No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বহুযুগ ধরে কন্যাভ্রুণ হত্যা, বাল্যবিবাহকে পাপ বলে ভাবেন লুপ্তপ্রায় ধীমাল উপজাতি

    বহুযুগ ধরে কন্যাভ্রুণ হত্যা, বাল্যবিবাহকে পাপ বলে ভাবেন লুপ্তপ্রায় ধীমাল উপজাতি

    Story image

    উত্তরবঙ্গের আদিম জনজাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ধীমাল জনজাতি। স্বাধীনতার আগে নেপাল সীমান্ত থেকে আলিপুরদুয়ার, অসম সীমানা মিলিয়ে ব্রিটিশদের এক সমীক্ষায় তাদের সংখ্যা ধরা পড়েছিল প্রায় ১৫ হাজার। আর এখন সর্বশেষ সমীক্ষায় তাদের সংখ্যা সবমিলিয়ে ধরা পড়েছে মাত্র এক হাজারের সামান্য কিছু বেশি। তাও তাদের অস্তিত্ব শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়ি ব্লক মিলিয়ে মাত্র কয়েকটি গ্রামেই রয়েছে। এত কম জনসংখ্যার পরেও পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে তারা কোনও চাপ তৈরি করছেন না। কারণ তাদের যুক্তি, পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি হলে বা জন্ম হার বেশি হলে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। শিশুদের সঠিক লেখাপড়া হবে না। ফলে সমস্যা আরও বাড়বে। এই ধীমাল জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর প্রায় প্রত্যেকেই আর্থিক দিক থেকে অনগ্রসর।

    ধীমালদের চাষ করা গম শুকোতে দিয়েছেন রোদে

    শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়ি থানার কেটুগাবুরজোত এমন একটি গ্রাম, যেখানে ধীমালরাই বেশি সংখ্যায় রয়েছেন। সেই গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ধীমালদের বিষয়ে আরও অনেক তথ্য জানা গেল। তারা জানাচ্ছেন, ধীমালদের মধ্যে কন্যাভ্রুণ হত্যা কোনওভাবেই কেঊ মেনে নেবেন না। কন্যাভ্রুণ হত্যাকে তারা মহাপাপ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বাল্যবিবাহও তারা মানেন না। বরং পাত্রের চেয়ে পাত্রীর বয়স বেশি হলেই তারা সেই পাত্রীকে সাদরে গ্রহণ করেন। তাঁরা বলেন, পাত্রীর বিয়ের পর সন্তান হলে মা হন। আর মা যদি একটু বাবার চেয়ে বয়সে বড়ো হয় তবে একটু পরিণত ভাবনা বা চাপ নিয়ে সংসার সামলে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পারেন। তবে আমাদের সমাজে পরিবার পরিকল্পনার জেরে প্রতিটি পরিবারে সন্তান সংখ্যা এক বা দুইতে আমরা  নিয়ন্ত্রণ করি। সেখানে ধীমালদের মধ্যে পরিবার পিছু এখনও গড়ে সন্তান সংখ্যা চারজন। ধীমাল সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ গর্জেন কুমার মল্লিক বলেন, “আমাদের এই জনজাতির সংখ্যা অত্যন্ত কমে গেলেও আমরা পরিবার পিছু চারজনের বেশি সন্তান মেনে নিই না। এর কারণ হিসাবে অপুষ্টি, আর্থিক অনগ্রসরতা, লেখাপড়া শেখানোর কষ্ট উল্লেখ করছি।”

    ধীমাল সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ গর্জেন কুমার মল্লিক

    ধীমাল সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও একটি মজার এবং উল্লেখ করার দিক হল, তাদের সমাজে বিয়ের আগে কন্যার মতামত জানতে চাওয়া হয় যে তার বিয়েতে মত আছে কিনা বা পাত্রকে পছন্দ কিনা। যদি কন্যার বিয়েতে মত না থাকে তবে তাদের সমাজেও কন্যাকে অপহরণ করে সেই পাত্রের সঙ্গ বিয়ে দেওয়ার আর একরকম প্রথাও চালু রয়েছে।

    এই ধীমালদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। এখন অবশ্য কিছু কিছু লোক অফিসে চাকরি করেন। নকশালবাড়ির ওই কেটুগাবুরজোত গ্রামে তাদের সংখ্যা ৫৫০ জন। এখন তাদের মধ্যে কলেজ পাশ করা মানুষের সংখ্যা ৫ জন। আর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা মানুষের সংখ্যা ১২ জন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ধান কাটার সময় তারা নাচগানের মাধ্যমে উৎসব পালন করেন। সেই উৎসবকে বলা হয় দেরাদির পুজো।

    নিজের হাতে তৈরি একটি সংগীত যন্ত্র

    ধীমালদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে বহু কিছু হারিয়ে যেতে বসেছে। কেটুগাবুরজোত গ্রামের স্কুল শিক্ষক গর্জেন কুমার মল্লিক সেদিক থেকে ধীমাল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এক নতুন দিশা। ১৯৮৩ সালে শিলিগুড়ি কলেজ থেকে বায়োসায়েন্স নিয়ে স্নাতক হন গর্জেনবাবু। এখন তিনি পানিঘাটা হাইস্কুলের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক। শিক্ষা বিস্তার ছাড়াও তিনি ধীমাল সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে একটি দল গঠন করেছেন। ধীমাল জাতি অস্তিত্ব রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সম্পাদক তিনি। এখন তারা কেন্দ্র সরকারের কাছে তাদের সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার দাবি করছেন। গর্জেনবাবু বলেন, “স্বাধীনতার আগেও আমরা ছিলাম তফসিলি উপজাতি। আর এখন আমরা ওবিসি। এটা কেন হবে?”

    ধীমালদের বহু পুরোনো অনেক বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। যেমন তুনজাই, গুমনা, ঢোল, চুঙ্গা মের্দং, মর্চুংয়া। এসব বাদ্যযন্ত্র সাধারণত বাঁশ দিয়েই তৈরি। সেসবও হারিয়ে যেতে থাকায় গর্জেনবাবু বাঁচানোর কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন ছেলেমেয়েদের তিনি সেসব তৈরি ও বাজানোর কায়দাও শিখিয়ে চলেছেন। ধীমাল ভাষায় কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুবাদও করেছেন। আবার নিজেও কিছু গান রচনা করে ধীমাল ভাষায় সুর দিয়েছেন।

    ধীমালদের চাষ করা গম শুকোতে দিয়েছেন রোদে

    ধীমাল সম্প্রদায়ের ওপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন। রাশিয়ার মস্কো থেকে ছাত্রীরা তাদের ওপর গবেষণা করতে এসে গর্জেনবাবুর বাড়িতে রাত্রিবাস করেছেন। সব গবেষণারই মধ্যমনি হয়ে উঠেছেন ৫৮ বছর বয়সী এই স্কুল শিক্ষক। তার আক্ষেপ, তিনি যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেই স্কুলেও কোনও ধীমাল ছাত্র খুঁজে পান না। তার আর একটি প্রস্তাব, ধীমালদের ওপর গবেষণা করতে তাদের এলাকায় বাইরে থেকে অনেকে আসেন। কিন্তু নকশালবাড়িতে কোনও ভালো হোটেল না থাকায় বাইরের লোকজনদের শিলিগুড়িতে হোটেল নিয়ে রাত কাটিয়ে পরদিন তাদের এলাকায় যেতে হয়। কাজেই তাদের ধীমাল অধ্যুষিত গ্রাম এলাকায় হোম স্টে কেন হবে না?

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @