পুরুলিয়ার দেউলঘাটা মন্দিরে ঘনীভূত হয়ে আছে হাজার বছরের রহস্য

জঙ্গলে জঙ্গলে পলাশ-শিমুলের আগুন, মাঝখানে আঁকাবাঁকা লাল মাটির রাস্তা। কোথাও বা ছোটো বড়ো পাহাড় আর টিলা উঁকি দিচ্ছে, তার মধ্যেই হঠাৎ দেখা মেলে প্রাণবন্ত ঝরনার। কান পাতলে শোনা যায়, দূর থেকে ভেসে আসছে মাদলের শব্দ। সঙ্গে রয়েছে মহুয়ার চিরন্তন আকর্ষণ। এটাই ছৌ-এর দেশ পুরুলিয়া। এই জেলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে রহস্য।
কংসাবতী নদীকে বলা যেতে পারে পুরুলিয়ার প্রাণ। সেই কাঁসাই-এর তীরে জয়পুর থানা এলাকার দেউলঘাটায় খোঁজ মিলবে দুটি প্রাচীন মন্দিরের। লোকমুখে জানা যায়, আগে তিনটি মন্দির ছিল এখানে। একটা মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ভারতের সবথেকে পুরোনো যে ক’টি পোড়ামাটির মন্দির এখনও কালের গর্ভে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি, তার মধ্যে এগুলি অন্যতম। দেউল আকৃতির এই মন্দির দুটির পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
মন্দির তো বটেই, এখানকার বিগ্রহটিও মনের ভিতর অনেক কৌতূহলের জন্ম দেয়। পাথরে খোদিত দশভুজা দুর্গার মূর্তি, নিচে রয়েছেন মহিষাসুর। সিংহ এবং মহিষও হাজির। তবে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের কোনো মূর্তি নেই। দুর্গার প্রচলিত মূর্তিতে দেবীর ডান পা সিংহের গায়ে থাকে, আর বাঁ পা থাকে মহিষের ওপর। সবথেকে অবাক করার বিষয়, এখানে ব্যাপারটা উল্টো। এই মূর্তিতে মহিষের ওপর দেবীর ডান পা রাখা। বাম পা সিংহের ওপর রয়েছে। কালো পাথরে নির্মিত অপরূপ এই মূর্তির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, হাজার বছরের রহস্য ঘনীভূত হয়ে আছে এর মধ্যে।
এই মন্দির কারা প্রতিষ্ঠা করছিল, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্য মতভেদ আছে। হতে পারে, আদতে এগুলি বৌদ্ধ মন্দির। মূর্তির শরীরে বৌদ্ধ প্রভাব খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। দেবীর মাথায় চক্রস্তম্ভ, দু’পাশে রয়েছে অষ্টমাতৃকা। মন্দিরের ত্রিকোণাকৃতি দরজা বৌদ্ধ ঐতিহ্যের পরিচয় দেয়। আবার এরকম মতও আছে যে, কংসাবতী নদীর তীরে এক সময়ে বিকাশ ঘটেছিল জৈন ধর্মের। এই মন্দির আসলে জৈনদের উপসনাকেন্দ্র ছিল।
তবে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এখানে। তখন সম্ভবত এই দুর্গামূর্তির পুজো শুরু হয়েছিল। লোকমুখে শোনা যায়, অনেক যুগ আগে তাম্রলিপ্তের বণিকরা ঝাড়িখণ্ডে যেতেন বাণিজ্য করতে। তখন কংসাবতী নদীতে সারা দিয়ে নৌকো রেখে তাঁরা এই মন্দিরে পুজো দিতেন।
দেউলঘাটার মন্দির এবং মূর্তি কত পুরোনো, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে বাংলায় প্রাচীন কাল থেকে দুর্গার উপাসনা হত। এখনও মায়ের নিত্যপুজো হয় এখানে। প্রতিদিন ভক্তদের সমাগম ঘটে। দুর্গাপুজোর চার দিন এখানে থাকে উৎসবের মেজাজ। দেউলঘাটায় রাজপুতদের নিবাস রয়েছে। তাঁরা পুজোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এখানে সপ্তমী থেকে নবমী নিয়ম করে পাঁঠাবলি হয়। চার দিন সব ভক্তদের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা থাকে। খালি পেটে ফিরে যেতে হয় না কাউকেই।
তথ্যঋণ – সুমিত বিশ্বাস, সঞ্জিত গোস্বামী।