ইংল্যান্ডে কংগ্রেসের পতাকা উড়িয়ে কারাবাস করেছিলেন এই বাঙালি অর্থনীতিবিদ

“দেবু আছো নাকি? দেবু, ও দেবু?”
বাজখাঁই গলায় হাঁক পাড়তে পাড়তে সদর দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন দশাসই চেহারার একজন। দেবু তখন বদনা হাতে বাড়ির পেছনে নিরিবিলি বাঁশবাগানে প্রাতঃকৃত্য সেরে ফিরছেন।
“আরে সান্যালদা, এত সকালে! তা কবে ফিরলেন কলকাতা থেকে? আসুন, আসুন।”
দেবুর মা প্রায় হাত খানেক ঘোমটা টেনে দক্ষিণমুখো রোয়াকে একটি কাঠের চেয়ার বের করে তার উপর একটা কাপড়ের আসন পেতে দিয়ে দ্রুত পায়ে গোবর দিয়ে টলটলে নিকানো মাটির উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
ধোড়াদহে ডঃ সান্যালের বাড়ির ভগ্নদশা
“কাল রাতে এসেছি। তোমারা সব ভালো তো। ( দেবু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে) এবার আমি একমাস গ্রামে থাকব। শুনলাম তুমি নাকি নতুন সাইকেল কিনেছ। শোনো আমি মাঝে মাঝে তোমার সাইকেল নিয়ে এদিক ওদিক যাব।”
পুবমুখো ঘরের খোলা দরজা গলিয়ে চোখ পড়তেই ঘরের মেঝেতে স্ট্যান্ড দিয়ে দাঁড় করানো চকচকে সাইকেল নজরে পড়ে। ষাটের দশকের প্রথম দিকের কথা। এলাকায় কারোর বাড়িতে সাইকেল থাকা মানে আশেপাশের দু’চার গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ঘুরতো সেই সাইকেল ও সাইকেল মালিকের কথা। দেবু দশ মাইল দূরে বালিয়াডাঙ্গা জুনিয়র হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সেই সময় প্রধান শিক্ষক হওয়ার জন্য দশ বছরের শিক্ষকতা করার যোগ্যতা লাগতো না। দেবু বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে স্নাতক হয়েই প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেছিলেন। পুরো নাম দেব প্রসাদ সাহা। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা আদর করে তাঁকে দেবু বলেই ডাকেন। সাইকেল কেনার আগে দেবু প্রায় দু’বছর শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা গ্রামের মেঠো রাস্তার মাড়িয়ে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করেছেন। খুবই সামান্য বেতনের চাকরি। তাও প্রতিমাসে নিয়মিত বেতন হয় না। অনেক কষ্টে দেবু সাইকেলটি কিনেছেন। সাইকেলের কথা কানে যেতেই দেবুর বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। আমতা আমতা করে বলেন, “হ্যাঁ দাদা, দরকার পড়লে নেবেন বৈকি।”
“আজ তো তোমার স্কুল নেই। রোববার। তাহলে সাইকেলটা একটু নিয়ে যাচ্ছি।”
সান্যালদা নিজেই হনহন করে ঘরে ঢুকে সাইকেল বের করে নিয়ে আসলেন।
“আজ বিকেলে একটা পার্টির মিটিং আছে সেনপাড়ায়। ভালোই হলো তোমার সাইকেলটা পেয়ে।”
বেশ কিছুক্ষণ খোশগল্প করে চা খেয়ে সাইকেল চালিয়ে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে সান্যালদা চলে গেলেন। দেবু কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে গেলেন।
ডঃ সান্যালের ব্যবহৃত আরাম কেদারা
সেদিন বিকেলে আকাশ ঝেঁপে প্রবল বৃষ্টি। গ্রামের কাঁচা রাস্তা জলকাদায় মাখামাখি। দেবুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। দেবু সাইকেলকে নিজের সন্তানের মতো মনে করেন। মনে মনে ভাবছেন, “ইস! এই জলকাদায় আমার সাইকেলের দফারফা হয়ে গেল।” অস্থির চিত্তে রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুমই আসতে চায় না। ভোর হতে না হতেই দেবু চললেন ব্রাহ্মণ পাড়ায়। স্যানালদার দরজার কড়া নাড়তেই স্যানালদা ঘর্মাক্ত পেশিবহুল শরীরে খালি গায়ে বেরিয়ে আসলেন। ডান হাতে ডাম্বেল। শরীরচর্চা করছিলেন। সহাস্যে বললেন, “আমি জানতাম তুমি আসবে। সাইকেল নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলে, বুঝতে পেরেছি। কাল বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টি জাপটে ধরলো। কী আর করি জলকাদায় একবার নিজেকে সামলাই, আর একবার তোমার সাইকেলকে। ওই যে তোমার সাইকেল।”
দেবু দেখেন উঠোনের একপাশে তার সাইকেল পরিষ্কার করে ধুয়েমুছে ঝাঁ চকচকে করে রেখেছেন সান্যালদা। লজ্জায় দেবুর মাথা হেঁট হয়ে গেল।
এই সান্যালদাই হচ্ছেন ডঃ নলিনাক্ষ সান্যাল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তিনি এক হারিয়ে যাওয়া নাম। আজ তাঁর জীবনকথা।
ডঃ সান্যালের ব্যবহৃত চেয়ার
নদিয়া জেলার ‘জলঙ্গী’ তীরস্থ ধোড়াদহ বহু প্রাচীন একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। জলঙ্গী নদীর স্থানীয় নাম খড়ে। পূর্বে জলঙ্গী যখন বৃহৎ নদী ছিল, তখন কলকাতা থেকে ফৌজ নিয়ে গঙ্গা-জলঙ্গী দিয়ে বড়ো বড়ো স্টিমার ও নৌকা এই পথে পদ্মা হয়ে বহু স্থানে যেত। বর্তমানে গ্রামের অবস্থা হীন হয়ে এসেছে। এই গ্রামেই ১৮৯৮ সালের ২২ নভেম্বর জমিদার বংশে জন্মেছিলেন নদিয়া তথা বাংলার কৃতী সন্তান, দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সফল ব্যবসায়ী, স্পোর্টসম্যান ড. নলিনাক্ষ সান্যাল। তাঁর পিতা রজনীকান্ত সান্যাল ইংরেজ আমলে বহরমপুর কোর্টের খ্যাতিমান আইনজীবী। রজনীকান্তের তিন পুত্র – অনাদিকান্ত, নলিনাক্ষ ও শক্তিপদ। ছোটো পুত্র শক্তিপদ ছিলেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। বড়ো দাদা অনাদিকান্ত বিপ্লবী বারীন ঘোষের অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। অনাদিকান্তকে স্বদেশী ডাকাতি মামলার দায়ে ইংরেজ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। রংপুর জেলে ইংরেজ পুলিশের শত অত্যাচারেও তাঁর মুখ দিয়ে কোন কিছু স্বীকার করানো যায়নি। বেশ কিছুদিন অন্তরীণ করে রাখা হলে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। অবশেষে ১৯১০ সালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে কলকাতায় তিনি মারা যান। তাঁর পুত্রসন্তান জন্মের পাঁচ বছর পর অসুস্থতার কারণে মারা যায়। অবশ্য তাঁর স্ত্রী স্বাধীন ভারতের প্রথম সূর্য দেখতে পেয়েছিলেন।
পেশাসূত্রে রজনীকান্ত সান্যাল পড়শি জেলার সদর টাউন বহরমপুরে বাড়ি করেন। সেই বাড়ি সান্যাল বাড়ি নামে সুপরিচিত। নলিনাক্ষ বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের পাঠ শেষ করে স্কলারশিপ পেয়ে বিলেত যান। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের ছাত্র ছিলেন। খ্যাতনামা পণ্ডিত হ্যারল্ড ল্যাস্কির অধীনে গবেষণা করে ১৯২৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ভারতীয় হিসাবে অন্যতম প্রথম ব্যক্তি, যিনি অর্থনীতি বিষয়ে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ( ড. বি আর আম্বেদকর সম্ভবত প্রথম ভারতীয়, যিনি অর্থনীতিতে ১৯২৩ সালে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত হন।) লন্ডনে থাকাকালীন জাতীয়তাবাদী ও দেশাত্মবোধক রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। সেদেশে একটি সরকারি ভবনে কংগ্রেসের পতাকা উড়িয়ে কারাদণ্ড ভোগ করেন। সাইমন কমিশনের বয়কটের জন্যও তাঁর কারাবাস হয়। লন্ডনে কারাবাসকালীন তিনি তাঁর থিসিস পেপারের বেশ কিছু অংশ লেখেন।
দেশে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের কার্যকলাপের সাথে প্রত্যক্ষ যুক্ত থাকার কারণে ব্রিটিশ সরকারের কুনজরে পড়েন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত হন। তারপর তিনি ‘নিউ ইন্ডিয়া ইন্সুইরেন্স কোম্পানি’, ‘দি মেট্রোপলিটিশিয়ান আ্যসুরেন্স কোম্পানি’ এবং হিন্দুস্তান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড কোম্পানিতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেন।
করিমপুর পান্নাদেবী কলেজে ডঃ নলিনাক্ষ সান্যালের আবক্ষ মূর্তি
বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জির স্নেহধন্য ছাত্র নলিনাক্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের হাতেখড়ি বিপ্লবী বাঘা যতীনের ‘যুগান্তর দলে’। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশের হাত ধরে তিনি জাতীয় কংগ্রেসে পা রাখেন। পরবর্তীতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির প্রথম সারির নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। কলকাতায় ১৯৩৩ সালে নিষিদ্ধ কংগ্রেস অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিত্ব করার অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৬ সালে প্রথমবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বিধায়ক হয়েছিলেন। সুবক্তা ছিলেন। ১৯৩৭-৪৭ টানা দশ বছর বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় তিনি ব্রিটিশরাজের তীব্র সমালোচনা করেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি ভয়াবহ মন্বন্তরের জন্য ব্রিটিশ সরকারকেই দায়ী করেন। ( সূত্রঃ রাকেশ ব্যাটবলের বই, ‘কমিউনালিজম ইন বেঙ্গল’)। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার সময় তিনি তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে এই দাঙ্গা রোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ইতিহাসের পাতায় দাঙ্গা রোধকারীদের জন্য খুবই কম শব্দ খরচ করা হয়। দেশভাগের আগে অবিভক্ত বাংলায় তিনি সংসদে দলের মুখ্যসচিব ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকা পালন করার জন্য তাঁকে মোট সাতবার কারাবরণ করতে হয়।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সঙ্গে তাঁর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য কারাদণ্ডের সূত্রে ১৯২৩-এর মে মাসে কোনও এক সময় নজরুল বহরমপুর জেলে ছিলেন। ঐ বছর ১৫ই ডিসেম্বর বহরমপুর জেল থেকে নজরুল ছাড়া পেলে সর্বপ্রথম সংবর্ধনা দিয়েছিলেন তাঁর সুহৃদ নলিনাক্ষ সান্যাল। নলিনাক্ষ জেল গেট থেকে নজরুলকে শোভাযাত্রা সহকারে নিয়ে যান এবং সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের বাসায় তোলেন।
করিমপুর পান্নাদেবী কলেজ
দীর্ঘ ৩৫ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। আধুনিকমনস্ক, সংস্কারমুক্ত চিন্তার মানুষ ছিলেন তিনি। সংকীর্ণ জাতপাতের ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করতেই হয়। ১৯২৪ সালে বিবাহ করেন বহরমপুরের কাদাইয়ের ভট্টাচার্য পরিবারের কন্যাকে। নিজের বিবাহ অনুষ্ঠানে কোনো রকম ধর্মীয় সংস্কার ও গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শালগ্রামশিলা, পঙক্তি ভোজনের প্রথাকে বাতিল করে বিবাহ করেন। নিমন্ত্রণ করেন বন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে। যা তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বিবাহ বাসরে। বহরমপুরের অভিজাত ‘সান্যাল বাড়ির’ নলিনাক্ষ সান্যালের বন্ধু ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে নজরুল বহরমপুরে আসেন এবং বরযাত্রীও গিয়েছিলেন। সেখানে অন্য বরযাত্রীদের থেকে দূরত্ব রেখে নজরুল ইসলামকে খেতে দেওয়া হয়। নলিনাক্ষ সান্যালের খুড়তুতো ভাই বিখ্যাত আইনজীবী শশাঙ্ক সান্যালের (মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর থেকে লোকসভায় সিপিএমের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন) ডান দিকে বসেছিলেন নজরুল। নলিনাক্ষ সান্যালের ভাই শশাঙ্কশেখর সান্যাল ওই দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে দাদাকে বিয়ের মঞ্চে গিয়ে বলে যে, ‘দাদা ওরা কাজিকে অপমান করেছে। এই বিয়ে হবে না, তুই চলে আয়।’ তখন নজরুল সকলকে বুঝিয়ে শান্ত করেন। সেই রাতেই নজরুল ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব/ জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া’, বিখ্যাত কবিতাটি রচনা করেন। এর পরে বিয়ে শেষে ভোরের দিকে উঠোনে চেয়ারে বসে বাড়ির কর্তা শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এসেছেন। সেই সময়ে তিনি শুনতে পান সুমধুর কন্ঠে কেউ এক জন শ্যামাসঙ্গীত গাইছে। খড়ম পায়ে উঠে গিয়ে তিনি দেখেন, বাড়ির কালীমন্দিরে বসে চোখ বন্ধ করে নজরুল গাইছেন আর তাঁর চোখ দিয়ে জল ঝরছে।
তখনকার দিনের সংকীর্ণ জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার সামাজিক অত্যাচার নলিনাক্ষকে ব্যথিত করত। কবিবন্ধু যতীন্দ্র মোহন বাগচীর ডাকে সাড়া দিয়ে নলিনাক্ষ সান্যাল কবির গ্রাম নদিয়ার যমশেরপুরে ‘জলতল’ আন্দোলনে যোগ দেন এবং সেই আন্দোলনকে সর্বপ্রকারে সফল করার যাবতীয় চেষ্টা করেছিলেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিন্দা ও বারণ উপেক্ষা করে সেই সভায় কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী ও নলিনাক্ষ সান্যাল প্রথম নমঃশূদ্র পরিবারের থেকে জলপান করে সেই যুগে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার কুসংস্কার ভাঙার সূচনা করেন এবং সফলও হন।
ধোড়াদহ রজনীকান্ত উচ্চ বিদ্যালয়
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে করিমপুর সহ নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বৃহৎ অংশ আদৌ ভারত ভূখণ্ডের মধ্যে থাকবে নাকি পাকিস্তান সীমানার মধ্যে চলে যাবে এই চিন্তায় বিনিদ্র রজনী যাপন করছে এই দুই জেলার মানুষ। সদ্য দেশ বিভাগের পর শান্তিপ্রিয় এলাকা বলে পরিচিত নদিয়ার শিকারপুর-করিমপুর অঞ্চলে প্রথম সাম্প্রদায়িক গোলযোগ দেখা যায়। বলা বাহুল্য এর মূলে ছিল সমাজের উঁচু তলার উভয় পক্ষের মৌলবাদীরা। এমনকি শিকারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫ ও ১৬ আগস্ট পরপর দু’দিন পাকিস্তানের পতাকাও শোভা পায়। ছোটোখাটো সংঘর্ষ হয়। উত্তেজনা তখন তুঙ্গে, কী হয় কী হয় অবস্থা। সংঘর্ষের মহড়ায় বিবাদমান এক পক্ষের শ্লোগান ছিল – ‘হাতমে বিড়ি মুখমে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। অন্যপক্ষ – ‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী/ দানবের তরে নয়’। সেই সময় ডঃ সান্যালের ভূমিকা ছিল সদর্থক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য এলাকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে তিনি সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অন্যান্যদের সহযোগিতায় ধোড়াদহ,করিমপুর, শিকারপুর অঞ্চল নদিয়ার জেলার অন্তর্ভুক্ত করে ভারতীয় ভূখণ্ডে রাখতে পেরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের স্বাধীনতা দিবস ১৯৪৭ সালে ১৭ ই আগস্ট।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে অজয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আলাদা বাংলা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন এবং করিমপুর বিধানসভা থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মতবিরোধে আবার দল পরিত্যাগ করে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এর পি ডি এফ মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। নলিনাক্ষ সান্যালের পর পরবর্তীতে করিমপুর বিধানসভা থেকে নির্বাচিত কোন বিধায়ক মন্ত্রীসভায় স্থান পাননি।
নিজের গ্রাম ধোড়াদহের সাধারণ ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে শিক্ষাব্রতী নলিনাক্ষ নিজ উদ্যোগে এলাকার বিদ্যোৎসাহী মানুষের সহায়তায় তাঁর পিতা রজনীকান্ত সান্যালের নামে ১৯৬১ সালে ১ ফেব্রুয়ারি ‘ধোড়াদহ রজনীকান্ত উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। করিমপুর ও তার পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হতো উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য প্রায় আশি কিমি দূরে কৃষ্ণনগরে অথবা বহরমপুরে যেতে। এলাকার সাধারণ মানুষের স্বার্থে যাতে তারা সহজেই উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় অংশ গ্রহণ করতে পারে, সেইজন্য নলিনাক্ষ সান্যাল অন্যান্য শিক্ষানুরাগীদের সাথে নিয়ে ১৯৬৮ সালে করিমপুর পান্নাদেবী কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য করিমপুর অধিবাসী খ্যাতনামা ব্যবসায়ী স্বর্গীয় দুর্গাপ্রসাদ আগরওয়াল এই কলেজ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর স্ত্রী পান্নাদেবীর নামানুসারে এই কলেজের নামকরণ করা হয় করিমপুর পান্নাদেবী কলেজ।
নলিনাক্ষ সান্যাল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘ব্যবসায় বাণিজ্য’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সংকলিত পুস্তকে আর্থিক বিষয়ে তিনি বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন। বিষয়গুলো হল –‘বাঙ্গালার আর্থিক প্রগতির নিয়ন্ত্রণ’, ‘বাঙ্গালার সহিত ভিন্ন প্রদেশের আর্থিক স্বার্থ সংঘাত’, ‘বাণিজ্য স্বার্থ সংরক্ষণে গোল টেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্ত’, ‘কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গঠনের প্রস্তাব’, ‘পাট রপ্তানি শুল্ক ব্যবসায়ে সালতামামী’, ‘ভারতে জীবন বীমা’ প্রভৃতি। এছাড়াও ১৯৩০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘Development of Indian Railways’ নামক ৩৯৭ পৃষ্ঠার একটি উল্লেখযোগ্য তথ্যপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নলিনাক্ষ সান্যাল ভারতীয় রেলবোর্ডের এক উচ্চপদে আসীন ছিলেন বেশ কিছুদিন।
ধোড়াদহ রজনীকান্ত উচ্চ বিদ্যালয়
নলিনাক্ষ সান্যালের স্ত্রী মামনী সান্যাল ছিলেন নিজগুণে অকৃত্রিম। খুবই বিনয়ী ও ভদ্র ছিলেন। বালিগঞ্জ হিন্দুস্তান রোডে তিনি গোপনে বিপ্লবী বীণা দাশের সঙ্গে পিস্তল চালানো অভ্যাস করতেন। যখন বীণা দাশ তখনকার গভর্নরকে হত্যা করার চেষ্টা করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তখন মামনী সান্যালও বিপাকে পড়েন। যদিও প্রমাণাভাবে তিনি সে যাত্রা রক্ষা পান। সান্যাল দম্পতি উভয়ই আশি উত্তীর্ণ জীবনযাপন করেছেন। ড.সান্যাল বৃদ্ধ বয়সেও নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন এবং জলে ডাইভিং-এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ খেলাতেও অংশ গ্রহণ করতেন শেষ বয়সেও। ব্রতচারীর প্রবক্তা বন্ধু গুরুসদয় দত্তের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তিনি নকশাল যুবকদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন।
২৯ অক্টোবর, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ৩৫, হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে বর্ণময় এই মহান মানুষের জীবনদীপ নিভে যায়। নতুন প্রজন্মের কাছে ডঃ নলিনাক্ষ সান্যাল একটি অশ্রুত নাম। আক্ষেপের কথা, নদিয়ার ধোড়াদহের মতো অতি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দেশের রাজনৈতিক ও শিক্ষাজগতে তাঁর কীর্তি বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিস্মৃতপ্রায়।
তথ্যসূত্রঃ
১। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।
২। শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘শতবর্ষ স্মারক সাহিত্য’ - সম্পাদক প্রণব আচার্য
স্কুল, কলেজের ছবি - মিমি সরকার, জয়ন্ত দাস বৈরাগ্য
অন্যান্য ছবি - দীপক সাহা
ঋণস্বীকারঃ
১। দেব প্রসাদ সান্যাল, ২। সঞ্জীব সান্যাল, ৩। জয়ন্ত দাস বৈরাগ্য