যাদুপোটিয়াদের ডোকরা– বাপ-ঠাকুরদার দেখিয়ে দেওয়া পথেই স্বপ্ন গড়ে যাচ্ছেন এঁরা

ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলা। হাজার হাজার বাঙালির বাস। দুমকা অন্তর্গত শিকারীপাড়ার কাছে একটা ছোট্ট গ্রাম। বাস করেন কয়েক ঘর ডোকরা শিল্পী। স্থানীয় মানুষজন তাঁদের নাম দিয়েছেন ‘যাদুপোটিয়া’। সাধারণত ডোকরার অলংকার বানান। যদিও পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি ডোকরা শিল্পের নিদর্শন মেলে। বাঁকুড়ার বিকনায় এবং পূর্ব বর্ধমানের গুসকরা এই ডোকরা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। ডোকরার কাজ সাধারণত পিতলের হয়, যা বহু প্রাচীন ‘lost-wax casting technique’।
আজ ‘বঙ্গদর্শন’ দুমকার শিকারীপাড়ায়। ডোকরা শিল্পীরা কোথায়— স্থানীয় মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে বুঝতে পারেন না। পরে ভালো করে বুঝিয়ে বললে উত্তর আসে, ‘ওরা তো যাদুপোটিয়া’। রাস্তা দেখিয়ে দেন। শিকারীপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে সরু রাস্তা চলে গিয়েছে গ্রামের দিকে। রাস্তার দুদিকে রুক্ষ ভূমি ও দূরে ধূসর পাহাড় দেখা যায়। সেই রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা গেলেই পড়বে আদিবাসী গ্রাম। মূল রাস্তা থেকে ছোটো সরু পথ। জঙ্গল পার হয়ে পুকুর। পাশেই যাদুপোটিয়াদের পাড়া। ঢোকবার আগে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখে বুঝে নিতে হবে। কয়লার ভাঁটিতে ডোকরার জিনিস কাস্টিং হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের এই প্রত্যন্ত পাড়াটিতে দেখা গেল মাত্র ৭ থেকে ৮টি মাটির কুঁড়েঘর। এটিই আসলে যাদুপোটিয়াদের পাড়া।
পাড়ার মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করলে এবং ওঁদের কাজ দেখতে এসেছি বললে ভীষণ খুশি হন। আবেদিন নামের একজন প্রবীণ ডোকরা শিল্পী তাঁর বাড়ি নিয়ে গিয়ে দড়ির খাটিয়াতে বসাবেন। উঠোনে কয়লার ভাঁটিতে ডোকরার জিনিস কাস্টিং হচ্ছে। ভাঁটি বেশ খানিকটা উঁচু। কিছুটা গোল উনুনের মতো দেখতে। মাটির কুঁজোর মতো দেখতে, বিভিন্ন আকৃতির মাটির জিনিস সাজানো রয়েছে। তার উপরের অংশের মাটি লাল হয়ে পুড়ে গিয়েছে। এই মাটির আবরণ ভাঙলেই ভিতর থেকে ডোকরার সুন্দর অলংকার বেরিয়ে আসবে। তাঁদের তৈরি ডোকরার কাজ খুবই সূক্ষ। আবেদিনরা চার ভাই। বাকি সবাই এখন অন্য জীবিকায় চলে গিয়েছেন।
আবেদিনের ভাই শুকচাঁদ বুঝিয়ে দেন, ডোকরা তৈরির সমস্ত পদ্ধতি। প্রথমে এঁটেল মাটির সঙ্গে ধানের তুষ মেশানো হয়। সেই দিয়ে যে অলংকারটি করা হবে, তার একটি বেসিক মডেল তৈরি করা হয়। তারপর গোবরের সঙ্গে মাটি মিশিয়ে ভালো করে ছেঁকে সেই মাটির প্রলেপ আগের মাটির মডেলটির ওপর দিয়ে, গাছের পাতা ঘষে সেটিকে আরও মসৃণ করা হয়। শুকিয়ে গেলে তার ওপর ধুনো, মোম, সর্ষের তেল একসঙ্গে গরম করে সরু সুতো তৈরি করা হয়। সুতো তৈরি করার জন্য তাঁদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন। টিনের পাতের মধ্যে ছোটো বড়ো বিভিন্ন আকারের ফুটো থাকে। সেই দিয়ে প্রয়োজন মতো সুরু মোটা বিভিন্ন আকারের মোমের সুতো বের করা হয়। এরপর সুতো দিয়ে মাটির তৈরি মডেলের গায়ে সূক্ষ কারুকার্য করা হয়। লাল মাটির সঙ্গে কাঠ কয়লার গুঁড়ো মিশিয়ে সেটিকে ভালো করে ঢাকা হয়। পিতল গলে গিয়ে মোমের চাঁচকে গলিয়ে চাঁচের সেই আকার ধারণ করে। এরপর পিতল জমে গেলে মাটির খোলস ছাড়িয়ে ভিতর থেকে পিতলের অলংকার বেরিয়ে আসে। সেগুলিকে ভালো করে মাটি ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে বাড়তি অংশ কেটে ফেলা হয়। ডোকরার শিল্প তাই কালচে রঙের হয়। কিন্তু বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী পালিশও করা হয়ে থাকে।
তাঁদের তৈরি ডোকরার জিনিস বোলপুর-কলকাতা থেকে পাইকারিরা কিনে নিয়ে যান। হাঁসুলি, কানের দুল, লকেট, মাকড়ি, গরুর গলায় পরানো ঘণ্টা, মুরগির পায়ের ঝুনঝুনি — কী না নেই এখানে!
আবেদিনবাবু বঙ্গদর্শনকে জানান, “গ্রামের মানুষ মাটির খোলের ভিতর থেকে কীভাবে এতো সুন্দর ধাতুর জিনিস বেরিয়ে আসে, এই দেখে ভাবেন আমরা মনে হয় যাদু পারি। ওঁরা তো আর প্রথম থেকে দেখতেন না, কীভাবে হয় এসব। তাই যাদু জানি ভেবে, আমাদের বলতেন যাদুপোটিয়া। সেই থেকে নামের পদবীও যাদুপোটিয়া হয়ে গিয়েছে।”
বর্তমানে এইসব অঞ্চলে কাঁচা মালের জোগান কম থাকায় এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ডোকরার চাহিদা থাকলেও টাকার অভাবে তাঁরা পর্যাপ্ত জিনিস প্রস্তুত করতে পারেন না। স্বাভাবিক কারণেই এই পেশা ছেড়ে নতুন প্রজন্ম চলে যাচ্ছে অন্য পেশার দিকে। আর আবেদিনের মতো কিছু প্রবীণ ডোকরা শিল্পী এখনও তাঁদের বাপ-ঠাকুরদার দেখিয়ে দেওয়া শিল্প বহন করে চলেছেন আজও।
____
ছবিঃ প্রতিবেদক