No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বড়িয়ার পুতুলকথা— পশুপাখি থেকে দেবদেবী, কী না নেই সেই গ্রামে!

    বড়িয়ার পুতুলকথা— পশুপাখি থেকে দেবদেবী, কী না নেই সেই গ্রামে!

    Story image

    বড়িয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ডায়মন্ডহারবার থানার অন্তর্গত এক সুপ্রাচীন গ্রাম। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান এই বড়িয়া। ডায়মন্ডহারবারের ঠিক আগের স্টেশন তাই তাঁরই নামে নামাঙ্কিত, গুরুদাসনগর। এই স্টেশনের উত্তরদিকের লেভেলক্রসিং পেরিয়ে পূর্বদিকের পাকা-রাস্তা ধরে প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই বড়িয়া গ্রাম। আঞ্চলিক ইতিহাসের আঙিনায় বড়িয়া ও তার পার্শ্ববর্তী বোলসিদ্ধি গ্রাম প্রাচীন শৈবতীর্থরূপে সুপরিচিত। বোলসিদ্ধির সুপ্রাচীন অনাদিলিঙ্গশিবের মন্দির এবং বড়িয়ায় পাশাপাশি অবস্থিত গ্রাম্যদেবী মঙ্গলচণ্ডী ও শিবের দুটো চালামন্দির এই গ্রামগুলোর প্রাচীনত্বের সাক্ষ্যস্বরূপ।  

    চণ্ডী ও শিব মন্দির, বড়িয়া 

    বড়িয়ার পোটোপাড়া এবং চিত্রকরপাড়ার পটুয়ারা বেশিরভাগই ‘চিত্রকর’ পদবীধারী। একসময় এই গ্রামের পটুয়ারাও পট আঁকতেন, তবে এখন তা মৌখিক ইতিহাসমাত্র। বর্তমানে এখানকার বেশিরভাগ শিল্পীই কাঠামোর ঠাকুর গড়েন। তবে এই গ্রামের বেশ কিছু শিল্পী তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পুতুল তৈরির প্রবাহমানধারাটাকে আজও বজায় রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রবীণ শিল্পী অধীর চিত্রকর ও তাঁর স্ত্রী ভারতী চিত্রকর। গ্রামে ঢোকার মুখে পাকা-রাস্তার পাশেই তাঁদের ‘ওয়ার্কশপ’। বংশপরম্পরায় তাঁরা মাটির কাজ করে আসছেন। বৃদ্ধের ঝাপসা হয়ে আসা স্মৃতিপট থেকে তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা প্রায় মুছেই গেছে। তাঁর স্মৃতিচারণানুযায়ী তাঁর বাবা স্বর্গীয় হারান চিত্রকরও এই মাটির পুতুল তৈরির কাজ করতেন এবং তাঁরও পূর্বে পট আঁকার পরম্পরা তাঁদের বংশে ছিল। যদিও তার কোনো নিদর্শনই অধীরবাবুর কাছে নেই। পুতুলের বেশকিছু ছাঁচ তিনি নিজে বানালেও বেশিরভাগ ছাঁচই তাঁর বাবার আমলের। তবে সুখের কথা এই যে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মরা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বড়ো বড়ো কাঠামোর ঠাকুর তৈরির পাশাপাশি এই কাজেও যথেষ্ট উৎসাহী।

    ঘাড় নাড়া বুড়ো এবং অন্যান্য 

    কালীমূর্তি, শিল্পী - বৃহস্পতি মণ্ডল 

    বড়িয়া গ্রামের বারামূর্তি 

    এই অঞ্চলের শিল্পীদের সৃষ্ট পুতুলের তালিকায় দেবদেবীমূলক ছাঁচের পুতুলের মধ্যে পৌরাণিক এবং লৌকিক, দুই ধরনের দেবদেবীরাই আছেন। যেমন, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ, শিব, দুর্গা, কালী ইত্যাদির পাশাপাশি ষষ্ঠী, মনসা, দক্ষিণরায় প্রমুখের মূর্তিও শিল্পীরা বানান। বিভিন্ন পশুপাখির মধ্যে আছে বাঘ, সিংহ, হরিণ, শুঁড়তোলা হাতি, ঘোড়া, মোরগ, টিয়া ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন ফলমূল, সবজি, কুঁড়েঘর ইত্যাদিও তৈরি করেন। মূলত দু’খোলের ছাঁচে তৈরি, তাই এগুলোর ভিতরাংশ ফাঁপাই থাকে। ফলে এর গায়ে একটি লম্বাটে ছিদ্র করে দিলেই তা পয়সা জমানোর ঘটে পরিণত হয়। অর্থাৎ এর ব্যবহারিক গুণ কয়েকাংশে বেড়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে ছোটো ছোটো পাখিপক্ষ শিল্পীরা হাতেই বানিয়ে নেন। এ প্রসঙ্গে ভারতী চিত্রকরের তৈরি পেখম তোলা ময়ূর ও এইগ্রামের আরেক শিল্পী কমল চিত্রকরের কুঁড়েঘরের চালে বসা পাখি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মানসিক পূরণের জন্য নির্মিত দেবদেবীর বিভিন্ন ছলনমূর্তি ও সখীপুতুল এখানকার অনেক শিল্পীই তৈরি করেন। এছাড়াও বিভিন্ন মনীষীদের মূর্তি, ছাতাহাতে মেয়েপুতুল, কোটপ্যান্ট পরা, সিগারেট ঠোঁটে ধরা কৌতুকপ্রদ ঘাড় নাড়া বুড়োর ন্যায় সামাজিক বিষয়ভিত্তিক নানান পুতুলও এই তালিকায় আছে। বেশিরভাগ পুতুলই কাঁচামাটির। পোড়ানো হয় না। তবে কিছু শিল্পীর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। বাজারজাত গুঁড়ো রঙেই এদেরকে রং করা হয়। রং করা হয়ে গেলে বার্নিশ করার ঠিক আগে অ্যারারুটের প্রলেপ লাগিয়ে নেওয়া হয়। প্রয়োজন মতো সোনালি ও রুপালি রঙের ব্যবহার করা হয় সবশেষে। এভাবেই প্রতিটা পুতুল স্রষ্টার হাতের দক্ষতায় সম্পূর্ণতা পায়।

    এক ঝাঁক টিয়া 

    তবে এককালে যে এখানকার শিল্পীরা পটচিত্র আঁকতেন তাঁর প্রত্যক্ষ প্রমাণ অধীরবাবুর ভুঁড়িওয়ালা শিব অথবা কার্তিকের পুতুলের রূপায়ণে ও তুলির চলনের মধ্যে দিয়ে বেশ ভালো ভাবেই ধরা পরে। দেবদেবীদের ছাঁচের মূর্তি বাদ দিলে অধীরবাবুর কাছে প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ রকমের পুতুলের ছাঁচ আছে। 

    বাংলার পুতুলের আরও হালহকিকত জানতে এবং সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন।
    (সৌজন্যেঃ দ্য বেঙ্গল স্টোর/ The Bengal Store)

    এই গ্রামেরই অপর এক শিল্পী সত্তরোর্ধ অজিত চিত্রকর ও তাঁর পরিবার পুতুল তৈরির পাশাপাশি ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের মুণ্ডমূর্তি বা বারামূর্তিও বানান। তবে অজিতবাবুর বারামূর্তিগুলো ঠিক ঐতিহ্যবাহী বারামূর্তির মতো নয়। একদম সাধারণ দেবদেবীর মুখাবয়ববিশিষ্ট। মাথার সাদা মুকুটটাও অনেকখানি পরিশীলিত। ছাঁচে তৈরি এই মুণ্ডমূর্তিগুলো হয়তো বাজার-চাহিদাকে মাথায় রেখেই শিল্পী নিজস্ব আঙ্গিকে অতি মার্জিতরূপে তৈরি করেছেন।


    শিল্পী অজিত চিত্রকর 

    শিবের ছাঁচ

    পোটোপাড়ার পার্শ্ববর্তী চিত্রকরপাড়ার মদন মণ্ডলও বংশপরম্পরায় ছাঁচ ও কাঠামোর প্রতিমা নির্মাণের কাজ করে আসছেন। তাঁর ওয়ার্কশপে ওই গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের অনেক শিল্পীই কাজ করেন। তাঁর দাদা মোহন মণ্ডল ও বৌদি বৃহস্পতি মণ্ডল ছোটো ছোটো নানা ধরনের দেবদেবীর পুতুল ও পয়সা জমানোর ভাণ্ডার নির্মাণ করেন। প্রায় দুই’শতাধিক ছাঁচের অধিকারী এই মণ্ডলদম্পতির কাজে লাগামছাড়া উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে এবং তুলির টানে এক অদ্ভুত গ্রাম্য সারল্য পরিলক্ষিত হয়। স্থানীয় চৈত্রসংক্রান্তির গাজন-মেলা, চণ্ডীর বাৎসরিক পূজাপলক্ষে আয়োজিত মেলা, পৌষসংক্রান্তির মেলা, এমনকি ঢাকুরিয়ার রথবাড়ির রথের মেলাতেও এই অঞ্চলের শিল্পীরা তাঁদের পুতুলের পসার নিয়ে যান।

    কুঁড়ে ঘরের মাথায় পাখি

    পরিশেষে, এই গ্রামের এক বিশেষ আকর্ষণের কথা না বললে লেখাটি হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শুক্লাপক্ষের পঞ্চমীতিথিতে এই গ্রামে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক সার্বজনীন সরস্বতীপূজার আয়োজন করা হয়। এইসময় সাবেকি পূজা থেকে থিমের পূজা কোনও কিছুই বাদ যায় না। ক্ষেত্রানুসন্ধান থেকে জানা যায় যে, গ্রামদেবী মঙ্গলচণ্ডীর সম্মানার্থে দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রীর ন্যায় দেবীর পূজার আয়োজন এখানে করা হয় না। ফলে কলকাতার দুর্গাপূজা, বারাসাতের কালীপূজা অথবা চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীপূজার মতোই এই গ্রামের সরস্বতীপূজা এক বিরাট মহোৎসবের রূপ নেয়, চার-পাঁচদিন ধরে মেলা বসে। স্থানীয় শিল্পীরাই বায়নানুযায়ী দেবীর নানাধরনের বিরাটাকার মূর্তিগুলো গড়েন। ফলে মূলত সরস্বতীপূজার মরশুমেই তাঁদের ঘরে লক্ষ্মীর আগমন ঘটে। তবে ছোটখাটো মাটির-পুতুল এই প্লাস্টিকের ও ইলেকট্রনিক গেজেটের সাম্রাজ্যে যে টিকে থাকতে অক্ষম তা এই গ্রামের শিল্পীরা ভালো ভাবেই বুঝেছেন। তাই অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানকার শিল্পীরাও প্রতিমা নির্মাণের দিকেই বিশেষ মনোনিবেশ করছেন। ফলে অদূর ভবিষ্যতে এই গ্রামের পটচিত্রের মতো পুতুল তৈরির ধারাও যে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য।

    কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
    বিকি কর, দেবদত্ত গুপ্ত, অলোক কুমার শর্মা।

    ছবিঃ প্রতিবেদক।
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @