কলকাতার পুরোনো দোলের গল্প

‘বসন্ত বাতাসে সই গো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে।।’
বসন্ত তো প্রেমের ঋতু। সেই বসন্তের সবচেয়ে বড়ো প্রকাশটি দোল উৎসব। অন্তত এদেশে তাই। প্রকৃতির নতুন রঙের পাশে মানুষের শরীরেও নতুন রং। ফাগের থালা, কুমকুমে সে রং গাঢ় হয়। শহর কলকাতায় যদিও প্রকৃতি আর বেঁচেই নেই প্রায়। তবু বসন্তে ইতিউতি শিমুল ফুল, পলাশ দেখা দেয়। কালো পিচের রাস্তা দোলের পরে দুদিন বেশ রঙিন থাকে। তারপর ফের জমে ধুলোর পরত। দোল উৎসব অবশ্য সেই কবে থেকেই মাতিয়ে রাখত কলকাতাবাসীকে। পুরোনো দোল আর নতুন দোলে কিন্তু খুব তফাৎ নেই। কলকাতাটা যদিও গত তিনশো বছরে আকাশপাতাল পালটে গেছে। তবু দোলের আনন্দ ও মাতামাতিতে চিড় খায়নি এতটুকু।
আরো পড়ুন
পাজি ‘সঙের দল’ আর সেকেলে কলকাতা
দুর্গাপুজো, চরক, রথযাত্রার পাশাপাশি দোল যে বেশ বড়োসর ব্যাপার ছিল কলকাতায়, তা বোঝা যায় জায়গার নামে। কলকাতার দুটো প্রধান জায়গা লালদিঘি আর লালবাজার-- এই নামের পিছনেই নাকি রয়েছে দোলেরই মাহাত্ম্য। লালদিঘির গা ঘেঁষেই ছিল শ্যামরায়ের মন্দির। সে মন্দিরে রাধাকৃষ্ণকে রং মাখানো হত জবর। আর তাতেই নাকি লাল হত দিঘির জল। দিঘির উত্তরে ও দক্ষিণে ছিল দুটো দোলমঞ্চ। দক্ষিণ দিকে গোবিন্দজির আর উত্তরে রাধিকাজির। দোলের দিনে একদল লোক গোবিন্দজির পক্ষ নিয়ে সাজত রাখাল। আরেকদল লোক (পুরুষ) রাধিকাজির পক্ষ নিয়ে সাজত সখি। তারপর দুই দলে রঙে রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার লড়াই হত। যেদিকে রাধার মঞ্চ, পরবর্তীতে সেদিকটার নাম হয়ে গেল রাধাবাজার। আর দোল উপলক্ষে বসত এক বিশাল মেলা বা বাজার। বিক্রির জন্য সেখানে পাহাড়প্রমাণ আবির, কুমকুম জড়ো হত। সেই থেকেই নাকি লাল বাজার।
যদিও মতভেদ আছে এহেন নামকরণ নিয়ে। তবুও, দোল যে ওই চত্বরের একটা বিশাল ব্যাপার ছিল তা নিয়ে দ্বিমত নেই কোনো।
লালদিঘি
দোলের উৎসব একদিনের হলেও তার উদযাপন হত ঢালাও। বাড়ি বাড়ি পুজো, নিমন্ত্রণে লোকে লোকারণ্য। আর দোলের খাবার হিসেবে অবধারিত থাকত চিনির মুড়কি, চিনির মঠ আর ফুটকড়াই। চিনি মাখানো ফুটকড়াই বাঁধা থাকত কোঁচরে। লোকে আবির মেখে ঘুরে বেড়াত আর সুযোগ বুঝে শোলার পুটির ভিতরে আবির পুরে ছুড়ে মারত মুখে। সং বেরোত এই দোল উৎসবকে ঘিরে। নানান শ্রাব্য-অশ্রাব্য গান-বাজনা হত। অবশ্য ছেলেবুড়ো একসঙ্গেই দাঁড়িয়ে পড়ত সেসব দেখতে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে বর্ণনা দিয়েছেন দোলের আড়ম্বরের। তাদের দেউরি গমগম করত দোলের ভিড়ে। চারদিকে লাল আবিরের ছড়াছড়ি, আর দূর থেকে কেবলি রব উঠত- ‘হোরি হ্যায়’। বেহারা ঢোল বাজাত। গান হত খচমচ শব্দে। আর উঠোনের একদিকে থাকত সিদ্ধির দেদার আয়োজন।
আরো পড়ুন
চড়ক ঘোরার আয়োজন হয় চড়ক ডাঙায়
হোলিতে কলকাতা যেন রাজপুতানি বনে যেত। বেহারারা অদ্ভুত ভঙ্গির নাচ নাচত নাকি। দুই হাত তুলে, দুটো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নাচ। বাড়ির ছোটোদের জন্যে থাকত টিনের পিচকিরি। আবির-গোলা জলে সেই পিচকিরি ডুবিয়ে রাস্তায় যাকে পারত, তার গায়েই ঢেলে দিত রঙ।
দোলের বিকেলে বসত যাত্রা। বড়ো মানুষরা বড়ো করে সাজাতেন দোল উৎসবের আসর। তাই কোথাও হত বাইনাচ। গওহর জান, মালকাজান, নূরজাহানদের আগমনে মেহফিলে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। শোনা যায় ওয়াজেদ আলি শাহর রাজসভাও আলো করত বিখ্যাত সব বাইজিরা। এভাবেই পুরোনো কলকাতার দোল মাতিয়ে রাখত সে যুগের মানুষদের।
তবে এই দোলকে ঘিরে একটি বিশেষ গল্প লুকিয়ে আছে। সেই গল্পের ভিতর দিয়ে আসলে দোল উৎসবের শিকড়েও পৌঁছে যাওয়া যায়।
জোব চার্নকের ফিরিঙ্গি সাঙ্গপাঙ্গরা একবার নাকি পৌঁছে গিয়েছিল সাবর্ণ চৌধুরীদের দোলখেলায় সামিল হতে। সেখানে সখিদেরকে তারা চিনতেই পারেনি পুরুষ হিসেবে। তারা ভেবেছিল, কামমহোৎসব পালিত হচ্ছে। তারপর যা হয় আর কী! কলকাতাবাসী বেসামাল ফিরিঙ্গি সাহেবদের এই বেয়াক্কেলপনাকে নাকি আচ্ছা করে পিটিয়ে শায়েস্তা করেছিল।
সাবর্ণ চৌধুরীদের বসত ভিটে
নেহাৎই গল্প। তবে একথা ঠিক যে, হোলি উৎসবের সঙ্গে কামমহোৎসবের মিলেমিশে যাওয়ার ফলেই দোলের উদযাপন এমনরূপ ধারণ করেছিল। ষোড়শ শতক থেকেই এই বিবর্তন মূলত। তাই প্রচুর নৃত্য গীত বাদ্য, যৌন অঙ্গভঙ্গি এখানে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে শ্যাম ও শ্যামরাইয়ের ঝুলনে চড়ার কল্পনাও।
আর পরবর্তীতে রক্তমাংসের নরনারীও সেই দোদুল দুলনার অংশ। দোলের সেই ট্রাডিশন সমানেই চলছে।
কে না জানে, বসন্ত আসলে প্রেমেরই ঋতু।