No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলার পুতুল সাম্রাজ্য

    বাংলার পুতুল সাম্রাজ্য

    Story image

    তিহাসে পুতুল গড়ার নমুনা পাওয়া যায় নব্য প্রস্তর যুগে, যখন ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটছিল। উর্বরতাকেন্দ্রিক সেই সমাজে বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুতুল হয়ে ওঠে শিশু মনোরঞ্জনকারী খেলনার অংশ। তবুও বাংলায় বেঁচে আছে সেই ঐতিহ্য। বাংলায় যত রকমের পুতুল মেলে, তা আর কোথাও মেলে না। সে সব হরেক নামের হরেক চেহারার পুতুল হাতে নিয়ে ছোটোদের মন উদাস হয় আর বড়োরা গৃহের কোণে সাজিয়ে রাখেন। পুতুল গড়ার উপাদান বদলালেও প্রতি দশকে বারবার উদযাপিত হয়েছে বাংলার পুতুল (Dolls of Bengal), উদযাপিত হয়েছেন বাঙালি শিল্পীরা।

    পুতুল কেবলমাত্র শিশুদের খেলনার জিনিস নয়, বরং এক উচ্চমানের শিল্পসৃষ্টি – বাংলা এমন বার্তা বরাবরই পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। বাংলার মানুষের কাছে পুতুল সর্বদাই হয়ে থেকেছে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক মূর্ত প্রতীক। বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলাতেই পুতুল তৈরির নিজস্ব ধারা আছে, যা পূর্ববর্তী প্রজন্ম দায়িত্ব নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে গেছে। বাংলার পুতুল সংখ্যায় এতই বহুল এবং এদের ইতিহাস এতই দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ যে, বহুক্ষেত্রেই সেগুলির সঠিক উৎপত্তিগাথা জানতে পারা যায় না। এই পুতুলগুলির বেশিরভাগই হারিয়ে গিয়েছে কালের নিয়মে অথবা প্রযুক্তি উন্নততর হওয়ার ফলে। তবে বিশেষ কয়েকটি ধাঁচ ও ধারার পুতুল আজও রয়ে গিয়েছে, যারা অস্তিত্বসঙ্কটের ঝড়ঝঞ্জায় হারিয়ে যেতে নারাজ, বাংলার কারিগরেরা প্রাণপাত করেও আগলে রেখেছে যাদের।

    কাদামাটির পুতুল
    বাংলায় যত রকমের পুতুল রয়েছে, তার মধ্যে সবচাইতে বেশি সংখ্যায় দেখা মেলে মাটির পুতুলের। তা সে কাদামাটি হোক অথবা পোড়ামাটি। হস্তনির্মিত এই পুতুলগুলির মধ্যে কিছু পুতুল রয়েছে যেগুলিকে আগুনে পোড়ানো হয়। কিছু আবার স্রেফ রোদে রেখে শুকালেই তৈরি হয়ে যায়। শুকানোর পর সেগুলিকে সাজানো হয় উজ্জ্বল বাহারি রঙে। বর্তমানে ভেষজ রঙের জায়গা নিয়েছে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি রঙেরা, তবে তাতে এ শিল্পের লৌকিক গুরুত্ব কিছুমাত্র ক্ষীণ হয়নি। প্রাথমিকভাবে পাঁচমুড়া (বাঁকুড়া), কুনুর (উত্তর দিনাজপুর) ও কাঁঠালিয়া (মুর্শিদাবাদ)-র মৃৎশিল্পীরা চাকার সাহায্যে আকার গড়ে, তা ভাটায় শুকিয়ে মাটির পুতুল গড়তেন। তবে পরবর্তীকালে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যে ধারা সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনযাপনের ধরন বদলে দিয়েছে, তা ছুঁয়ে গিয়েছে পুতুলশিল্পেও। কুমোরের চাকার বদলে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে নানা ধরনের ছাঁচ। এই ছাঁচে মাটি বসিয়ে কাঙ্ক্ষিত আকৃতি গড়ে নিয়ে, পরে আলাদাভাবে সেই শরীরের সঙ্গে হাত বা পা জোড়া লাগানো হয়।

    পোড়ামাটির পুতুল
    টেরাকোটা বা পোড়ামাটির শিল্প আদিম মানবসভ্যতার শিল্প প্রচেষ্টার প্রতীক। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলা টেরাকোটার আঁতুর  ঘর। মূলত বিষ্ণুপুর, পাঁচমুড়া, সোনামুখির পটুয়া পাড়ায় নির্মিত এই নিঁখুত টেরাকোটা শিল্প দেশের গণ্ডি পার করে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যে টেরাকোটার বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও এই শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। বাঁকুড়ার শতাব্দীপ্রাচীন মন্দিরের গায়ে এই টেরাকোটার কাজ জগৎবিখ্যাত। অপরূপ এই টেরাকোটা শিল্পে শিল্পীদের হাতে প্রাণ পায় হিন্দু পুরাণ আশ্রিত দেবদেবী, পশুপাখি ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথা।

    মজিলপুরের পুতুল
    পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুরে আগুন ও মাটির ছাঁচে নির্মিত পুতুলগুলির নিজস্ব ইতিহাস ও অতুলনীয় সৌন্দর্য রয়েছে। পুতুলগুলিতে বর্ণময় রঙের প্রলেপের পর দীপ্তি বাড়ানোর জন্য ‘গর্জন’ তেল দিয়ে বার্নিশ করা হয়। মজিলপুরের পুতুল তৈরির ইতিহাস প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো। বর্তমানে এই পুতুল তৈরি করেন শম্ভুনাথ দাস, পুতুলশিল্পী মন্মথনাথ দাসের পৌত্র। প্রায় দুই শতাব্দী আগে দত্ত জমিদারেরা বাংলাদেশের যশোর থেকে মজিলপুরে আসেন এবং সেখানেই থাকতে শুরু করেন। লোকমুখে শোনা যায়, তাঁদের উত্তরসূরি হরিনাথের হাতেই প্রথম জন্ম নিয়েছিল পুতুল তৈরির এক বিশেষ ঘরানা, যা মজিলপুরের পুতুল নামে খ্যাত। হরিনাথ ছিলেন মন্মথনাথ দাসের পূর্বপুরুষ। পরপর আটটি প্রজন্ম ধরে এই কাজ করে চলেছেন তাঁরা। ১৯৮৬ সালে মন্মথনাথ দাস তাঁর অসাধারণ শিল্পসৃষ্টি ‘জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা’-র জন্য সম্মাননীয় প্রেসিডেন্ট’স অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছিলেন। বর্তমানে শম্ভুনাথ দাস আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, যাতে এই শিল্প ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও বেঁচে থাকে। বর্তমানে তিনি ছাড়াও মজিলপুরের অন্যান্য কুমোরেরা তৈরি করেন দুর্গা, কালী, আহ্লাদ-আহ্লাদী, কলসি কাঁখে মেয়ে, গ্রামীন নারী, সাহেব-মেম, রাধাকৃষ্ণ, কালীয়দমন, গণেশজননী, দক্ষিণ রায়, বনবিবি প্রভৃতি নানান রংবেরঙের পুতুল।

    রানি পুতুল
    হাওড়া জেলার রানি পুতুল বাংলার হস্তশিল্পের একটি অসাধারণ নিদর্শন। আকৃতিগত ভাবে ষষ্ঠী পুতুলের সঙ্গে মিল থাকলেও এই দুই পুতুল আদতে আলাদা। একটি দু-তরফা কাঠের ছাঁচের মধ্যে মাটি ভরে পুতুলটিকে আকার দেওয়া হয়। কোনো কোনো শিল্পী এই পুতুলকে রং করেন, কেউ বা সামান্য অভ্র মিশিয়ে দেন। রানি পুতুলের একনিষ্ঠ সংগ্রহকারীরা অনেকেই মনে করেন যে, ইংল্যান্ডের ক্যুইন ভিক্টোরিয়ার আদলে এই পুতুল তৈরি করা হয়েছিল। রানি পুতুল নির্মাণের শিল্প মৃতপ্রায় হলেও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। শিল্পীরা এটিকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হাওড়ার দিবাকর পালের কথা। এই পুতুল তৈরির কাজ কোনোকালে তাঁর পূর্বপুরুষেরা শুরু করেছিলেন, বর্তমানে সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলেছেন তিনি। হাওড়া, হুগলি এবং নিকটবর্তী অন্যান্য জেলাগুলিতে গ্রামীণ মেলায় আজও এই পুতুলগুলি বিক্রি হতে দেখা যায়।

     

    কৃষ্ণনগরের পুতুল
    কথিত আছে, বাংলায় পুতুল তৈরির ইতিহাস প্রায় ২০০-২৫০ বছরের পুরোনো। একেবারে শুরুর দিনগুলি থেকেই মাটির পুতুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার নাম। কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যবাহী এই মাটির পুতুলগুলি নকশা, রং, নিপুণ শৈলী এবং নান্দনিকতায় অপরূপ হয়ে ওঠে। এখানকার মৃৎশিল্পীদের হাতে বানানো মাটির ফুলফল, শাকসবজি, পশুপাখি বা মানুষের বিভিন্ন অবয়ব এখনও খুব জনপ্রিয়। নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি এলাকায় বসবাসকারী কারিগরেরা প্রায় জীবন্ত দেখতে এই পুতুলগুলি তৈরি করেন।

    কাঠের পুতুল
    বর্ধমান জেলার নতুনগ্রাম এখানকার বিশেষ ধরনের কাঠের পুতুলের জন্য বিখ্যাত। সাদা সেগুন কাঠ খোদাই করে নতুনগ্রামের শিল্পীরা তৈরি করেন প্যাঁচা, বউ, রাজা-রানি, গৌরনিতাই, শিব-কালী-দুর্গা প্রভৃতি। বাংলায় কাঠের কাজের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০-২০০ অব্দ সময়কালের মৌর্য যুগে। সাম্প্রতিককালে নতুনগ্রামে কাঠের কাজ বা দারুশিল্প চর্চিত হয় ব্যাপকভাবে। কাঠের পুতুল শিল্পে উঠে আসে নিজস্ব দক্ষতা ও নান্দনিকতা। এখানকার অন্যতম বিখ্যাত পুতুলটি হল কাঠের প্যাঁচা। প্রাথমিকভাবে লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবে পুজোর উদ্দেশ্যে এটির সৃষ্টি হয়ে থাকলেও, পরবর্তীকালে ঘর সাজানোর সামগ্রী হিসেবে এর ব্যবহার হতে থাকে।

    পাটের পুতুল
    বাংলার উষ্ণ আবহাওয়া পাট চাষের পক্ষে অনুকূল। ফলে সময়ের সঙ্গে পাটের তন্তু প্রস্তুত করে, তা থেকে পুতুল তৈরির প্রচলন হয়। বহু বছর ধরেই পাটের পুতুল বানানো হয়ে থাকলেও বিগত ৫৬ বছরে এই শিল্পে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে। যে ধরনের পাটের তন্তু অন্য কোনো জিনিস তৈরিতে কাজে লাগানো সম্ভব নয়, সেগুলি দিয়েই রংবাহারি পুতুল তৈরি করা হয়। মুর্শিদাবাদের গ্রামীন মহিলারা এই পুতুল তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী। বর্তমানে পুতুলের পাশাপাশি নানাবিধ নিত্তনৈমিত্তিক জিনিসপত্র যেমন চাবির রিং, ব্যাগ, কম্বল ও অন্যান্য ঘর সাজানোর জিনিসও পাট দিয়ে তৈরি করে থাকেন তাঁরা।

    গালার পুতুল
    পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার ইলামবাজারে গালার পুতুল অধিক নির্মিত হলেও এই পুতুলের দেখা মেলে পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরেও। উজ্জ্বল রঙের, চমৎকার নকশাযুক্ত ছোটো ছোটো এই পুতুলগুলি বিভিন্ন দেবদেবী, প্রাণী ও মানুষের আদলে নির্মিত হয়। বীরভূমের শেখ ইউসুফ আলি এবং মেদিনীপুরের বৃন্দাবন দাস সক্রিয়ভাবে গালার পুতুল নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। গালার পুতুল তৈরি হয় এক আশ্চর্য পদ্ধতিতে, যা একাগ্র মনোযোগ ও অসীম ধৈর্যের ফসল। প্রথমে উইয়ের ঢিবি থেকে মাটি সংগ্রহ করে, তা জলে ভিজিয়ে রেখে দেওয়া হয়। মাটি গেঁজে উঠলে তা দিয়ে পুতুল তৈরি হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে আগুনে সেঁকা হয়। সাঁড়াশি দিয়ে জ্বলন্ত কয়লার উপর ধরে, পুতুলগুলির উপর ঢালা হয় গালার পরত। সবশেষে গালার সরু সুতো দিয়ে নানান রকম আলপনা আঁকা হয় সেগুলির গায়ে।

     


    বাঁকুড়া জেলার সোনামুখি অঞ্চলের পটুয়া পাড়ার দক্ষ শিল্পীদের হাতে বানানো এই ভাগ্যমণি মাটির পুতুল। এই পুতুলের মা পুতুলটি কখনও বসে আবার কখনও দাঁড়িয়ে থাকে, কোলে থাকে চার পুত্র সন্তান। খানিক মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা থেকেই এই পুতুলের ধারণা। সে সময় মনে করা হতো, এক মায়ের সকল সন্তানই পুত্র হলে তিনি খুবই ভাগ্যবতী অর্থাৎ, পুত্র সন্তানে মায়ের ভাগ্য নির্মিত হতো। সেখান থেকেই ভাগ্যমণি পুতুলের প্রচলন। 

    নতুন প্রজন্মের কাছে পুতুলের ঐতিহ্য খানিক হলেও ম্লান হয়ে এসেছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যদিও পুতুল শিল্পীরা বলে চলেছেন পুতুল নির্মাণের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পরম্পরার কথা। প্রয়াত হয়েছেন কত কত শিল্পীরা এবং তাঁদের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে পুতুল বানানোর কাজ। কখনও আবার উত্তরাধিকার বহন করেছেন প্রবীণ শিল্পীদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিরা। এই পুতুলগুলিই বাংলার পরিচয়। এগুলিকে সংরক্ষণ করা তাই বাঙালির দায়িত্ব। বাংলার পুতুল সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে - দ্য বেঙ্গল স্টোর (The Bengal Store)। স্থানীয় শিল্পী ও কারিগরদের জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করবার পাশাপাশি, দ্য বেঙ্গল স্টোর নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে বাংলার মানুষ যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারে নিজের শিকড়কে। এই সংস্থা বাংলার চিত্রকলা, কারুশিল্প ও বয়নশিল্পের উদযাপন করে চলেছে বছরভর

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @