দূর্গাপূজা ও ভোগ ইতিহাস

বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গোৎসবে মেতে ওঠে আপামর জনসাধারণ। কিন্তু প্রশ্ন হল, বারো মাসে তেরো পার্বণ হওয়া সত্ত্বেও দুর্গাপূজাই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হয়ে ওঠে কেন?
এই প্রসঙ্গে দুই তিনটি ধারণার অবতারণা করা একান্ত আবশ্যিক। সভ্যতার আদিম যুগ থেকে কৃষি যেমন মানুষের জীবনে এক প্রধান স্থান অর্জন করে, তেমনই মৃত্তিকা বা মাতৃকা পূজাও বহুল প্রচলিত ও পুরনো ধারনা। সমস্ত প্রাচিন জাতির কাছে শস্য ও সন্তান ছিল প্রার্থনা ও কামনার বিষয়বস্তু। আদিম মাতৃকা উপাসনা ও বৈভব কামনার মিশ্রণেই দুর্গার পৌরাণিক রূপের উদ্ভব। নৃ-বিজ্ঞানীদের ধারণায়, শস্য প্রসাধনী রূপের বর্ণনা তেমনই দেবীর এই শস্যদাত্রী তথা শস্যরক্ষার্থী চরিত্র বিবৃত করে।
কে এই দেবী শাকম্ভরী? শাকম্ভরী রূপের বর্ণনার সঙ্গে কি আর কোনও ধারণার মিল পাওয়া যায়? বহু প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতায় এই দেবীর উল্লেখ মেলে একটি শিলমোহর। যেখানে এক তৃণপ্রসবিনী/উৎপাদনী দেবীর উল্লেখ বা চিত্র দেখা যায়। দেবী শাকম্ভরী রূপ এই শস্যদাত্রী তথা শস্যরক্ষার্থী চরিত্র বর্ণনা করে।
নবপত্রিকাকে অনেকেই গণেশের স্ত্রী মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে নবপত্রিকা নয়টি গাছের সমন্বয়, কলা ডালিম, ধান, হলুদ, মানকচু, বেল, অশোক, জয়ন্তী। এই নয়টি পত্রিকায় দেবীর নয়টি রূপ প্রতীক হিসাবে পূজিত হয়। অতএব নবপত্রিকা দেবী দুর্গারই রূপ এবং বাঙালীর কৃষিসম্প্রদায়ের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রতীক। কৃষিজীবী বাঙালি নদীমাতৃক দেশে কৃষিকেই জীবিকা করে চলেছে।
এর থেকেই দেবীর দ্বিতীয় রূপের ধারনা আসে। সেই রূপ হল ‘শতাক্ষি’। নাম থেকেই অনুমান করা যায় যে যারা শত অক্ষি বা চোখ আছে তিনিই শতাক্ষি। এইরূপ দেবী শত অক্ষি বা চোখ দিয়ে অশ্রু উৎপাদন করে ধরিত্রীকে শস্যশ্যামল করে তোলেন।
তাহলে দাঁড়াল, শাক দ্বারা আবৃত যে দেবী, যিনি শাকসবজি বস্ত্র পরিধান করেন তিনিই শাকম্ভরী। দেবী শতাক্ষি ও শাকম্ভরী যথাক্রমে জল দিয়ে ও শস্য উৎপাদন করে এই পৃথিবীকে শস্য শ্যামল করেন। শুধু তাই নয়, দেবী শাকম্ভরী ও শতাক্ষিরই অপর রূপ মহিষাসুরমর্দিনী, যিনি মহিষাসুরকে দমন করেন। এখন বিষয় হল, মহিষাসুরের সঙ্গে কৃষির কী সম্পর্ক? কৃষি নয়, সম্পর্ক শস্যের। বন্য প্রাণী ও অনাবৃষ্টির বিগ্রহ এই মহিষ-অসুর, শস্যকে বন্যপশু ও অনাবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করেন বলে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী।
এরই ফলস্বরূপ এই শস্যপ্রধান পূজায় একাধিপত্য লাভ করেছে তার উপাদেয় ভোগ। এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখ্য, ‘ভোগ’ কী? ভোগ শব্দের অর্থ হল, ‘আনন্দ বা তৃপ্তি’। বাঙালির পাঁচদিনের পূজা উপাচারের সঙ্গে সমান তালে এই পূজাগুলিতে যে ভোগ বৈচিত্র্য লক্ষিত হয়, তার মূল ভিত হল সমকালীন সবজি ও ফসল। ঐতিহাসিক ব্যাখায় শরৎ ও বসন্ত দুই ঋতুতে দেবী শাকম্ভরী ও মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা ছিল বিধিবদ্ধ। ফলতঃ একে অনেকেই বাঙালির নবান্ন বা নতুন ফসলের উৎসব মনে করেন। এই কারণেই ভোগ দুর্গাপূজায় এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
বাঙালি নদীমাতৃক বাংলার সুজলাসুফলা শস্যশ্যামলা প্রকৃতির জন্যই হয়তো চিরকালের খাদ্যরসিক। খাদ্যরসিকতা তাকে রন্ধনদক্ষতাও দিয়েছে। রন্ধনশৈলীর বৈচিত্র্য দুর্গাপূজার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। দেবী দুর্গা শস্যদেবী, তাই ধারণা কাহিনী বিবর্তন সত্ত্বেও আজও তাঁর ভোগে থাকে সমকালীন শস্য, শাকসবজি। তারই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, দেবী দৃষ্টিভোগ দেন। অতএব, এই কারণেই ভোগের স্বাদবৈচিত্র্য সহ ভোগ নিশ্চয়ই হয় ‘দৃষ্টিনন্দন’।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালির দুর্গাপূজার বৈশিষ্ট্য হয়ে থেকেছে ভোগের বৈচিত্র্য। পুরাতন বনেদি বাড়ির ভোগ ইতিহাস বিচারে ভোগের বেশ কয়েকটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। নিরামিষ শস্যপ্রধান ভোগ, আমিষ ভোগ, শীতল, মিষ্টান্ন ও পান্তাপ্রসাদ।
ভোগ ধারণা যেমন মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ব্যাখা করা যায়, তেমনই ভোগের প্রকার ভেদেও এই সামাজিক ও মনস্ত্বাত্তিক ছবি পরিলক্ষিত হয়। সমাজের ও সংস্কৃতির বিবর্তনে দুর্গাপূজা আজ উমা মায়ের বাপের বাড়ি ফেরা। উমা যেন সব বাঙালির ঘরের মেয়ে। তার বৎসরান্তে একবার ফেরা পিতৃগহ তথা বাংলায় আনন্দের আবেশ এনে দেয়। দুর্গাপূজার ভোগেও পড়ে তার ছায়া। নানারকম নিরামিষ পদ, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নদী-পুকুরে পাওয়া যায় এমন মাছ সহ নানারকম আমিষ ভোগ, দেবীর গুরুপাক খাবার খাওয়ার পর শীতলের ব্যবস্থা যেমন, ক্ষীর ডাব পান বা আমলকি, তারই সঙ্গে দশমীর দিন পান্তা প্রসাদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই আমিষ ভোগ অনেকে উপজাতি প্রধান বঙ্গদেশের উপজাতি প্রভাবের ফল বলেও মনে করেন। উপজাতিদের মধ্যে যে দেবী চণ্ডীর উল্লেখ আছে তারই প্রভাবে অষ্টমী নবমী তিথির সন্ধিক্ষণের পূজায় কিছু পরিবারে পরিবারে দুর্গাপূজায় মাছপোড়া দেবার রীতি আছে। ফলত এই আমিষ ভোগের প্রচলনের সম্পূর্ণ ব্যাখা করা কঠিন। যাই হোক, বিবিধতা সত্ত্বেও বাঙালি ভোগে অভিনবত্ব রেখে নানান নতুন উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রমাণ রেখেছে। বাঙালির সব থেকে আকর্ষণীয় মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখা করা যায় দশমীর এই পান্তা প্রসাদে।
পান্তাভাত ইলিশমাছ ভাজা কচুর লতি আর বাসি তেঁতুল/আমসির চাটনি, কখনও বা মাছের মাথার অম্বল। দশমীর এই ভোগ বিশেষ অর্থ বহন করে। প্রথমত, সামাজিকভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বামী বা শ্বশুরালয় আদরণীয় বা সম্মানীয়। তাই বাপের বাড়ি থেকে ফিরে মেয়ে বাপের বাড়ির গুণগান করবে না আবার মিথ্যাও বলবে না। তাই ফেরার দিনে মাকে এই খাবার খাওয়ানো। যা খেয়ে মা ফিরে বলবেন এই তো পান্তা আর কচুর শাক খেয়ে এলাম। এতে হরবোলা স্বামীর মানও থাকবে আর মায়ের বিনম্রতাও বজায় থাকবে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়, যাত্রাপথে যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তাই মাকে (ঘরের মেয়েকে) হালকা খাবার খাইয়ে পাঠানো হয়, মেয়ে চলে যাবার দুঃখে বাবা-মা আর রান্না করেন না, অরন্ধন পালন করেন, টিমটিম করে জ্বলতে থাকে একটি প্রদীপ, আশার সূক্ষ্ম কিরণ হয়ে - আসছে বছর আবার হবে, অর্থাৎ সব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে মাতৃরূপী কখনও বা কন্যারূপী রাজসিক দেবী আবার তাঁর বৈভব নিয়ে বঙ্গমৃত্তিকায় আনন্দ ফসলে ভরে দেবেন, এই আশায় বাঙালি পথ চেয়ে থাকে।