দুর্গাচরণের সেরেস্তা, রামপ্রসাদ আর এক ‘ব্রাহ্মনাইজড ইউরোপিয়ান’

কলকাতার দুর্গাচরণ মিত্রর সেরেস্তায় সেদিন চাপা হুলুস্থুল পড়ে গেছে। কর্মচারী, নায়েব এমনকি চাকর-বাকররা পর্যন্ত কানাকানি করছে এক মুহুরির সম্ভাব্য শাস্তি নিয়ে। তাঁকে এবারে চাকরি থেকে তাড়াবেনই দুর্গাচরণ। অনেকদিন ধরে কান ভাঙানোর চেষ্টা হয়েছে মালিকের। একজন সামান্য কেরানির এত সাহস, যে বাবুরই নুন খেয়ে তাঁর সেরেস্তার কাজে ফাঁকি দেয়! হাজারো নালিশের পর অবশেষে টহলে এসেছেন খোদ দুর্গাচরণ। বাছাধন আর যাবে কোথায়!
চাপা উত্তেজনা আর উল্লাস তখন দুর্গাচরণ মিত্রর সেরেস্তা জুড়ে। যাঁকে নিয়ে অভিযোগ, হালিশহরের রামপ্রসাদ সেন এক কোণে অপরাধীর মতো বসে। দুর্গাচরণের সামনে খোলা হিসেবের খাতা। তিনি গম্ভীর মুখে সেই খাতা পর্যবেক্ষণ করছেন। তাতে হিসেব সামান্যই। বরং, পাতার পর পাতায় লেখা পদ। পদের ভিতরে কাটাকুটি। দুর্গাচরণের মুখ আরও গম্ভীর হয়। তাহলে তো নায়েব ও অন্যান্য কর্মচারীদের অভিযোগ সত্যি। এই ছেলেটা কাজে ফাঁকি দিয়ে সেরেস্তার হিসেবের খাতা নষ্ট করে কিনা এইসব ছাইপাঁশ লেখে! ক্রুদ্ধ দুর্গাচরণ রামপ্রসাদকে কড়া কথা শোনাতে যাবেন, এমন সময়ে তাঁর চোখ আটকে যায় একটা পদে।
‘আমায় দে মা তবিলদারি।
আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী।।
পদরত্ন ভান্ডার সবাই লুটে, ইহা আমি সইতে নারি।
ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা, সে যে ভোলা ত্রিপুরারি।
এ কী অদ্ভুত লেখা! দুর্গাচরণ মুগ্ধ হয়ে পড়তেই থাকেন বারবার। ‘শিব আশুতোষ স্বভাব দাতা, তবু জিম্মা রাখো তাঁরি।/ অর্ধ নগ্ন জায়গির তবু শিবের মাইনে ভারি।’ সেরেস্তার সামান্য মাইনের মুহুরি রামপ্রসাদ এমন পদ লিখল কী করে? দুর্গাচরণ যে সে মানুষ নন। তিনি নবাব সিরাজদৌল্লার সভায় জহুরি ছিলেন। রত্ন চিনতে তাঁর সামান্যও দেরি হয় না। তিনি বুঝতে পারলেন, রামপ্রসাদ সামান্য মানুষ নয়। যে এমন পদ লিখতে পারে, সে যত বড় ভক্ত, তত বড়ো স্রষ্টাও বটে। কলকাতার সেরেস্তায় তাঁকে সত্যিই মানায় না। বরং হিসেবের খাতাগুলি ধন্য হয়ে গেছে এমনভাবে ‘নষ্ট’ হয়ে।
অতএব, রামপ্রসাদকে কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে হালিশহরে১ ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন দুর্গাচরণ মিত্র। তাঁর কানে অভিযোগ পৌঁছে দেওয়া অন্যান্য কর্মচারীরা এটাই চেয়েছিল বটে, কিন্তু এভাবে ব্যাপারটা ঘটবে কল্পনাও করেনি। এ তো দণ্ড নয়, উলটে পুরস্কার। রামপ্রসাদের চাকরি গেল, অথচ তাঁর জন্য বহাল হল তিরিশ টাকার মাসিক ভাতা। দুর্গাচরণ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন মন ঢেলে লিখতে। জীবিকার প্রয়োজনে এমন সাধক কবির কবিত্ব সাধনায় সামান্য বিচ্যুতিও ঘটুক, তা তিনি চান না।
রামপ্রসাদ সেনের এই গল্প আজও মুখে মুখে ঘোরে অনেকের। হিসেবের খাতা থেকে সেইসব শাক্তপদ পরে উঠে এসেছে বাংলাদেশের আনাচ-কানাচের সাধক-ভক্ত-রসিক পাঠকদের মুখে মুখে, কণ্ঠে। কিন্তু, রামপ্রসাদের এই খ্যাতির প্লাবনের মাঝে কোথাও যেন প্রান্তিক হয়ে গেছে কলকাতার দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির সেই বিখ্যাত সেরেস্তা আর দুর্গাচরণ মিত্রর কথা।
দর্জিপাড়ার মিত্র পরিবার কলকাতার বনেদি পরিবারগুলির অন্যতম। একটা সময়, বিডন স্ট্রিট জুড়ে বিছিয়ে ছিল মিত্রপরিবারের বিভিন্ন বাড়ি। রাঢীয় কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত মিত্র পরিবারের আদি পুরুষদের বাস অবশ্য ছিল বড়িষা গ্রামে। সেখান থেকে কোন্নগর, আড়িয়াদহ ঘুরে অবশেষে সুতানুটিতে মিত্রবংশকে স্থায়ীত্ব জগন্নাথপ্রসাদ মিত্র। দর্জিপাড়ার মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। এই জগন্নাথপ্রসাদেরই পৌত্র দুর্গাচরণ মিত্র।
দুর্গাচরণের জন্ম ১৭১০-এ। বেঁচেছিলেন সাতাত্তর বছর। মাঝের সময়টুকু বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের ভোল বদলে দিয়েছিল। এই সময়েই নবাবি শাসনের পতন, লালমুখো সাহেবদের ভারতের ভাগ্যবিধাতা হয়ে গেঁড়ে বসার শুরুয়াত। এই আগুনে পরিস্থিতির আঁচ অবশ্য বিশেষ পোহাতে হয়নি দুর্গাচরণকে। বরং, রাজনৈতিক পালাবদলের অস্থিরতার মধ্যেই তাঁর বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। তমলুকে তিনি নুনের দেওয়ানি পেয়েছিলেন। সিরাজের দরবারে ‘কোর্ট জুয়েলার’ বা ‘জহুরি’ পদের কথা তো আগেই বলেছি। পাশাপাশি, সাহেবদের সঙ্গে সম্পর্কও বেশ মসৃণই রাখতে পেরেছিলেন দুর্গাচরণ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাটনা আবগারি মহলে তাঁর একচেটিয়া ব্যবসায় তাই ছেদ পড়েনি কখনো।
এহেন দুর্গাচরণের ভদ্রাসন ছিল দর্জিপাড়াতেই। আজকে তার ঠিকানা ৪২ বিডন রো। কলকাতা শহরে তখন বিপুল প্রতিপত্তি তাঁর। এই ভদ্রাসনের উত্তর-পশ্চিমে এগারো বিঘা জমি কিনে তার ওপর চারটি পুকুরসহ সাতমহলা এক অট্টালিকা নির্মাণ করিয়েছিলেন দুর্গাচরণ। তাঁর সেরেস্তাতেই এরপর মুহুরির কাজে যোগ দিয়েছিলেন রামপ্রসাদ সেন। থাকতেন দেওয়ান বাড়িরই এক অংশে। পরে এই অংশেই তৈরি হয়েছিল বাগান। কিছুদিন আগেও সে বাগানের নাম ছিল কলকাতার প্রাক্তন প্রধান পুলিশ ম্যাজিস্ট্রের এবং বহুভাষাবিদ কোটস ব্ল্যাকুইয়ের নামে। পরে, বাগানের নাম বদলে রামপ্রসাদ সেনের নামেই রাখে কলকাতা পৌরসভা।
এই ব্ল্যাকুইয়ের সাহেবের সঙ্গে রামপ্রসাদ সেনের সমাপতন এখানেই শেষ নয়। অন্য একটা দূরগত মিলও আছে। সাহেব হলেও প্রাচ্যজ্ঞান আর প্রাচ্যধর্মের প্রতি গভীর অনুরক্ত ছিলেন ব্ল্যাকুইয়ের। অনুবাদ করেছিলেন ‘কালিকাপুরাণ’ও। সেই অনুরাগ এতই গভীর ছিল যে জন ক্লার্ক মার্শম্যান এই তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন-- ‘ব্রাহ্মনাইজড ইউরোপিয়ান’।
কলকাতা সত্যিই এক আশ্চর্য শহর বটে। যার অলিতে-গলিতে এমনভাবেই বেবাক লুটিয়ে থাকে ইতিহাস। যেখানে ধনী ব্যবসায়ীর সেরেস্তায় মুহুরির কাজ করতে আসেন রামপ্রসাদ সেন। হিসেবের খাতা থেকে সেইসব পদ স্থায়ী আসন পেয়ে যায় চিরকালের খাতায়। সেই অঞ্চলের সঙ্গেই দিব্বি জড়িয়ে যায় এক সাহেবের নামও। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও তিনি কালিভক্ত। আর, থাকেন বিখ্যাত মিত্রবাড়ির বিখ্যাত দুর্গাচরণ। রামপ্রসাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে ইতিহাস যেভাবে মনে রেখেছে, তাঁকে সেভাবে রাখেনি। আর তাঁর নিজের শহর? ইতিহাসে সে এতটাই অভ্যস্ত যে, আলাদা করে আর তাকাতে ইচ্ছে করেনি সাবেক কলকাতার এই বাঙালি শিল্পপতির দিকে। তবু, তাঁর নামে রাস্তা আছে এখন। দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট। সেও তো স্বীকৃতিই বটে।