No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    গাছ-মানুষের ডায়েরি-২

    গাছ-মানুষের ডায়েরি-২

    Story image

    ২৩ জানুয়ারি ২০১৯-- আজ বিশ্ব বরেণ্য নেতাজির জন্ম দিবস। বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার নেতাজি। এমন এক শুভদিনের ভোরবেলায় আমার কিলিমাঞ্জারো অভিযান শুরু। গত রাত্রে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম তাই ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল। ব্যাগ গোছানোই ছিল। তাও, আরো একবার সব ঠিকঠাক ভাবে দেখে নিলাম কিছু বাদ পড়ল কিনা। 

    এর আগে ৭ বার আমার ক্লাব সোনারপুর আরোহীর সঙ্গে হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বতের অভিযানে গেছি। কখনো গাড়োয়াল হিমালয়, আবার কখনো কুমায়ুন। সেসবের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে নিজেদেরই ছিল। কখনো শেরপা, কখনো বা হাই ওল্টিটিউট ফ্রেন্ডসদের সঙ্গে নিলেও তাঁবু, পোশাক, পাহাড় চড়ার উপকরণ, কাঁচাবাজার—সবকিছুর ব্যবস্থা নিজেরাই করেছি। কিন্তু এখানে আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কিলিমাঞ্জারো অভিযান করতে গেলে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে কোনো সংস্থার হাতে সঁপে দিতেই হয়। কেউ চাইলেও নিজে নিজে অভিযান করতে পারবে না। যেমন এভারেস্টের ক্ষেত্রে ঘটে। কাজেই আমি এখন সোতে অ্যাডভেঞ্চারের হাতে। তবে আমি একটু ব্যতিক্রমী ক্লাইম্বার। কারণ আমার সঙ্গে আমার চেতকও যাবে। সাইকেল নিয়ে যাবার জন্য আমাকে অনেক বাড়তি খরচও দিতে হয়েছে। 

    কিলিমাঞ্জারো পর্বত একটি ঘুমন্ত আগ্নেয় পর্বত। উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যভূমি বদলায়। কিলিমাঞ্জারো ন্যাশনাল পার্ক সর্বমোট ১০০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত, যাতে চিরহরিৎ ঘন অরণ্যরাজি দেখতে পাওয়া যায়। আবার উপরের উচ্চতায় মস্‌, ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের দেখা মেলে। কিলিমাঞ্জারো পর্বত অভিযানের জন্য সর্বমোট সাতটি ট্রেকিং রুট আছে। তার মধ্যে পাঁচটি পথ বেশি ব্যবহৃত হয়। মারাংগু রুটে সব থেকে বেশি অভিযাত্রী যান। এই পথের প্রবেশদ্বার কিনাপা। কিনাপা আবার কিলিমাঞ্জারো ন্যাশনাল পার্ক-এর হেড কোয়ার্টারও। 

    আমার সোতে অ্যাডভেঞ্চারের মানুষজন জুলিও, লিলিয়ান আর ওয়াসিম সকাল আটটায় আমাকে মোসি শহরের ওয়েস্ট ইস্ট লজের থেকে গাড়িতে তুললেন। তখন সকাল নটা। মোসি শহরের মার্কেট এরিয়ায় একবার গাড়ি দাঁড়াল। সেখানে আমার গাইড ব্রুনো, আমার কুক আর জ্যাকসন সহ আরো দুজন পোর্টার বা মালবাহক আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমার চেতক আর আমার গাইড ব্রুনোর সাইকেল গাড়ির ছাদে জায়গা পেল। মোসি শহর থেকে কিলিমাঞ্জারো ন্যাশনাল পার্কের মারাংগু গেটের প্রবেশদ্বারের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। রাস্তা ভালো হলেও মেন রোডে গাড়ির সংখ্যা এবং বাম্পার অনেক বেশি থাকার জন্য প্রায় এক ঘন্টা সময় লেগে গেল গেটে পৌঁছতে। 

    তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। এখানে প্রায় ঘন্টা দেড়েক লাগল কাগজপত্রের কাজ সারতে। জুলিও আর ব্রুনো অফিশিয়াল কাজগুলো করে নিল। ক্লাইম্বার হিসাবে আমাকে কিলিমাঞ্জারো ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশের খাতায় নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট নাম্বার লিখতে হল। এরপর কিছুক্ষণের জন্য ফটোসেশন। ততক্ষণে আমার অভিযানের ৪ জন সঙ্গী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলি ভাগাভাগি করে প্যাকিং করে নিয়েছে। এখানে এক ভারতীয় অভিযাত্রী দলের সঙ্গেও আলাপ হল। মাঝবয়সি, কমবয়সি মিলিয়ে ৯ জনের এই দলটি মহারাষ্ট্র থেকে এসেছে। ১০ বছরের এক বালকও রয়েছে দলটিতে। ছবি তুললাম একসঙ্গে। অন্যান্য অভিযাত্রীরা এইখান থেকে হাঁটা শুরু করলেন। কিন্তু, এই রাস্তা আমার জন্য নয়। আমি সাইকেল অভিযাত্রী। তাই মারাংগু গেট থেকে আবার গাড়িতে চলে এলাম কিলেমা গেট। এখান থেকে কিলেমা সাইকেল রুট শুরু। 

    এই রুট আসলে রেস্কিউ রুট। ১৯ কিলোমিটার গিয়ে হোরোম্‌বো ক্যাম্পে মারাংগু রুটের সঙ্গে মিশেছে। কিলেমা গেটে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের কাগজপত্র দেখানো হল। সঙ্গে আনা প্যাক লাঞ্চের সদ্ব্যবহার করে সাইকেল রেডি করলাম। সাইকেলের হ্যান্ডেলবারে দুই দেশের জাতীয় পতাকা। আমার দেশ ভারতবর্ষ এবং যে দেশে বর্তমানে রয়েছি সেই তানজানিয়ার জাতীয় পতাকা। পিঠের ন্যাপে পাইপ লাগানো জলের পাউচ, ক্যাডবেরির ছোট বার, সাইকেল সারানোর যন্ত্রপাতি। ব্রুনোর পিঠেও ছোটো ব্যাগ। কিলেমা গেটে ফটোসেশন শেষ করে জুলিও, লিলিয়ান আর ওয়াসিম বিদায় নিল। ঠিক বেলা দুটোয় শুরু হল আমার সাইকেলে আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কিলিমাঞ্জারো অভিযান।

    আমার সঙ্গী আমার গাইড ব্রুনো এর আগে প্রায় আড়াইশো বার কিলিমাঞ্জারো অভিযান করেছে। বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রীদের নিয়ে সামিটে গেছে। কিন্তু সাইকেলে অভিযান ওর দ্বিতীয় বার। এর আগে ২০১৮-র নভেম্বরে এক আমেরিকান অভিযাত্রীর সঙ্গে সাইকেলে কিবো ক্যাম্প পর্যন্ত গেছিল। ইংরেজি বেশ ভালো বলতে পারে। গাছপালার নাম মোটামুটি জানে। কিলেমা গেট থেকে আমাদের আজকের যাত্রা হোরোম্বো হাট পর্যন্ত। রাস্তা ১৯ কিলোমিটার। জুলিও বলেছে দু’ঘন্টা লাগবে। দেখলাম, ব্রুনো কতক্ষণ লাগতে পারে সে ব্যাপারে কিছুই বলছে না। একটু সন্দেহ হল। যাইহোক চলতে শুরু করলাম।

    রেসকিউ রোড গাড়ি চলার মতো চওড়া। কিন্তু ছোট নুড়ি পাথরের রাস্তা এবং ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছে। দু পাশে ঘন গাছের সারি। গাছের গায়ে মস। ব্রুনো আর আমি টুকটাক কথা বলতে বলতে চলেছি। কিছুদুর যাবার পরে বুঝলাম বেশ দম লাগছে সাইকেল চালাতে। মাঝে মাঝে দাঁড়াতে হচ্ছে। জল খাচ্ছি এক ঢোক এক ঢোক। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য দাঁড়াতে পারছি না। কারণ, আমি দিনের আলো থাকতে থাকতে হোরোম্বো ক্যাম্পে পৌঁছতে চাই। আবার রাস্তার দুদিকের জঙ্গলের সৌন্দর্য, পাখির ডাক, নতুন কোন ফুলের শোভাও তো বাদ দিতে পারছি না। ব্রুনো আমাকে নতুন নতুন গাছ চেনাচ্ছে। এক জায়গায় ব্লু মাঙ্কি দেখাল। যে’রকম জঙ্গল সেই তুলনায় পাখি কম। মোটামুটি ১০ কিলোমিটার যাবার পর বড়ো গাছের জঙ্গল হঠাৎই শেষ হয়ে গেল। শুরু হল মূর ল্যান্ড ভেজিটেশন। ছোটো ছোটো নানা ধরনের গাছপালা। আর শুরু হল চড়াই।

    (চলবে) 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @