No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    গাছমানুষের ডায়েরি – ৫

    গাছমানুষের ডায়েরি – ৫

    Story image

    সাইকেল যেখানে থেমেছিল:

    অ্যাক্লিমাটাইজেশানের জন্য হোরোম্বো ক্যাম্পেই রাত্রিবাস। রাজকীয় ব্রেকফাস্ট সেরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া জেব্রা রকের কাছে। উল্টোদিকে মাওয়েনজি পিকের গায়ে সরু সুতোর মতো বরফ। সিনাসিয়া গাছ, মস। গাইড ব্রুনো চিনিয়ে দিচ্ছিল সব। এইসবই নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব।

    দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল। সকলেই হয় পোর্টার নয় গাইড নয় কুক। বিভিন্ন ক্লাইম্বার দলের সঙ্গে এসেছে। কেউ উপরের দিকে যাওয়ার পথে, কেউ বা ফিরতি পথে। আমার গায়ের রং অনেকটাই তানজানিয়ার এই অঞ্চলের মানুষ জনের সঙ্গে মেলে। তার উপর আরুসায় বেনসনের মা আমার লম্বা চুল এখানকার মতো ছোট ছোট বিনুনি করে বেঁধে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে হয়ে গেছে ‘আমি তোমাদেরই লোক’। তাই সব পোর্টাররা সব গাইডরা আমার সঙ্গে সহেলি ভাষাতেই কথা শুরু করছে। যে ভাষার গোটা ৮–১০টা শব্দ ছাড়া আমি কিছুই জানি না। 

    কাজেই বাধ্য হয়ে বলতে হল যে আমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছি। গত ২০১১ সাল থেকে আমি সাইকেলে ভ্রমণ করছি। এই তানজানিয়া আমার ১৭তম দেশ। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪৫,০০০ কিলোমিটার সাইকেল যাত্রা সম্পন্ন করেছি। শুধু ভ্রমণের জন্য নয়। এই অভিযান গাছ লাগানোর সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। আমি প্রায় প্রত্যেক দিনই কোন না কোন স্কুল বা কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে আমার প্রেজেন্টেশন দেখাই আর সকলকে বলি ‘সারা জীবনে অন্তত একটি গাছ লাগিয়ে তাকে বড় করে তুলুন’। আজ অব্দি পাঁচশোর বেশি ইনস্টিটিউশনে আমার প্রেজেন্টেশন দেখাতে পেরেছি। 

    আমি ইংরেজিতে বলছিলাম আমার ‘গ্রিন অন হুইল’ এর কাহিনি। যাঁরা গাইড তাঁরা বেশ ভালো ইংরেজি জানে। পোর্টাররাও মোটামুটি বুঝতে পারে, বলতেও পারে। তানজানিয়ার প্রথম ভাষা সহেলি এবং দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি। আর এই কিলিমাঞ্জারো অভিযানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষজন আসেন। তাই পোর্টাররা কাজের সূত্রে ইংরেজি বলতে এবং বুঝতে পারে। তা সত্ত্বেও আমার গাইড ব্রুনো তাঁর সাইকেলের চেনে তেল দিতে দিতে সহেলি ভাষায় আমার বক্তব্য তর্জমা করে দিচ্ছিল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, একজন-দুজন করে অভিযাত্রীও জমা হয়েছেন। এক অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রমহিলার থেকে প্রশ্ন এল, সাইকেলে গাছ লাগানোর বক্তব্য নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণের মাঝে কিলিমাঞ্জারো অভিযান কী করে ঢুকে পড়ল? খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন। বললাম আমি পাহাড়-প্রেমী মানুষ। আমার দেশের হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় গেছি। পাহাড় চড়ার পাঠগুলিও নিয়েছি। তাই আফ্রিকায় গাছ লাগানোর বক্তব্য নিয়ে যখন এই অঞ্চল দিয়ে সাইকেলে যাচ্ছি তখন হাতের কাছে কিলিমাঞ্জারোকে পেয়ে গিয়ে ছাড়ি কী করে? আর সব সময়ের সঙ্গী আমার বাহন আমার চেতককেই বা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করি কী করে? তাই সাইকেল নিয়ে আমার কিলিমাঞ্জারো অভিযান।

    দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে সাইকেলের চেন পরিষ্কার করে একটু তেল দিলাম। দুটো সাইকেলের হাওয়া পরীক্ষা করলাম। দুই দেশের জাতীয় পতাকা হ্যান্ডেলে ঠিকঠাক করে লাগিয়ে ক্যাম্প সাইটে একটু চালিয়ে দেখে নিলাম। সব ঠিকই আছে। ওদিকে হোরোম্বো হাট লেখা বোর্ডের কাছে নাচ আর গান শুরু হয়েছে। এইমাত্র যে বড় দলটা সামিট করে ফিরল তাদের পোর্টাররা গোল করে নেচে নেচে একটা স্থানীয় গান গাইছে। সঙ্গে অভিযাত্রীরাও। অদ্ভুত সুন্দর গানের ছন্দ আর কথাগুলিও। এদিকে নিচের ক্যাম্প থেকে আমার সঙ্গে আগে আলাপ হওয়া ৯ জনের ভারতীয় দলটিও পৌঁছে গেছে। আমরা সবাই ওই নাচে যোগ দিলাম। সফল অভিযান করে সুস্থভাবে ফিরে আসার আনন্দে নাচ গান। 

    এই পর্ব চুকলে ভারতীয় দলটির সঙ্গে কফি খেতে খেতে নানান গল্প হল। দেখা গেল আমাদের কিছু কমন ফ্রেন্ডস ও আছে যারা নানান রকমের অভিযান করে। কিছু পরে আমার ঘরে এসে দেখি নতুন অতিথি এসেছে একজন। আলাপ হলো। নাম বলল কাইতো। জাপান থেকে এসেছে। ও একাই। দুপুরের খাবার আগেই খাওয়া হয়ে গেছিল। বিকেলটা ক্যাম্প সাইটেই এদিক ওদিক হেঁটে বেড়ালাম। অ্যাক্লিমাটাইজেশান ভালোই হয়েছে মনে হচ্ছে। আমার চেতককে নিয়ে নানান মানুষ ছবি তুললেন। কেউ ফ্রান্সের কেউ নরওয়ের কেউ বা কানাডার। অস্ট্রেলিয়ান দলের সদস্যরা তাদের দেশে আমার ভ্রমণের সময় তাদের অতিথি হওয়ার নেমন্তন্ন জানালেন। রাত্রে উগালি খেলাম। আগে থেকে বলে রেখেছিলাম যে আমি আজ উগালি খাব। ভুট্টার আটাকে গরম জলে গুলে শক্ত মণ্ড মতো বানানো হয়। তাকে মেইজ পরিজও বলে। এর নিজস্ব কোন স্বাদ নেই। সঙ্গে যা খাওয়া হয় তার স্বাদেই খেতে হয়। আমার জন্য মুরগির ঝোল ছিল। আর প্রচুর কাঁচা সালাদ। আমার রুমমেট জাপানি কাইতো একটু অসুবিধায় আছে। আমি তাকে বললাম জল বেশি খেতে। সাড়ে ন’টায় শুয়ে পড়লাম। হোরোম্বো ক্যাম্পে আমার দ্বিতীয় রাত্রিবাস।

    এবার বেরোতে হবে। চাঁদের পাহাড় ডাকছে। 


    (চলবে)
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @