No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মেদিনীপুরের দীপাবলি পুতুলে কি ঝাঁসির রানির আদল?

    মেদিনীপুরের দীপাবলি পুতুলে কি ঝাঁসির রানির আদল?

    Story image

    পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে মৃৎশিল্পের যোগ অনেকটা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর আঁকা ‘ক্রিয়েশন অফ আদমের’ মতোই নিবিড়। এই জেলাকে বলা যেতেই পারে মৃৎশিল্পের গর্ভগৃহ। আর, এহেন যোগসূত্রের মূলে রয়েছে নদীর প্রভাব। অন্য কতগুলি নদীর মতোই কংসাবতী তথা কাঁসাই যার অন্যতম প্রাণশক্তি। এমনকি বলা যেতে পারে, কাঁসাইয়ের সঙ্গে যেন একপ্রকারের নাড়ির যোগ এখানকার মৃৎশিল্পের।

    নদীকে কেন্দ্র করেই এখানকার কুমোর সম্প্রদায়ের মৃৎশিল্পীরা মাটিকেন্দ্রিক শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। সেই সব মাটির তৈরি নানাবিধ জিনিসের মধ্যে যেমন রয়েছে মাটির হাঁড়ি, কলসি, সরা, মালসা, ভাঁড় ইত্যাদি তেমনই রয়েছে পুতুলও। পশ্চিম মেদিনীপুরের মাটির পুতুলের বাহারও নেহাত কম না। সেখানে টেপা পুতুল, জো পুতুল, হাতি-ঘোড়ার পাশাপাশি রয়েছে দীপাবলি পুতুল বা দীপলক্ষ্মী পুতুল। পূর্ব মেদিনীপুর, এমনকি পুরুলিয়াতেও তৈরি হয় এই পুতুল। গবেষকদের অনেকেই বলেন, এই পুতুলের জন্ম পুরুলিয়াতেই। আঠেরো শতকে অধুনা ঝাড়খণ্ড থেকে একদল কুমোর পুরুলিয়ার বলরামপুর, ছাতাটাঁড় ও কুক্কড়ু গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের হাতেই প্রথম তৈরি হয় দীপাবলি পুতুল। পরে, এই পুতুল ছড়িয়ে পড়ে মেদিনীপুরেও। তারপর কালক্রমে, এই পুতুলের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় পশ্চিম মেদিনীপুরের মির্জাবাজার। 

    দীপাবলি পুতুল

    মূলত, দীপাবলী তথা কালিপুজোর মরসুমে পশ্চিম মেদিনীপুরের মির্জাবাজার অঞ্চলের ক্ষেত্র সমীক্ষা করলে দেখতে পাওয়া যাবে-- রাস্তার দুইধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ প্রদীপযুক্ত পুতুল, বাতিপুতুল (পুতুলের হাতে প্রদীপের পরিবর্তে ধরানো লম্ফের মতো বাতি), ঝাড়পুতুল (২৫-৩০টি প্রদীপ একসঙ্গে)। পুতুলের অবয়বটি এক নারীর। নানা ধরনের দীপাবলি পুতুলের মধ্যে অন্যতম ঘোড়ায় উপবিষ্টা পুতুল। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি, সোনালি রং গায়ে মেখে ঘোড়ায় উপবিষ্টা এই নারী-পুতুলের গড়ন দেখে বিস্ময় জাগে। যেন, অমানিশা অবসানের লক্ষে রওনা দিতে সে প্রস্তুত। তার পরনে ঘাঘরার মতো ভূষণ, যার রং ও রেখায় নান্দনিকতার ছোঁয়া। নলাকার দুটি হাত মাথার ওপর বর্ধিত, যার লাগোয়া তিনটি প্রদীপ। ঘোড়ার পায়ের অবস্থান স্পষ্টতই গতির ইঙ্গিত বহন করছে। 

    এক ঝলক দেখলে, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই-এর সঙ্গে মেদিনীপুরের এই অশ্বারোহী মৃণ্ময়ী মূর্তির মিল চোখ এড়ায় না। তফাত বলতে, একজন ধরে আছে প্রদীপ আর ওপরের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা তরোয়ার ও ঢাল। প্রশ্ন জাগে, এই মিল কি কাকতালীয় নাকি ইচ্ছাকৃত? ঘটনাচক্রে, মির্জাবাজারে কুমোরপাড়ার পত্তন হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। মহাবিদ্রোহের সূত্রপাতও এই বছরেই। সেই বিদ্রোহের যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া রানি লক্ষ্মীবাইয়ের গল্প-কিংবদন্তীরা কি এসে পৌঁছেছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের কুমোরপাড়াতেও? তারপর, পুতুলেও জড়িয়ে গেছিল সেই ইতিহাস? একদিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালানো রানি, অন্যদিকে অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোর দিশা আনার প্রতীক এই পুতুল। সাদৃশ্যের ইতিহাস আরো পোক্ত হয়।

    ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই

    অবশ্য, এই ইতিহাসের সঙ্গেই জুড়ে থাকা পৌরাণিক অনুষঙ্গটিকেও ভোলা যাবে না। পৌরাণিক মতে, রাবন-বধের পালা সাঙ্গ হওয়ার পরে রাম-সীতার অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে এমন প্রদীপধারী নারীরাই দীপাবলী উৎসবের সূচনা করেন। দীপাবলি পুতুলের জন্ম-উৎস এই কাহিনিই। আবার, ‘জ্যোতির্লক্ষ্মীস্তোত্রম’-এ রয়েছে দীপলক্ষ্মীর উল্লেখ—“জ্যোতিস্স্বরূপিণী মাতা দীপলক্ষ্মী সুমঙ্গলা।” এই পুতুলকেও অনেকে দীপলক্ষ্মী পুতুল নামে ডাকেন। 

    ঘোড়ায় উপবিষ্টা পুতুল

    ইতিহাস বা পুরাণের অনুষঙ্গ যাই হোক না কেন, এই পুতুলে মানবজীবনের সত্যটিও যেন গাঁথা। কঠিন জীবনসংগ্রামের পর বিশ্বদরবারে নিজেদের আসন তৈরি করে নিয়েছেন যে সমস্ত নারীরা, সেই আলোকপ্রজ্জ্বলিনী নারীদেরও প্রতীক যেন এই পুতুল। অমানিশার বিনাশ ঘটিয়ে বহতা জীবনকে প্রদীপের নব আলোয় সাজিয়ে তোলার জিওনকাঠি তো এই নারীরাই।    

    কৃতজ্ঞতাঃ দীপঙ্কর পাড়ুই, সৌম্য সেনগুপ্ত, ইন্দুলেখা ঘোষ, অরূপ পাল

    ছবিঃ লেখক, দীপঙ্কর পাড়ুই।
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @