চীনের আক্রমণই কি নেহেরুর মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছিল

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মৃত্যু ত্বরান্বিত হবার অন্যতম কারণ ১৯৬২ সালে ২০ অক্টোবর চীনের ভারত আক্রমণ। চীন ভারত আক্রমণ করেছিল একথা বললেই নকশালপন্থীরা চিড়বিড়িয়ে উঠবে, যদিও চীনের গণফৌজ (পিএলএ) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বমডিলা অব্দি চলে এসেছিল। সিপি আই(এম) নেতারাও রুষ্ট হবেন। তাঁরা নানা উকিলি যুক্তি দেন। এক, পিএলএ তাহলে আবার ফিরে গেল কেন? চীন কোন ব্যাখ্যা দেয়নি কিন্তু। এঁরা হাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে চলেছেন। কথায় আছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়ো। চীনের স্ব-ঘোষিত মুখপাত্রের মত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যেহেতু পিএলএ ভারতভূমি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, অতএব আক্রমণ বলা যাবে না, যেন পিএলএ সেনারা আসেইনি। দুই, বাসবপুন্নাইয়া, সুন্দরাইয়া, প্রমোদ দাশগুপ্ত, চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, সুনীতি ঘোষ ইত্যাদি মাও-অনুরক্ত নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা বলতেন, একটি সমাজতন্ত্রী দেশ কখনো আরেকটি দেশ আক্রমণ করতে পারে না। আমি একবার একটি স্মরণসভায় বলেছিলাম, সাধারণত নকশালপন্থীদের পড়াশোনা কম এবং পল্লবগ্রাহী। তেলে-বেগুনে রেগে গিয়েছিলেন এক প্রাক্তন নকশাল ছাত্র নেতা। পার্টিভাগের সময় চীনপন্থীদের সম্পর্কে এ-কথা খাটে। তা নাহলে বলতে পারতেন না, একটি সমাজতন্ত্রী দেশ কখনো আরেকটি দেশ আক্রমণ করতে পারে না। এদের ইতিহাস জ্ঞান গর্বিত গর্দভের মতো অথবা জেনেও না জানার ভান করেছিলেন। উদাহরণ দিই। ১৭/৯/১৯৩৯-এ রুশ বাহিনী পোল্যান্ড, ৩০/১১/১৯৩৯-এ ফিনল্যান্ড, ১৮/৭/১৯৪০-এ ল্যাটভিয়া, লিথুরানিয়া ও এস্থোনিয়া আক্রমন করেছিল (সোভিয়েত-প্রেমী রবীন্দ্রনাথও মনঃকষ্টে লিখেছিলেন, ‘ফিনল্যান্ড চূর্ণ হ’ল সোভিয়েত বোমা বর্ষণে)। এই কথাগুলি আগুনখেকো বিপ্লবীরা চেপে গিয়েছিল।
সেই সময় পার্টির (অবিভক্ত সিপি আই)-এর জাতীয় পরিষদ সদস্য ও কলকাতা জেলা পরিষদ সম্পাদক জলি মোহন কল এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ১৯৫৯ সালে পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষ চীনে গিয়েছিলেন (সম্ভবত কোঙ্কা গিরিপথে পি এল-এ সেনাদের গুলিতে ৯জন ভারতীয় জওয়ান নিহত হবার পরে) এবং ফিরে এসে জাতীয় পরিষদে জানিয়েছিলেনঃ ‘চৌ এন লাই তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেন, চীন যদিও ম্যাকমোহন লাইন মানে না, কিন্তু চীন কখনো ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করবে না। কাজেই চিনের গণ ফৌজ-এর ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত চৌ-র নয়, মাও সে তুং-এর।’
সেই সময় সিপি আই-নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত। এক অংশ ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ লাইন-এর প্রবক্তা (যাদের সিংহভাগ নেহরু-র শান্তিকামী ও সোভিয়েত-ঘেঁষা নীতির ঘোর সমর্থক, যথা শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে ও ভবানী সেন), আরেক অংশ ‘গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট রণনীতির পক্ষে , যাঁদের অধিকাংশ নেহরু-সমালোচক ও চীন-ঘেঁষা, যেমন বাসবপুন্নাইয়া, সুন্দরাইয়া, প্রমোদ দাশগুপ্ত ও হরেকৃষ্ণ কোঙার)। কাজেই চীন কখনো ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করবে না, এই আশ্বাস নেহরুর কাছে কেঊ না কেউ পৌঁছে দিয়েছিলেন। কাজেই তিনি ভাবতে পারেননি, চীন তা মেনে চলবে না। তাই ২০ অক্টোবরের পর কংগ্রেসের ভিতরে-বাইরে নেহরু-বিদ্বেষীরা তাঁকে যারপরনাই হেনস্থা করে। সেই ধকল আর সইতে পারেননি। তাঁর জীবনাবসান ঘটে ২৭ মে ১৯৬৪।
আমি মেনস্ট্রিম সাপ্তাহিক-এ ২০১২ সালের নভেম্বরে এ নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখি -
https://mainstreamweekly.net/article3805.html। গত শতকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক ডঃ হেমেন রায়ের ‘পিকিং এন্ড ইন্ডিয়ান সিপি আই’(প্রামাণ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ) বই থেকে উদ্ধৃত করে লিখি, ১৯৬২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অস্টম কেন্দ্রীয় কমিটির দশম প্লেনামে এক গোপন অধিবেশনে স্বয়ং মাও ভারত আক্রমণের নীল নকশা পেশ করেন। সেটা বিশদভাবে প্রকাশিত হয়েছিল চাইনিজ ল অ্যান্ড গভর্নেন্স পত্রিকার ১৯৬৮-৬৯ সালের শীত সংখ্যায়, যা ডঃ রায় উল্লেখ করেছিলেন।
বুদ্ধদেব বসু একবার লিখেছিলেন, যা সত্য, তা বিদ্যুতের মত উদ্ভাসিত হয়। মাও-ভক্তরা এই লেখা পড়ে রুষ্ট হলেও আমি নিরুপায়। স্তালিন-অনুগামীদের বোধোদয় হবে কিনা, সে প্রসঙ্গে জর্জ অরওয়েল লিখেছিলেন, ‘কোনও তোতাপাখিকে নতুন শব্দ শেখানোর চেষ্টা করা পণ্ডশ্রম’।