No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    পুতুলখেলার বাসন-কোসন

    পুতুলখেলার বাসন-কোসন

    Story image

    ঘুঘু ডাকা গ্রীষ্মের গ্রাম্যদুপুর। কিম্বা মফঃস্বলের সাবেকি দরদালানের এক চিলতে মুক্ত পৃথিবী। এখানেই জমে উঠত শৈশবের খেলাঘর। খেলাপাতুনির সংসারে পুতুলখেলা। মাটির তৈরি ছোট্ট হাঁড়ি কলসি থালা গেলাস উনুন। বরবউ পুতুল। ঢেঁকি হাতা খুন্তি। এই টুকুনি বঁটি। শ্যামা বামা রুপু বুন্টির সঙ্গে হারু ফেলারা। কেউ বাবা মা বেহাই বেয়ান ইত্যাদি। কেউ আবার কনেপুতুলের ভারিক্কি বাপ। বয়স সাত কিম্বা আট হলে কী হবে! রুপু তো এই বয়সেই পাক্কা গিন্নি! বাজারহাট করা, শ্বশুর শাশুড়ির সেবাযত্ন করা, ধানসেদ্ধ মুড়িভাজা কিচ্ছুটির ত্রুটি নেই। তার উপর রান্নাবান্না করে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়া। গোলাম মোস্তাফার সেই পদ্যটা কি মনে পড়ে?

    রান্না তাদের শেষ হলো যেই গিন্নী হলো নুরু।
    একলাইনে সবাই বসে করলে খাওয়া শুরু।।
    ধুলো বালির কোর্মা পোলাও আর সে কাদার পিঠে ।
    মিছামিছি খেয়ে সবাই বলে বেজায় মিঠে।।

    এখন তো ব্লু-হোয়েল বা নীল তিমির মারণখেলায় আক্রান্ত আমাদের শৈশব কৈশোর। শৈশব থেকে বিদায় নিয়েছে সবুজ খেলার মাঠ। হরেক প্রকার লোকখেলা। এখন শুধু ভিডিও গেম আর এইসব অনলাইন মারণগেম। ভাইরাল হয়ে আছড়ে পড়েছে সবুজ কৈশোরের অবুঝ মনের অলিগলিতে।

    কিন্তু ঐ যে লোকশিল্পী চন্দনা পাল। অঘ্রাণের এই সকালে মিষ্টি রোদে বসে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করে চলেছেন মাটির খেলনার বাসনকোসন। হাঁড়ি-কড়াই ফ্যানগালুনি গামলা গেলাস উনুন আরও কত কী। সামনেই উত্তরান্তির মেলা। বছরের এই সময়ে মাটির খেলনার খুব চাহিদা। গরিবগুর্বো ঘরের গাঁ-গঞ্জের ছেলেমেয়ে। বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে এসে জোর বায়নাক্কা - খেলনা বাসন চাই। ঢেঁকি চাই। আর চাই ঝুমঝুমি কটকটি বাঁশি।আর লালজিলিপির ফুলঝুরি।

    কথা হচ্ছিল মৃৎশিল্পী চন্দনার সঙ্গে। বয়স চল্লিশের ঘরে। স্বামী রঞ্জন পাল। টুকটাক ঠাকুর গড়েন। চাকে বানান হাঁড়ি কলসি। মিষ্টির হোলা। একমাত্র ছেলে মাটির কাজে কিচ্ছুটি করতে না পেরে অন্য পেশায়। কিন্তু চন্দনা শাশুড়ির কাছ থেকে কাজ শিখে শিল্পকর্মটিকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন পরম মমতায়। আগে মাটির পুতুল গড়তেন। মেছনী গোপালঠাকুর সখি আর হরেক রকমের পাখি। পুতুল বর বউ বড়াইবুড়ি। পোড়ামাটির পুতুলের চাহিদা কমে যাওয়ায় সেসব পাট কবে গেছে চুকে বুকে। তবে ছাড়তে পারেননি খেলার সংসারের এই বাসনকোসন তৈরি।

    অঘ্রাণ মাস পড়লেই সকাল থেকে লেগে যান মাটি সানায় পরিপাটিতে। তারপরে ছাঁচে ফেলে এইসব খেলনাগুলি তৈরি করেন। সংসারের ঝক্কি ঝামেলা সহ্য করে প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ পিস খেলনা বাসন বানান। শুকিয়ে নিয়ে পোড়ানোর কাজ। সে কাজে সহয়তা করেন স্বামী রঞ্জনবাবু। অবশেষে রঙের কাজ। রঙ বলতে মেরুন কালার। তারপর বার্নিশ দিয়ে ফিনিশিং টাচ। বিক্রি হবে শীতকালভর গ্রামীণ মেলাখেলায়। ইদানিং অবশ্য শহরের বউঝিরা বাড়ির শোকেস সাজানোর জন্য এই সব খেলনা বাসনকোসন কিনছেন। চন্দনার বর্তমান সাকিন বর্ধমানের পাতাইহাট পালপাড়ায়।

    জিজ্ঞাসা করলাম, কবে থেকে এ কাজ করছেন? চন্দনা সলজ্জ হাসিতে বললেন - বহুদিন আগে থেকে। এ-কাজ এমনিতেই বহুদিনের পরম্পরা। চন্দনা সেই আবহমান পরম্পরার একটি নিরবিচ্ছিন্ন অংশ। নাট্যকার শূদ্রকের লেখা বিখ্যাত নাটক মৃচ্ছকটিকম। মানে মাটির খেলনা গাড়ি। প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে বিশেষকরে মোগলমারিতে প্রত্নখননে মিলেছে মাটির খেলনা গাড়ির চাকা, গুলতির বল, পাশার ঘুঁটি, পুঁতি এমনকি কিতকিত খেলার চাকতিও। সব ক’টিই পোড়ামাটির। এগুলি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের বলে অনুমান পুরাতত্ববিদদের। ফিরে আসি চন্দনার কথায়।

      --একসেটের দাম কত?
      ---মাত্র ৩০ টাকা।
     --এতে চলে আপনার? সব খরচখরচা বাদ দিয়ে লাভ থাকে কিছু?
    --- লাভ নেই। কী আর করা যাবে! ঐ বসে থাকি না বেগার যাই! আর সত্যি বলতে কী, সেই শৈশবের ভালোবাসার টানে আমার এই গড়নের কাজ। পালবাড়ির মেয়ে আর বউ তো! রক্তে আমাদের মাটির টান!

    তারপর এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললেন - আমিও খেলাপাতুনির সংসারে খুউব পুতুল খেলতাম যে!

    (কৃতজ্ঞতাঃ শাব্বির আহমেদ তরফদার)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @