এই শতাব্দির শ্রেষ্ট বাঙালি নিউরো-সার্জেন ডঃ রবিন সেনগুপ্ত

১৯৮৫-সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী-র এক কঠিন মস্তিষ্কের রোগ ধরা পরে এবং ব্রেন অপারেশনের প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ভারতের সেই সময়ের প্রখ্যাত নিউরো-সার্জেন ডঃ রামামূর্তি পরামর্শ দেন যে এই অপারেশন পৃথিবীতে একমাত্র একজন সফল ভাবে করতে পারবেন তিনি ইউ.কে বাসী বাঙালি, ডঃ র.পি. সেনগুপ্ত। অপারেশন হয় এবং ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী-র অনুরোধে পোস্ট অপারেটিভ সেবায় তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
বাংলা ও বাঙালির গর্ব ডঃ রবিন সেনগুপ্ত কে পৃথিবীর প্রথম সারির নিউরো-সার্জেন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এটা প্রতিটি বাঙালির গর্বের কারন।

১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে ইন্টার্ন পরীক্ষা পাশ করে কয়েক হাজার উদ্বাস্তুর মধ্যে তিনিও কলকাতায় আসেন ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন নিয়ে। ছোট বেলায় পারিবারিক দুস্থতার জন্য স্কুলের মাইনে দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠতো না তাই এক সময় রাস্তায় কলা বিক্রি করে স্কু্লের পড়াশুনোর বন্দোবস্ত করতে হতো তাঁকে। ১৯৬১ সালে ডাক্তারি পাশ করে জাহাজে করে পারি দিলেন ইংল্যান্ডে । টানা দশ বছরে ডাক্তারির ধাপ একে একে পেরলেন এবং অবশেষে ১৯৭১ সাল থেকে ডাক্তার হিসেবে তাঁর প্রভূত নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মনটা পড়ে ছিল এই দেশই, তাই ১৯৭১ এর পয়লা ডিসেম্বর এ মুম্বাই তে ফিরে এলেন চাকরির খোঁজে। তেশরা ডিসেম্বর ইন্দ্রিরা গান্ধী বাংলাদেশ যুদ্ধ ঘোষণা করায় চাকরির আসা ছেড়ে তিনি আবার বিলেত পারি দিলেন। ইতিমধ্যে ডঃ সেনগুপ্ত-র যশ সারা ইউ.কে, আমেরিকা এবং অবশ্যই ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল সার্জারির জন্য বিলেত থেকে তাঁকে নিয়ে আসা শুরু করে। ভিন্নরাজ্যে বাংলা থেকে চিকিৎসার জন্য আসা মানুষদের দেখে তাঁর মনে একটা বহু পুরনো ইচ্ছা জেগে ওঠে।

শুরু হয় বাংলাতে একটা বিশ্বমানের নিউরোসাইন্স সেন্টার তৈরি করার স্বপ্ন দেখা। বিলেতের নিউ ক্যাসেল জেনারেল হসপিটলের সাথে সুদীর্ঘ সম্পর্কের পাশাপাশি কলকাতায় বেশ কিছু বেসরকারি সংগঠনের সাথে কাজ করা এবং সাহায্য করা শুরু করেন। কিন্তু বিদেশের চিকিৎসার মান এবং তত্ত্বাবধানে অভ্যস্ত থেকে আমাদের কাজের পদ্ধতির সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। সেই সময় তৎকালিন সরকার পৃথিবী বিখ্যাত এই শৈল চিকিৎসকে এই রাজ্যে রাখার জন্য তাঁর নিজের একটা ইনস্টিটিউট করার প্রস্তাব দেন।
বাংলায় বিশ্ব মানের নিউরোসাইন্স ইনস্টিটিউট করার আন্তরিক পরিকল্পনা এবং বাংলাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য ম্যাপে তুলে আনার প্রচেষ্টার দিকে যখন তিনি এগো ছিলেন, ঠিক তখনই তাঁর জীবনে নেমে আসে এক পারিবারিক বিপর্যয়। ইউ.কে তে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাঁর একমাত্র ছেলে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মারা যায়। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন এবং সব কাজ কর্ম ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু বাংলায় স্বাস্থ্য পরিসেবায় নিজেকে নিয়োগ করার টান এবং স্ত্রী-র উৎসাহে কিছুদিন পর থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ডাক্তার বন্ধুদের কাছে হাত পাতলেন কলকাতায় একটা নিউরোসাইন্স ইনস্টিটিউট করার জন্য যা কিনা বিশ্বসেরা হার্ভাড, নিউ ক্যাসেল নিউরোসাইন্স সেন্টারের এর সাথে সমগোত্রীয় হবে। কলকাতার মিউনিসিপাল কর্পোরেশন সাহায্যের হাত বাড়ালো। ২০০৫ এ তৎকালীন মেয়রের দূরদর্শিতায় ও উদ্যোগে সরকারি ভাবে জমি হস্তান্তর হলো। সরকারকে সাথে নিয়ে স্নায়ু রোগ চিকিৎসায় বিশ্ব মানচিত্রে বাংলা কে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেন বিশ্বের প্রথম সারির স্নায়ু শল্য চিকিৎসক। আর সেই যাত্রায় পায়ে পা দিয়ে এগিয়ে এলো ইউ.কে র নিউ ক্যাসেল জেনারাল হস্পিটল।
বর্তমান সরকার বাংলার মানুষের কাছে বিশ্বমানের স্বাস্থ্য পরিসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অঙ্গিকার বদ্ধ। সেই অঙ্গিকাকে মনে প্রাণে সাই দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা আপামর বাঙালির কাছে সাহায্যের হাত বাড়ালেন ডঃ রবীন সেনগুপ্ত।
কোম্পানি অ্যাক্ট এর sec-২৫ এ ইনস্টিটিউট রেজিস্টার্ড হবার ফলে এই কোম্পানির কোন মালিকানা রইলো না কারও। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে, প্রতি মাসে ২০দিন কলকাতা আর বাকি দিন ইউ.কে তে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে ধাপে ধাপে গড়ে তুলছেন বাংলার গর্বের ১৫০ শয্যার এই আধুনিক ইনস্টিটিউট।

ডঃ রবিন সেনগুপ্তকে ২০০০ সালে এই শতকের শ্রেষ্ঠ নিউরো সার্জেন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কেন্দ্রিয় সরকারের DSIR, এই ইনস্টিটিউট কে দেশের অন্যতম নিউরো ইনস্টিটিউট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইনস্টিটিউট অফ্ নিউরো সাইন্স কে CNBC ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নিউরো সাইন্স ইনস্টিটিউট হিসেবে দাবি করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘বেষ্ট সুপার স্পেশালিষ্ট হস্পিটল’ আখ্যা দেয়।
দেশের আর পৃথিবীর মানুষের কাছে বাংলার একটা নেতিবাচক ছবি তুলে ধরার তীব্র প্রচেষ্টা যখন চারিদিকে চলছে তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য মানচিত্রে বাংলার এই উজ্জ্বল মুখ আমাদের স্বস্তি দেয়, উৎসাহ যোগায়, গর্বিত করে। চরম দারিদ্রের মধ্যে থেকে উঠে এসে বিশ্বের স্বনামধন্য স্নায়ু শল্য চিকিৎসক হওয়া এবং বাংলার মানুষের পাশে দাড়ানোর উদাহরণ বাংলার বিশেষত আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে প্রেরণা। বাংলার মানুষের আর্শীবাদ আর প্রশাসনের সার্থক সহযোগিতায় তিনি ভারতবর্ষের সব থেকে বড় নিউরো সাইন্স ইনস্টিটিউট এর ক্যাম্পাস করার স্বপ্নে দিকে এগোচ্ছেন।
সরকার তাঁর উচ্চতম নেতৃত্বের নতুন বাংলা গড়ার স্বপ্নকে সফল করার জন্য যেমন দেশ- বিদেশের মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছে এবং তাদের এই রাজ্যে অর্থ এবং জ্ঞান লগ্নি করার জন্য নানারকম অনুদান যেমন দিয়ে থাকেন, তেমনি আশা করবো বাংলার গর্ব এই মানুষটিকে বাংলার স্বাস্থ্য পরিসেবায় এক অগ্রগণ্য ভূমিকা নেওয়ার জন্য সুযোগ করে দেবে। রাজ্যের জেলা স্তরে বিশ্ব মানের স্বাস্থ্য পরিসেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগের পাশে দাঁড়াবে।
এতে বাংলার লাভ, বাংলার মানুষের লাভ, রাজ্যের অগ্রগতি।