্ষেত, গ্রামের ওপরে একপোঁচ হলুদ। লোকসাম হেসে জানান দিল, ওগুলো সর্ষে। গ্রামে চাষও হয়।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা

    আর, গ্রামটাকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ঘিরে আছে ঘন বন। ডানদিক থেকে বাঁদিক। পাইন, বার্চ, নাম না জানা হিমালয়ান বৃক্ষরা যেন পাহারা দিচ্ছে এই গ্রাম। গা-ভেজানো শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে খেলা করছে মিহি রোদ। লালমুখো, গোলগাল পাহাড়ি শিশু আপনার দিকে ভেবলে তাকিয়ে। দেখে আদর না করে পারাই যাবে না। আর, বাঁদিকের কোণে রাজসিকভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুধসাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা।

    গ্রামের পথ

    ইছেগাঁওকে তাই ইচ্ছেপূরণের গ্রাম মনে হবেই আপনার। কাঠবাড়ির ভিতরটাও অলীক। দেওয়াল-জোড়া জানলা। পর্দা সরিয়ে দিলেই বাইরের পাহাড়-মেঘ থরে থরে ঢুকে আসবে ঘরে। দু’পাশে দুটো বিছানা, লোভনীয় লেপ। মাঝে একচিলতে টেবিল। বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে বসে কফিতে চুমুক দিতে-দিতেই মাথার চুলে খেলা করে যাবে হিমালয়ের বাতাস। হয়তো চিন থেকে উড়ে আসছে সে। কাঞ্চনজঙ্ঘা রং বদলাচ্ছে শেষ-বিকেলে। শুধু সেইদিকে তাকিয়েই ভুলে যাওয়া যায় জীবনের সমস্ত হিসেব না মেলা অঙ্ক, অফিস-ব্যবসার দুশ্চিন্তা, ক্ষয়কারী যাপনের সমস্ত কাদা-মাটিগুলো। বাঁদিকে ঘন পাইনের মাথায় তখন সূর্য এসে নামছে। সামনে মেঘের নদী। আর নিচে সত্যিই নদী বইছে। তিস্তা। দেখতে গেলে অবশ্য আরও খানিক উঠতে হবে। গ্রামের মাথা ছাড়িয়ে পাহাড়ের মাথায়।

    আরও পড়ুন
    পায়ে-পায়ে পেডং

    ঘোর লেগে যাবে নিশ্চিত। সেই ঘোরকে আরো ঘন করতে নামবে সন্ধে। সামনে পাহাড়গুলোয় একে-একে জ্বলে উঠবে জোনাকি বাতির টিমটিমে নেশার ঝাঁক। দার্জিলিং, তিনচুলে, রাবাংলা থেকে উজিয়ে আসা আলো। শীত আরো জমাটি হবে তখন। সন্ধে হতে না হতেই ঘরেই বানানো স্বর্গীয় স্বাদের মোমো বা চিকেন পকোড়া দিয়ে যাবেন হোমস্টের মালকিন-দিদি। তাঁর একগাল হাসি আর আন্তরিকতা কখন ভুলিয়ে দিয়েছে আপনার পর্যটক-পরিচয়। আপনি তাই অনায়াসে আবদার জুড়বেন আরো এক কাপ কফির। আবদার পূরণ হতে মোটেই সময় লাগবে না। ইচ্ছেপূরণের গ্রাম—বলেছিলাম যে। সেই কফির কাপ হাতে নিয়েই আপনি এসে দাঁড়াবেন রান্নাঘরে। কাঠের দরজা দিয়ে ঢুকতেই অন্য জগৎ যেন। মোমের আগুনে-আলো। কাঠের উনুন। তাতেই রান্না চলছে। চাপা গলায় লেপচা ভাষায় কথা বলছেন নিরীহ মানুষগুলো। এক নরম উত্তাপ ঘিরে ঘরটাকে। এখান থেকে ফেরা যায় আর ঝাঁ-চকচকে বিত্তবিলাসী শহরে!

    ঘরের বাইরে

    পরেরদিন ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা আলোর স্নান সারবে। স্থানীয় গাইডের সাহায্যে আপনিও হাঁটা লাগান এবার। ট্রেক। ইছে-তে এসে ট্রেক না করলে মজাই নেই। পাহাড়ের চুড়োয় উঠে ডানদিক এগোলেই ঘন বনের গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যাবে তিস্তা। তারপর সেই রাস্তা ধরে বনপথে এগোলেই দু-আড়াই কিমি পরে সিলারি গাঁও। একই পর্বতের দু’দিকে দুই গ্রাম। সিলেরিতে চা খেয়ে ৪কিমি ডানহাতে গেলেই দামসুং দুর্গের ভগ্নাবশেষ। ১৬৯০ সালে এক লেপচা রাজা বানিয়েছিলেন এই দুর্গ। অ্যাংলো-ভুটান যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায় তা। এখন ফার্ন, মস, শিশিরে ভেজা অলীক মাকড়সার জাল, আকাশছোঁয়া পাইনদের পাশে রেখে হাঁটতে হাঁটতে এখানে পৌঁছে যাওয়া যায় দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে। পাথরের চাঁইগুলো কত গপ্প জানে, কিন্তু কথা কইতে পারে না। আর, এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার গোটা রেঞ্জটা দেখা যায় স্পষ্ট। রূপকথার দেশ যেন।

    ছোট্টটি

    ফেরার পথে ক্লান্ত না থাকলে চলে যান রামিতে দারা ভিউ পয়েন্টে। সিলারির বাঁদিকে আরও দুই কিমির মতো পথ। ক্লান্ত লাগলে যেতে পারেন পরেরদিনও। এই পথে হাঁটতে হাঁটতে অবশ্য ক্লান্তি ছুঁতেও পারবে না আপনাকে। আপনার সঙ্গের গাইডরা যদি হয় খুদে-খুদে, তাহলে তো ক্লান্তির কাছে ঘেঁষারই উপায় থাকবে না। আপনার সঙ্গে যেতে যেতেই হুট হাট উধাও হয়ে যাবে তারা। কোনো এক বাঁকে ফের লাফিয়ে নামবে পাহাড়ের গা বেয়ে। বুনো ফুল, রঙিন পাতা, কাঞ্চনজঙ্ঘার একের পর এক ফ্রেম, বনের পথ... এরপর রামিতে পৌঁছে গায়ে কাঁটা দেবে। খাদের গায়ে শেষ পাথরে গিয়ে দাঁড়াবেন। ডানদিকে রাজকীয় সোনার পাহাড়। নিচে চোদ্দখানা বাঁক নিয়েছে তিস্তা। আপনার আর তিস্তার মাঝখানে ঝুলছে মেঘ। ওখান থেকে ফিরতে মনই চাইবে না।

    হোমস্টের আড়ালে উঁকি মারে ওই

    ইছেগাঁওতে এমন আরো অনেক গপ্পেরা লুকিয়ে। চাইলে খুঁজে নেওয়া যায় আরো ট্রেক রুট। সব হদিশ বলে দিলে যাওয়ার ইচ্ছেটাই হয়তো কমে যেতে পারে। সন্ধানটুকু দেওয়া কাজ, তা দিতে গিয়েই কত কথা বলা হয়ে গেল। ফেরার পথে চাইলে ঘুরে দেখতে পারেন কালিম্পং শহর। ইছে গাঁওয়ের থেকে মাত্র ১৭ কিমি। পথে পড়বে আরো অসংখ্য ভিউ পয়েন্ট। আর, আপনি নিজেও আবিষ্কার করতে পারেন অলীক সব বিন্দু। নাকের মতো টিকালো পাহাড় বা কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের ডানদিকের শেষ শৃঙ্গকে সবচাইতে স্পষ্ট দেখার কোনো জায়গা। পাহাড় আপনাকে কখনোই হতাশ করবে না।

    তাছাড়া, গাঁ-টি যে ইচ্ছেপূরণের।

    কীভাবে যাবেন?
    এনজেপি থেকে ৮৮কিমি আর বাগডোগরা থেকে ৯১ কিমি দূরত্ব ইছেগাঁওয়ের। গাড়ি ছাড়া উপায় নেই যাওয়ার। যে হোম স্টে-তে থাকবেন সেখান থেকেই গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা আছে। চাইলে চলে আসতে পারেন কালিম্পং। সেখান থেকেও গাড়ি মিলবে।

    কোথায় থাকবেন?
    ইছেগাঁওতে থাকার জায়গা বলতে হোম স্টে। একাধিক হোম স্টে গ্রাম জুড়েই। অনলাইন বুকিং-ও চলে দিব্বি।

    কী কী দেখবেন?
    গ্রামের ভিতরেই অসংখ্য মণিমুক্তো ছড়ানো। পায়ে হেঁটে খুঁজে নিন। ট্রেক রুট আছে বেশ কয়েকটি। গাড়িতে ঘুরে আসুন পেডং, তিনচুলে এবং কালিপং।

    কখন যাবেনঃ
    বর্ষা বাদে সারা বছর। তবে, কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখতে চাইলে সেরা সময় অক্টোবর থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। শীতকালে তাপমাত্রা নেমে যায় ১-২ ডিগ্রিতে। সেই বুঝে গরম জামাকাপড় নেওয়াটা আবশ্যিক।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @