No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    দীপিকা জানে

    দীপিকা জানে

    Story image


    দীপিকা জানে তার চেহারায় এক ধরনের সারল্য আছে। সে তেতাল্লিশ। এই বয়সেও যার শরীরে জটিলতা এবং দৈনন্দিন নিগূঢ় টানাপোড়েনের ছাপ পড়েনি, সে শুধু সরল নয়, নির্বোধও। এটা দীপিকার নিজস্ব ধারণা। দীপিকা এ জাতীয় নানারকম নিজস্ব ধারণা সমেত প্রায়শই নিজের ও চারপাশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। ক্ষিপ্ত বলা ভুল। তার স্বভাব মূলত মৃদু, সে খুব মনোযোগ দিয়ে রেগেও যেতে পারেনি জীবনে কখনওই। যদিও যাবার কারণ ছিল সহস্ররকম। সে অসহায় রকমে বিরক্ত হয়ে থাকে। তখন তার কুঁচকে থাকা ভ্রূ, তার বেড়ে যাওয়া হাঁটাচলার গতি মিলিয়ে সাধারণত তাকে আরও ছেলেমানুষ দেখায়। এখনও দেখাচ্ছে। ঘড়িতে সাড়ে সাত। সময়টা ঠিক তার ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকার মত নয়। মুশকিল হল, সে আছে। মুশকিল তার নয়, মৌ-এর। অন্তত দীপিকার ধারণা তাই। মৌ একুশ, তার মুশকিলেরই বয়স। মৌ যখন তিন ছিল, সে তখনও মুশকিলই করত। এখন বেড়েছে। গত কয়েকদিনে তার সঙ্গে দীপিকার দেখা হয়েছে খুব কম, সামনে খুব বড় পরীক্ষা না থাকা সত্ত্বেও সে প্রায়ই কলেজ যাচ্ছে না। দীপিকার সঙ্গে তার বাক্যালাপ প্রায় নেই। এই বাক্যালাপ না থাকার পিছনে তেমন তীব্র কোনও কারণও নেই অবশ্য। মৌ মাঝে মাঝেই এটা করে থাকে। দীপিকার তুলনায় মৌ বহুগুণ আত্মস্থ। কখন সে জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, কখন নয়, এটা সে নিজে ঠিক করে।

    দীপিকা দরজার ঠিক মুখোমুখি প্রায় মিনিটপাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পর মৌ চোখ খুলল। দীপিকা জানে এই পাঁচমিনিট মৌ তাকে সময় দিচ্ছিল। মন বদলানোর। অর্থাৎ চাইলে সে মৌয়ের সঙ্গে এখনই কোনও কথাবার্তায় না ঢুকতে পারত। পাঁচমিনিটের পর মৌ আর সময় নষ্ট করতে চায় না। সে সরাসরি দীপিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল ‘মা, বলো!’ মৌ পরে আছে একটি ছাইরঙ টি শার্ট, তার ঘুম খুব বেশিক্ষণ ভাঙেনি। জানলা দিয়ে সকালবেলার যে আলো ঘরে এসে ঢুকছে, তাতে তাকে দেখাচ্ছে অপরূপ। দীপিকা খুব হতাশভাবে ঘাড় নাড়ল, ‘কিছু না। তুই কি আজও কলেজ যাবি না?’ মৌ তার অপরূপ মুখে অপরূপতর একটা ভঙ্গি করল, এখন তার মুখে মায়ের প্রতি প্রায় স্নেহই। সে অতি দরদী গলায় বলল ‘না, আজও না। তুমি কি জানতে চাও কেন?’ এইসব সময় দীপিকার ক্ষীণ ভাবে ঘাড় নাড়া ছাড়া কিছু করার থাকে না, সে তাই করল, ‘জানতে চাই। কেন?’ মৌ একইরকম স্নেহশীল গলায় বলল ‘তেমন কোন কারণ নেই মা। জাস্ট ইচ্ছে করছে না। তুমি কি আমার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত? ...প্লিজ, ডোন্ট। ওটা চিন্তার বিষয় না। বিষয় হল আমি হয়ত আরও কিছুদিন কলেজে যাব না। আমার কদিন বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছে, সিম্পলি আরাম করতে। থাকি?’

    দীপিকা জানে মৌয়ের এই প্রশ্ন, প্রশ্ন নয়। ঘোষণা। আগে হত না, আজকাল মাঝে মাঝে মৌয়ের সামনে তার অসহায় ভাবটা বেড়ে যায়। সুব্রত-র সামনে যেমন যেত। মৌকে ভর করে বহুদূর অতীত থেকে সুব্রত-র ভারী ছায়া তার সামনে এসে দাঁড়ালে সে ইদানীং দ্রুত আত্মরক্ষা করতে চায়। এখনও চাইল। অর্থাৎ, সরে গেল।
     


    দুপুরের পর আজ তার ক্লাস ছিল না আর। এই সময়টা ফাঁকা স্টাফরুমে সে তার বকেয়া কাজগুলো করে নেয় প্রায়ই। টুকটাক কেজো ফোন সারে, খাতাপত্র জমে থাকলে তাও। অবশ্য ফাঁকা স্টাফরুম দীপিকার বরাতে থাকে খুবই কম। আজ ছিল। কিন্তু আবারও মুশকিল এই, দীপিকার আজ হাতে কাজ কিছু নেই। তার শেষ ক্লাস ছুটির ঠিক আগে। এই সময়টা স্কুল থেকে বেরিয়ে সে আগে চৌরাস্তার স্টেট ব্যাঙ্কে যেত। চৌরাস্তার ব্রাঞ্চে তার কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। সে অরণির কাছে যেত। অবশ্য এরকম ফাঁক পেলে শুধু নয়, ছুটির পরও তাদের একটা নৈমিত্তিক দেখা হওয়ার ব্যাপার ছিল। অরণি মাসদুয়েক বদলি হয়ে গেছে কৃষ্ণনগর। সুতরাং চৌরাস্তা এখন কোনও গন্তব্য নয়। তবে অরণিকে ফোন করাই যায় এখন। বরং অরণিকেই ফোন করা যায়। মৌকে নিয়ে তার চিন্তার কারণ গত তিনবছরে অজস্রবার ঘটেছে। তার সমস্যাগুলো যে সমস্যাই নয় আসলে, প্রত্যেকবারই সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে একমাত্র অরণিই। অরণি এই তিনবছরে এছাড়াও বহু কিছুই প্রমাণ করেছে অবশ্য। দীপিকা যে কোনও অবস্থাতেই, একজন চল্লিশ পেরোনো, ঘরোয়া অত্যাচারের শিকার, সাত বছর ধরে বিবাহবিচ্ছিন্ন একক মা মাত্র নয়, সে যে এখনও বেশ চমৎকার এক রমণী, ভেঙে যাওয়া বিয়ে ও সন্তান ছাড়াও যে এখনও তার ভাববার ও করবার মত আছে অনেককিছুই, অরণি এটা সার্থকভাবে প্রমাণ করে দেওয়ার পর, দীপিকা এখন নিজেও আলগা দিয়েছে বহুদূর। শুধু কোন অজ্ঞাত কারণে, অথবা স্বাভাবিক কারণেই, মৌ বরাবর অরণি সম্পর্কে শীতল। মৌ সুব্রত-র খুব ভক্ত ছিল এমনও কোনকালেই নয়। বরং সে ছোটবেলায় তুমুল অশান্তি দেখতে অভ্যস্ত ছিল বরাবর। দীপিকা যখন কসবা ছেড়ে বরানগর ফিরে এল, অভ্যাস পরিবর্তনের কারণে যেটুকু, তার চেয়ে বেশি দুঃখিত হয়নি বালিকা মৌ। দীপিকার বাবা জীবিত ছিলেন তখন, মৌ বরং অনেকটা সুস্থির হতে পেরেছিল দাদুর কাছে এসেই।

    দীপিকা ফোন লাগাচ্ছিল অন্যমনস্কভাবে। তার অন্যমনস্কতা বাধ্যত ভাঙল প্রায় দশমিনিট ধরে অরণির নম্বরটি ব্যস্ত থাকায়। লাইন ব্যস্ত থাকা সমস্যা নয়। সমস্যা এই যে অরণি সাধারণত পালটা ফোন করে মিনিট দু-তিনের মধ্যে। আজ করছে না। এখন তার ঘোর অফিস আওয়ার। এই সময় তার দীর্ঘক্ষণ ফোনে থাকা, দীপিকার অভিজ্ঞতায় নেই। সে মৌয়ের সঙ্গে কথাবার্তায় সুবিধে করতে পারেনি সকালে, তার পর থেকে তার সব পরিকল্পনাই অত্যন্ত এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আজ। দীপিকা অতএব তার সেই অসহায় বিরক্তির কাছে নিজেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল সকাল থেকে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার।


    অরণির খবর দিল মৌ। খবর ঠিক নয়। সে দ্বিতীয় একটি ঘোষণা করল। কলেজ বিষয়ে নয়। কৃষ্ণনগর বিষয়ে। তার ধারণা জলঙ্গি নদী অথবা রাজবাড়িটি তার দেখা প্রয়োজন। সুতরাং সে কৃষ্ণনগর যাচ্ছে সপ্তাহান্তে। তবে একা নয়, তার বন্ধু অর্ক যাচ্ছে সঙ্গে। অরণি ঠিক আমন্ত্রণ জানায়নি, তবে সে সম্মতি জানিয়েছে তাদের এই যাওয়ায়। আজকাল দুপুরে সে প্রায়ই ফোন করে অরণিকে। কারণ? কারণ এখন তার অরণির সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। অরণি ‘সম্মতি’ দিয়েছে এই অংশের পাঠোদ্ধার করতে না পেরে দীপিকা এবার আবার যখন অরণিকে ফোন করল, এইবার তাকে পাওয়া গেল চট করে। দীপিকা বরাবরের মত একটি সমাধান আশা করেছিল। অরণি অবশ্য সমাধানই দিল। অর্থাৎ এই মুহূর্তে মৌ যা চাইছে, দীপিকার তাই করতে দেওয়া উচিত। সে নিজে থেকেই হঠাৎ ফোন করা শুরু করেছে অরণিকে। অরণির ধারণা, কোনও কারণে দীপিকার অতি সতর্কতায় মৌ বিরক্ত। তার এই বিরক্তি কাটাতে গেলে দীপিকার সামান্য শিথিল হওয়া প্রয়োজন। কৃষ্ণনগর একটি নির্দোষ জায়গা, বন্ধুর সঙ্গে একদিনের জন্য সেখানে বেড়াতে যাওয়া, গুরুতর কিছু নয়। অরণি নিজেই ওই একদিনে মৌ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য দীপিকাকে দিতে থাকবে ফোনে।

    তথ্য অবশ্যই দিতে থাকল অরণি। তবে যে তথ্য দীপিকার কাছে নিজে হেঁটে এল, তা তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণনগরের দিন সন্ধেবেলা তাদের ল্যান্ডলাইনে একটি ফোন এল। করছে মৌয়ের বান্ধবী পারমিতা। মৌকে সে বারচারেক ফোন করেও ধরতে পারেনি মোবাইলে।

    এই বয়সী মেয়েদের নানা নিজস্ব আলোচনা থাকে। পারমিতা মৌয়ের সঙ্গে তাদের বাড়িতে এসেছেও কয়েকবার। মৌয়ের তুলনায় এ মেয়েটি অনেক বেশি প্রাণবন্ত। ফলে তাকে অল্পবয়স্ক লাগে আরওই। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রথমেই দীপিকাকে আদেশ করল ‘কাকিমা, তুমি মৌকে দাও। আমার ঝগড়া আছে।’

    - ঝগড়া আছে থাক। মৌকে এখন দেওয়া যাবে না। আগে বল তোদের কী নিয়ে ঝগড়া।

    - মৌ আমায় দু দিন ধরে বলছে পরে ফোন কর, আর কত পরে?

    দীপিকা এজন্যই পারমিতাকে পছন্দ করে খুব। সে খুব খানিকটা হেসে নিয়ে অর্ক ও মৌয়ের কৃষ্ণনগর যাবার তথ্যটি দিতে, পারমিতা আরও অধৈর্য গলায় জানাল, দীপিকার ভুল হচ্ছে কোথাও। অর্ক মৌয়ের বিশেষ বন্ধু ঠিকই, তবে সে পারমিতারও বন্ধু। সেদিন বিকেলেই তাদের কথা হয়েছে একবার। অর্ক দিব্যি বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসে রবিবার কাটাচ্ছে। দীপিকা সম্ভবত অন্য কারও সঙ্গে অর্ককে গুলিয়েছে। চাইলে সে অর্কর নম্বর দিতে পারে এখনই। দীপিকা কথা বলে নিক।

    মৌ কথামতোই ফিরল পরের দিন। তার চেহারা নির্ভার। সে খুব উচ্ছ্বসিত প্রকৃতির মেয়ে নয়। তবে তার স্বাভাবিক শীতলতাটুকু উধাও।  দীপিকার মুখচোখ দেখে এ-যাত্রা সে কথা শুরু করল নিজেই। হ্যাঁ, শেষ মুহূর্তে মৌ-ই অর্ককে যেতে বারণ করেছিল। তার একা বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করেছিল খুব। তারপর সেই একইরকম স্নেহশীল মুখে সে তাকাল দীপিকার দিকে। তার দৃষ্টিতে গভীর করুণা, স্বরেও- ‘তুমিও তো কতবার কাকুর কাছে একলাই গেছ মা। এতে এরকম করছ কেন? তুমিই ইনসিস্ট করতে আমাদের ভালো করে আলাপ হোক। হল। আমার তো ভালোই লাগল বরং।ব লতে পারো তুমি যাও তোমার বন্ধু, তাই। আমি কেন গেছি! বেশ, বন্ধুই তো তোমার...ধরে নাও আমারও এখন। বন্ধু তো সবাই সবার হতে পারে মা, কী সমস্যা?’
     


    দীপিকা স্কুল কামাই করেছিল আজ বেশ কিছুদিন পর। সে মৌকে নিয়ে গত দু’তিন সপ্তাহ ধরে ভাবা কমিয়ে দিয়েছে অনেক। কোনও দুর্বোধ্য কারণে মৌ অসামান্য দক্ষতায় কৈশোর থেকেই মা'র প্রতি নিজের বিরাগকে দমন করে থেকেছে বরাবর। এটা সে বুঝেছে এখন। সুব্রত-র প্রতি মৌয়ের সহানুভূতি না থাক, অন্তত এই বিরাগ নেই। কেন নেই দীপিকা জানে না। সে অরণিকে নিয়েও ভাবছে না তেমন। অন্তত সে উচ্চকিত কোনও ঘটনার অবতারণা করেনি সেদিনের পর। সে তেতাল্লিশ। তাকে ছেলেমানুষ দেখায় সে জানে। তবু সে তার সনাতন আশ্রয় সেই অসহায় বিরক্তিতে ফিরে যেতে পারছে না এই বার। খুব সম্ভব এরপর তার দ্বিতীয় দীর্ঘস্থায়ী আশ্রয় হতে চলেছে মৌয়ের বিরাগ-উত্তর করুণাই।

    কিন্তু আজ সে স্কুল কামাই করেছিল অন্য কারণে। এই মুহূর্তে তার বিরক্তি নেই তেমন। সে যে খুব অসহায় বোধ করছে তাও নয়। তার হাঁটাচলাও দ্রুত নয়, স্বাভাবিক। একটি সাদামাটা সালোয়ার কামিজ তার পরনে। মৌ কলেজ সম্পর্কে অনীহা ত্যাগ করায় দুপুরের স্টাফরুমের চেয়েও তার বাড়ি বেশি ফাঁকা এখন। এখনও আলো জ্বালানোর মত সন্ধ্যা হয়নি। তবে বিকেল মরে আসছে। জানলা দিয়ে সেই পড়ে আসা বিকেলের যে আলো ঘরে এসে ঢুকছে, তাতে দীপিকার স্বাভাবিক ছেলেমানুষ মুখশ্রীকে দেখাচ্ছে মায়াময়।

    অর্ক এসেছিল উদ্বিগ্ন হয়েই। মৌয়ের সে বিশেষ বন্ধু অবশ্যই। অন্তত তেমনটা সে জানত। গত বেশ কিছুদিন ধরে মৌ তার সেই ধারণায় ক্রমাগত জল ঢেলে চলেছে। দীপিকা তার ফোন নম্বর পেয়েছিল পারমিতার থেকে। দীপিকার ফোনও ছিল একই প্রশ্ন নিয়ে। মৌয়ের কী হয়েছে অর্ক জানে কিনা। অর্ক অবশ্যই জানে না জেনে ফোনে দীপিকা তাকে বলেছিল, অর্ক কেন তাদের বাড়ি এসে মৌয়ের সঙ্গে খানিকটা জোর করেই এ বিষয়ে কোনও আলোচনায় ঢুকছে না। অন্তত উচিত তো তার তেমনটাই। সে যেদিন আসতে চায় আসুক। প্রয়োজনে সেদিন ছুটি নেবে দীপিকাও। 

    দীপিকা ছুটি নিয়েছে। মৌ এই পরিকল্পনার কিছু জানে না বলে কলেজ থেকে ফিরতে তার দেরি হতে পারেই। দরজা খোলার পর অর্ক একা দীপিকারই সেই মায়াময় মুখ দেখল সামনে। দীপিকাও দেখছিল। তার মনে হল একই। পারমিতা, অর্ক, এরা সকলেই তার মেয়ের তুলনায় বহুগুণ তরুণ। সে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অর্ককে ডাকল – ‘এসো ভিতরে।'


    মৌ এবারও নিজেই কথা বলতে এল দিন সাতেক পর। দীপিকা অবশ্য তাকে পাঁচ কেন, এক মিনিট সময় দেওয়ারও সময় পেল না তখন। আজও মৌয়ের স্বাভাবিক শীতলতা নেই। সে বহুদূর অস্থির। মুখোমুখি দাঁড়ালে দীপিকার চেয়ে সে অনেকটাই লম্বা। তার স্বরে আজ কোনও দয়া নেই, কাঠিন্য আছে। সরাসরি প্রশ্নও – ‘অর্ক আমার সঙ্গে তেমন কোনও যোগাযোগ করছে না মা, অথচ আমি যখন থাকি না, আমি জানি ওর সঙ্গে তোমার প্রায়ই দেখা হয়। অদ্ভুত, না? আমার বন্ধু, তার খবর আমি জানি না, তুমি জানো। মা, ক্যান য়্যু প্লিজ এক্সপ্লেন?’

    দীপিকা জানে তেতাল্লিশেও তার চেহারায় এক ধরনের সারল্য আছে। এই ধরনের চেহারা যাদের, তার ধারণা - তারা শুধু সরল নয়, নির্বোধও হয়। তবে দীপিকা জানে তার সব ধারণাই সব সময় ঠিক না। যেমন, সে নির্বোধ না। এই মুহূর্তে সে এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে স্পর্শ করতেই পারত। বহুদিন পর, ভয়হীন, দ্বিধাহীন। সে তা করল না। বদলে তার স্বরে এল গভীর করুণা – ‘অর্ক কেন যোগাযোগ করবে না তোর সঙ্গে? করবে নিশ্চয়ই। হয়ত ব্যস্ত একটু। এবার দেখা হলে আমি বলব কি? তোদের অর্ক তো খুব মজার ছেলে মৌ, তোর বন্ধু বলে আমার বন্ধু হতে মানা নাকি রে ওর? ও তো দিব্যি আমারও বন্ধু এখন।’

    মৌ দাঁড়িয়েই থাকল অবশ্য। মুশকিল, এখন তার দাঁড়িয়ে থাকার সময় না। আগে হলে এই সময় সে ঘুম থেকে উঠত। ছাইরং টি শার্টে তাকে অপরূপ দেখাত ভারী। তবে দীপিকা জানে তার নিজের স্বরে এই করুণা তাকে অপরূপ নয়, মায়াময় করেছে বরং। এই সদ্য সকালবেলায় সেই মায়া যেন বেশি মানানসই। মায়াটুকু, মৌয়ের প্রয়োজন ছিল খুব। বাকিটা সে নিজেই সামলে নিতে পারবে...

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @